'নন-সেন্স' কথামালা।।(৫) **** 'ইয়ে হ্যায় রাইট চয়েস, বেবি!'

'ইয়ে হ্যায় রাইট চয়েস, বেবি!' 



ছোটবেলায় সবথেকে বেশী দেখতে যা পছন্দ করতাম আজ তা সবথেকে বিরক্তির কারণ হয়ে গেছে। কি অদ্ভুত এই মানসিক বদলানো। সেদিনের সেই ভালো লাগার প্রতিটা শব্দ আজও কেমন করে মনে পড়ে যায় শুধু একটু সময় নিয়ে ভাবলেই হয়। প্রতিটা কথা, প্রতিটা গান, প্রতিটা দৃশ্য যা ছিল ভালোবাসার, ভালোলাগার, যা আমাকে পৌঁছে দিতো এক স্বপ্নের জগতে আজ তার বিন্দুমাত্র উপস্থিতি কিরকম ভাবে যেন বাস্তবের মাটিতে নিয়ে আসে, গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। না, না! অতো গভীর করে ভাবার মতো কিছু নয়। তবুও, মনে পড়ে যাই সেই দিনগুলো। শুধু মনে হয় এই তো সেদিন! এতো তাড়াতাড়ি কি এক জাদু কাঠির ছোঁয়ায় যেন এক পলকে সব বদলে গেল। একসময় যা প্রতিনিয়ত নিয়ে চলতাম জীবনের প্রতি মুহূর্তে আজ আর তার কোন নাগাল পাই না যেন। বিজ্ঞাপনের জগতের সাথে আমাদের ছিল ঠিক এমনই এক সম্পর্ক।
"ইয়ে জমি, ইয়ে আসমান।
হামারা কাল, হামারা আজ।
হামারা বাজাজ।
বুলন্দ ভারত কি, বুলন্দ তসবির।"
বাজাজ স্কুটার কি ভাবে ভারতকে 'বুলন্দ' করেছিল বা আমার বাবার 'বাজাজ প্রিয়া' স্কুটার কি ভাবে ভারতকে অগ্রগতির পথে নিয়ে গিয়েছিল তা তখন বুঝিনি, তবে পরে চালাতে চালাতে বুঝেছি সত্যিই 'বুলন্দ' স্কুটার। না হলে বাবার হাতে ৮৮ সাল থেকে ৯৩ সাল পর্যন্ত চলার পর যখন আমার কাছে ৯৪ এর প্রথমদিকে এলো, আমি তখন 'প্রিয়া' স্কুটার এর সামনের উঁচু সিটে বসেই নিজেকে বেশ উঁচু-উঁচু কেউ-কেটা ভাবতে শুরু করেছি। আর 'বুলন্দ' হবার একমাত্র কারণ আমার তখন এই যে শেষ যেদিন পর্যন্ত আমি এই 'প্রিয়া' স্কুটার চালিয়েছি আমায় কখনো 'ওয়ান ইজ-টু টু' তে 'তেল-মোবিল' ছাড়া আর কোন খরচ করতে হয়নি। কোন খরচ না হওয়া যদি 'বুলন্দ' ভারতের 'তসবির' হয়, তাহলে তাই হয়েছে। বাবা স্কুটার টা কিনেছিল ষোল -হাজার টাকার ধারে পাশে কিছু টাকায়। তখন তো এই স্কুটার কেনার জন্য বাবাকে তিনমাস আগে থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে অ্যাডভান্স বুকিং করতে হয়েছিল। সেটা তখন জানতাম না। তবে স্কুটার আনার আগের দিনের উত্তেজনার বেশ কিছুটা উপভোগ করেছিলাম। অনেকগুলো স্কুটার আর বাইক পার করে আজ মধ্যবয়সে আমি যখন আমার স্বপ্নের বাইক বুলেট কিনলাম, আমাকেও পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তিন মাসের নিয়ম মেনেই অ্যাডভান্স বুকিং করতে হলো। কি অদ্ভুত সমাপতন! ৮৮ সাল আর ১৫ সাল, নিয়ম কিন্তু একই!
নীল বাবা সুট আর হলুদ গেঞ্জি পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাবলু যখন বাড়ী ছেড়ে চলে গিয়ে স্টেশনে বসে থাকে মুখ গোমড়া করে, তখন ডাক-পিওন রামু কাকা বাবলুকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে শুধু 'জ্বালেবি' (জিলাপি) র লোভ দেখিয়ে, যা শুধুমাত্র 'ধারা' তেলেই ভাজা হয়েছে। বাবলুর মতো কত ছেলেই তখন বাড়ী ছাড়তে পারে নি শুধুমাত্র 'ধারা' তেলে ভাজা জিলাপির লোভে। হায়রে ভারতবর্ষ! তোমার বীর ছেলেদের আর বিপ্লব করা হল না, শুধু 'ধারা' তেলে ভাজা জিলাপির স্বাদ ভুলতে না পেরে।
"- পর হাম আপসে এক বাত কহেনা তো ভুল গ্যায়ে। ঘাবরাহিয়ে নেহি, হমে কুছ নেহি চাহিয়ে। হাম ইতনা চাতে হ্যায় কে আপ বারাতিও কা স্বাগত 'পান পরাগ' সে কিজিয়ে!"
ইল্লি আরকি! ভাবা যায়, ছেলের বাবা শাম্মি কাপুর মেয়ের বাবা অশোক কুমারকে বলছে যে ওনাদের নাকি বিয়েতে আর কিছুই লাগবে না। শুধু সবাইকে পাঁচ-টাকা দামের (তখন দাম ছিল) পান-পরাগ দিলেই হবে। ভাবা যায়! পণ দেওয়া-নেওয়া, বধূ-হত্যা, পণ দিতে না পারার জন্য, কোটি টাকার পণ নিয়ে সরকারী অফিসারের বিয়ে এসব গল্প তো আমরা আফ্রিকার জনজাতিদের কথায় শুনেছি! তাই না? রবি ঠাকুরের 'দেনা-পাওনা' পড়ে বড় হলাম আর সেই আমাকেই তুমি শেখাতে এসেছো যে বিয়েতে শুধুমাত্র বরযাত্রীদের 'পান-পরাগ' দিলেই হবে! হায়রে ভারতবর্ষ! যা তোমার জীবনে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ঘটে চলে তাকে ঠিক উল্টো করে হাজির কর এই বোকা-বাক্সের পর্দায়।
"সৌন্দর্য সাবুন নিরমা!"
লম্বা ঝকঝকে এক মেয়ে (পরে চিনেছিলাম, সোনালি বিনদ্রা) , সদা লাস্যময়ী রূপে গোটা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে, একবার ছোট প্লেনে তো একবার হেঁটে সমুদ্রের ধারে, একমুহূর্তে পাহাড়ে তো আর পরের মুহূর্তে আফ্রিকান সাফারি তে জীপ গাড়ী নিয়ে জিরাফ আর সিংহ এর সামনে, শেষে তো পাহাড়ের মাথাতেই বাথ-টব নিয়ে চান করতে শুরু করে, আর সাথে থাকে 'নিরমা' সাবান।
আর এর সাথেই আছে 'নিরমা! নিরমা! ওয়াশিং পাউডার, 'নিরমা'! এর সেই গান। মানুষজন ভুলেই গিয়েছিল 'নিরমা' একটা ব্র্যান্ড নাম। কাপড় কাচার সাবান মানেই ছিল 'নিরমা', সে শহর হোক আর প্রত্যন্ত গ্রাম হোক।
সমস্ত সাবানের বিজ্ঞাপন একদিকে আর অন্যদিকে ছিল 'লিরিল' এর সেই সবুজ সাবান, যা এক মুহূর্তে সবাইকে ফ্রেশ করে দিত। ওরা যেন তখন কি এক বলতো, "কাম এলাইভ উইথ লিরিল ফ্রেশনেস!" জঙ্গলের মাঝে ঝরনা, সবুজ বিকিনিতে সবুজ সাবান নিয়ে সেই ঝরনায় ঝাঁপ দিচ্ছে এক অষ্টাদশী। হাত-পা ছুড়ে এক মুহূর্তে জলের গভীরে যাচ্ছে তো পরের মুহূর্তে পাথরের উপরে আর মুখে, 'লা আ আ... লা লা লা'! পুরো একটা প্রজন্ম যেন হটাৎ করেই বড় হয়ে গেল। কোথায় লাগে তখন মাধুরী দীক্ষিত, শ্রীদেবী দের তৈরী সেই ভাতের মতো সাবান (মানে ওই একটু জল লাগলেই কেমন ভাত-ভাত হয়ে গলে যেত!) 'লাক্স' এর বিজ্ঞাপন! ছোট বেলা থেকেই সেই যে 'লিরিল' সাবানের প্রতি আকর্ষণ তা কতটা ওই 'ফ্রেশনেস' এর জন্য আর কতটা 'ফ্রেশ' কিছু চাক্ষুস করায়, কে জানে! দেখতে পাই না এখন আর ওই সাবানটা। বা হয়তো অনেক নামের ভীড়ে হারিয়ে ফেলেছি।
"আই এম এ কমপ্লান গার্ল!
আই এম এ কমপ্লান বয়!"
ইয়ারকি মারলে হবে! ২৫ টা ভাইটাল ফুডের গুন সাথে মিল্ক প্রোটিন ও আছে। আমি ছোটবেলা থেকেই কিছুতেই ভেবে পেতাম না যে ওই ২৫ টা ভাইটাল ফুডের গুন আর দুধের প্রোটিন মিশিয়ে এতো কম দামে 'কমপ্লান' কি করে বিক্রি করত! বাবা কে বলেছিলাম। এনে দিয়েছিল। একটা কৌটো ও শেষ হয়নি। অনেক পরে বুঝলাম, দোষটা ওদের নয়, দোষ তো আমারই। বাপের কালে কোনোদিন একদিনে ২৫ টা ফুড খেয়েছি যে 'কমপ্লান' হজম করব! তাই ক্ষমা দিলাম। আর তাই আমার মায়েরও 'কমপ্লান মাম্মি' হয়ে ওঠা হল না, যদিও আমি আর বোন খুব চেষ্টা করেছিলাম 'কমপ্লান-গার্ল' আর 'কমপ্লান-বয়' হয়ে ওঠার।
রবিবার ঠিক সকাল নটায় রামায়ন শুরু হবার আগে সময় যেন কাটতে চাইতো না। মাসীমা আমায় যখন প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পড়িয়ে ছাড়তো, তারও এক নির্দিষ্ট সময় ছিল। একটু যদি মনে করা যায় তাহলেই ভেসে উঠবে সেই দৃশ্য আর শব্দ।
"হেঁ, হেঁ! লিজ্জত, লিজ্জত পাঁপড়!"
নাকি গলায় খরগোশ পাঁপড় খেতে খেতে ওই কথাগুলো বলছে। আর ঠিক তারপরই দূরদর্শনের বিখ্যাত একটা চক্র ট্যাঁও করে বন্ধ হয়ে 'রামায়ণ' এর মিউজিক শুরু হতো। আর আমার মোটামুটি রবিবারের পড়া শেষ হতো। একটার সময় আলিফ-লায়লা শেষ করে তবে উঠতাম। উঠে চান করে মাংস র ঝোল ভাত খেতে খেতে আবার দূরদর্শনে ১.১৫ র মুক-বধির দের সংবাদ দেখতে দেখতে অপেক্ষয়ায় থাকতাম কোনদিন দুপুরের রিজিওনাল ফিল্ম এ হিন্দি দেবে। খুবই কম দিত যদিও। এই সময়টা আমি অতো আগ্রহ নিয়ে না দেখলেও বাড়ীর সবাই দেখত। বিকালের শেষে যখন খেলা ফেরত বাড়ী আসতাম তখনো সবাই ওই দূরদর্শনে বাংলার একমাত্র পুরুষ উত্তমের দিকে তাকিয়ে আছে। রবিবার বাংলা আর শনিবার হিন্দি সিনেমার দিন ছিল যে। আর বুধবার সন্ধ্যে আটটায় চিত্রহার, আর মঙ্গল বার রাত্রি এগারো টায় কিলেখা রহস্য, এই রকম আট দশটা অনুষ্ঠানই ছিল আমাদের প্রথম জীবনে দূরদর্শনের যোগাযোগ। আর ছিল অজস্র বিজ্ঞাপনের রঙ্গিন (সাদা কালো টিভি তে দেখলেও) দুনিয়ার হাতছানি, যা দেখেই বড় হলাম। আমি এখন মাঝে মাঝে ভাবি, কি ভাবে আমরা তখন বুঝতাম 'রুহ আফজা' শরবতটা লাল রঙেরই আর 'রসনা'র রঙ টা কমলালেবুর মতো। বুঝতে পারতাম, এটা ঠিকই। পরে রাস্তা ঘাটে, দোকানে বা বাড়িতে বিজ্ঞাপনের দেখা জিনিষ দেখলেও কখনো নতুন কিছু মনে হতো না। ভালোলাগা থাকলেও শুধু মনে হতো যেন আগে কতবার দেখেছি। আসলে টিভির পর্দায় দেখা জিনিষগুলো কখন আমাদের ধীরে ধীরে ঘরের বাকি জিনিষগুলোর মতোই হয়ে গেছে।
সময়টা তখন আমাদের বেশ অদ্ভুত, বেশ অন্যরকম একটা অনুভূতি শরীর আর মন জুড়ে। বড় হবার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না।
পোলো খেলার মাঠ। ঘোড়ার পা আর পোলো বল আর পোলো স্টিক, দৌড়াচ্ছে। কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু খেলার শেষ শট এর আগে এক ঝলক সুন্দরী মেয়ের মুখ। তারপরই বিজয়ী পুরুষ। লাল টিউব আর লাল প্লাস্টিকের বোতল। "ওল্ড স্পাইস',- 'দা লাদার সেভিং ক্রিম, দা মার্ক অব আ ম্যান।" সব বুঝে গেলাম। ম্যান হতে 'ওল্ড স্পাইস' লাগবেই, সে ক্রিম হোক বা আফটার সেভ লোশনই হোক। উঁকি ঝুঁকি দিয়ে পেয়েও গেলাম বাবার দাড়ি কামানোর বক্সে। কিন্তু হস্তগত তো করতে পারলাম না। তাই মাঝে মাঝে লুকিয়ে গন্ধ নিতাম। কিরকম এক অদ্ভুত দম বন্ধ হয়ে যাওয়া ভালোলাগা তৈরী হতো। বড় হয়েই প্রথম যখন সেই 'ওল্ড স্পাইস' খুঁজতে গেলাম দোকানী কাকু বললো, এখন 'পার্ক এভিনিউ' ব্যবহার করাই স্টাইল। ধীরে ধীরে 'পার্ক এভিনিউ' হয়ে আজ তো 'জিলেট' এ চলে এলাম। তবুও সেই 'ওল্ড স্পাইস' এর গন্ধ আজও ভুলি নি। আমার দাড়ি কামানোর বাক্সে একটা 'ওল্ড স্পাইস' আফটার সেভ লোশন প্রায় পনেরো বছর আগের কেনা, ব্যবহার না করা পড়ে আছে। প্রাণে ধরে ব্যবহার করতেও পারি না আর পুরোনো বলে সেই লাল প্লাস্টিকের বোতলটা ফেলেও দিতে পারি না। প্রতিবার ফেলে দেবার আগে মনে হয়, এর সাথে আমার পরিচয় সেই নয়ের দশকের প্রথমে। শুধু এই ভেবেই আজও রয়ে গেছে।
"- রাজু, তুমারা দাঁত তো মতিও জয়সী চমক রাহে হ্যায়!
- কিঁও না হো মাস্টারজী, ম্যায় ডাবর কা লাল দাঁত মাঞ্জন যো ইস্তেমাল করতা হুঁ।
- লেকিন মাস্টারজী, আপকে দাঁত!! (বাকি ছেলেরা হ্যা হ্যা করে হেসে উঠলো।)
- ডাবর কা লাল দাঁত মাঞ্জন? ইয়ে বহুতি আচ্ছা হ্যায় মাস্টারজী।" ( দোকানদার ও মাস্টারজী কে মাজন কোনটা ভালো বা খারাপ বোঝায়)
'ডাবর লাল দাঁত মাঞ্জন' এ দাঁত মোতি র মতো হয়ে যায় কিনা বুঝে উঠতেই পারলাম না কারন বাবা তো সারাজীবন
'কোলগেট' টুথ-পেস্ট ছাড়া আর কিছুই বাড়ী ঢুকতে দেয় নি। তবে ওই যে বলে না, কুকুরের লেজ সোজা হবে তবু আমি নই। একবার মাস কাবা রী বাজার পাড়ার দোকান থেকে আনার সময় আমি বেশ ওস্তাদের মতো করে 'ডাবর লাল দাঁত মাঞ্জন' নিয়ে এসেছিলাম। ওয়াক থু:! পরের দিন সকালে বাবা ওঠার আগেই আবার মায়ের কাছে টাকা চেয়ে 'কোলগেট' নিয়ে এসেছিলাম। আর 'লাল-মাঞ্জন' দিয়ে তার বেশ কিছুদিন পরেই ঝুলনের রাস্তা বানিয়েছিলাম। আর এখন আমি যতই কোলগেট আনি, আমার ছেলে সুযোগ পেলেই একবার 'পেপসোডেন্ট' না হলে 'নমক' যুক্ত কি সব আনবে। সেই একই প্রথা চলছে। শুধু পাল্টেছে আমি রাস্তা বানিয়েছিলাম আর ও কিন্তু নষ্ট করে না, ওটা দিয়েই দাঁত মাজে, আমরা কেউ না মাজলেও।
কলেজের সামনের সিঁড়িতে বসে হাঙ্গার স্ট্রাইক করছে এক দল ছেলেমেয়ে। সবাই হাতে পিসবোর্ড পোষ্টার নিয়ে স্লোগান দিচ্ছে। এমন সময় শোনা গেল সেই সুর:
"কভি জিন্দেগি লাগে ভারী, কভি হালকি!"
আর টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠলো সেই মিষ্টি মেয়ের মুখ। দুষ্টমি মাখানো হাসিতে হাতে 'পার্ক' চকলেট লুকিয়ে খেয়ে চলেছে আর পাশের ছেলেটাকেও উৎসাহিত করছে এই একই কাজ করতে।
"শ্বাসও মে জিন্দা দিল তাজগি।"
পড়ার টেবিলের সামনের পোস্টারের ভিতর থেকে ঐশ্বর্য হেসে উঠছে আর ছেলেটা ছুটে এসে হাঁটু মুড়ে প্রেম নিবেদন করছে। এতো ঝকঝকে হাসি আর কিসে পাওয়া যাবে?
'কোলগেট' দিয়ে ব্রাশ না করলে কি হয়! ভারতীয় টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে ঐশ্বর্য একমাত্র মহিলা যার প্রতিটা অঙ্গ-প্রতঙ্গ মনে হয় প্রায় সব বিজ্ঞাপনেই ব্যবহৃত হয়েছে, সে ফ্লাট টিভির বিজ্ঞাপনে ওর ফ্লাট পেট দেখানো হোক বা স্কিন কেয়ার এর যেকোনো প্রোডাক্ট হোক বা প্রেসার কুকার হোক। মিস ওয়ার্ল্ড হবার পর তো আর কোনো কথাই নেই। প্রতি পাঁচটা বিজ্ঞাপনের একটাতে অবশ্যই ঐশ্বর্যর মুখ থাকত।
"তন্দুরুস্তি কি রকস্যা করতা হ্যায় লাইফবয়।"
ভোলা যায় না, সেই লাল জার্সি পরে ফুটবল খেলতে খেলতে কড়া ট্রাকলে পড়ে যায় খেলোয়াড় কাদা-জলে, আর খেলা শেষে উঠে 'লাইফবয়' সাবানে চান। শুধু এই একটাই সাবান আমার মনে হয় গোটা ভারতবর্ষে সব থেকে বেশী বিক্রি হয়েছিল। রাস্তার পাশে পাবলিক টয়লেট থেকে পাইস হোটেল এর বেসিন হয়ে দামী নার্সিং হোমেও এর ব্যবহার দেখেছি। পরের দিকে 'লাইফবয় গোল্ড', 'প্লাস', আরও কত কিছু বেরুলো, কিন্তু সেই পুরোনো লাল প্যাকেটের লাল লাইফ বয় আজও একই রকম রয়ে গেছে। যদিও 'লাইফবয় গোল্ড' এর সেই মেয়েটাকে আজও মনে রয়ে গেছে, যে শুধু কথায় কথায় বন্ধুদের বলতো, 'আই ডোন্ট কেয়ার!' সে সব সমস্যার সমাধান করে নিত নিজেই। শুধু একবারই তার বন্ধুরা যখন তার গালে ব্রণ দেখিয়ে বললো, বল এবার 'আই ডোন্ট কেয়ার!' একটু ঘাবড়ে গেলেও ও পেয়ে গেল 'লাইফবয় গোল্ড', যা নাকি ব্রণ অবধি সরিয়ে দেয়! চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে। তাই চেষ্টাও করেছিলাম কারন আমার ওই সময় প্রচুর ব্রণ হতো। ধূর, ধূর! শুধু সাবান। আর কিছু নয়। আবার বুঝলাম ওই মেয়েটার মতো গাল টেলিভিশনে র পর্দাতেই হবে, বর্ধমানে থাকা আমার হবে না। অতএব, ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন! বাড়িতে আসতো নির্দিষ্ট কয়েকটা সাবান। লাক্স, যা আমি সব থেকে অপছন্দ করতাম। গরমের সময় 'মার্গো' বা 'নিম', যা ছিল আরো বিরক্তিকর। আর শীতকালে আসতো 'গ্লিসারিন' সাবান, এটা তবুও চলে যায়। কিন্তু শীতকালে ওই ছোটবেলায় আদেও সাবান মেখে চান করতাম! ধরে বেঁধে মা যেদিন অত্যাচার করতো সেদিন হয়তো সাবানের মুখ দেখতাম সপ্তাহ শেষে। কিরকম আসতে আসতে এগুলোও চলে গেল। কত নতুন মাল্টি ন্যাশনাল ব্র্যান্ড এর সাবান এখন ব্যবহার করি, তবুও যেন কিরকম সেই দিনের অনুভূতি পাই না।
"নেইবার্স এনভি, ওনার্স প্রাইড।"
টিভি দেখছি তখন 'সোনি ওরসন' ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট। সেখান থেকে 'বি পি এল' কালার টিভি তে যেতে প্রায় পাঁচ বছর সময় লেগেছিল। এই সময় শুধু স্বপ্ন দেখতাম কবে আমাদের ওই 'নেইবার্স এনভি, ওনার্স প্রাইড' টিভিটা হবে। সেই মাথায় শিং আর সবুজ রঙের ত্রিশুলের মতো লেজওয়ালা সাপ নিয়ে লোকটা টিভি নিয়ে আর কি বলতো কে জানে! শুধু মনে হতো, এটাই সব থেকে ভালো টিভি। পরে অনেক টিভি কেনা হলেও কখনো আমাদের বাড়িতে আর ওই টিভি কেনা হয়নি। হ্যাঁ, আমি 'ওনিডা' টিভির কথা বলছি।
"ঝন্ডুবাম, ঝন্ডু বাম, পীড়াহারি বাম!"
কিসে না কিসে কাজে লাগে, কে জানে! তবে একটা কথা ছোটবেলা থেকেই বুঝে গেলাম এটা হলুদ রঙের মলম। দু-একবার যে লাগিয়ে দেখিনি তাও নয়। তবে অদ্ভুত সেই গন্ধ। একবার লাগালে মোটামুটি বুঝিয়ে দিত কি লাগানো হলো। সেই হাত যদি একবার ভুল করেও চোখে দিয়ে ফেলতাম তাহলে প্রায় 'অর্ধ-কানা' হয়ে যেতাম। বেশ কিছুক্ষন চোখ দিয়ে জল পড়েই যেত। পরের দিকে 'অমরুতাঞ্জন' আর 'ভিক্স ভেপরাব' এই একই কাজ করতো। মানে লুকিয়ে হাতে নিয়ে ক্লাসে কোন বন্ধুর চোখের উপর ঘষে দেওয়া! তবে ভিক্স ভেপরাব' এর বিজ্ঞাপনে আমার সবথেকে যেটা ভালো লাগতো সেটা হলো, নাক- মুখ বন্ধ এক ছেলেকে মা 'ভিক্স ভেপরাব' মালিশ করে দিচ্ছে বুকে আর সেই 'ভিক্স ভেপরাব' কি সুন্দর 'হাফ-সার্কেল' করে বুক থেকে নাকে উঠে যাচ্ছে। আমার তখন শুধু মনে হতো যে 'ভিক্স ভেপরাব' শুধু হাফ- সার্কেলেই যাতায়াত করে। পরে অবশ্য 'ভিক্স' এর অনেক চমৎকারই দেখেছি। কি! বিশ্বাস হলো না!
"ভিক্স কি গোলি লো খিচ-খিচ দূর করো!"
গলার ভিতর মানে ওই কণ্ঠনালীর ভিতর 'খিচ-খিচ' যা একমাত্র 'ভিক্স'এর সবুজ প্রলেপে চলে যায় সে আসলে তারা আকৃতির 'এ্যমিবা', সে তো 'ভিক্স' এর বিজ্ঞাপনই শিখিয়েছিল। দিলাম এঁকে ক্লাস এইটের জীবন বিজ্ঞান খাতায়। কি ভেবে আঁকলাম কে জানে! তারপর তো মোটামুটি পার্থবাবু যা করেছিল, সে আজ আর ইতিহাস। সেসব পরে বলা যাবে।
'বিজ্ঞাপন' নিজেই এক জগত। বিশেষ করে তা যদি আমাদের দেশের বিজ্ঞাপন হয়। এক মায়াময় স্বপ্নের বেঁচে থাকা তৈরী করে এই বিজ্ঞাপন। খেতে-বসতে-উঠতে আমার মতো অনেক ছেলে-মেয়েই এই জগতেই তাদের ছোটবেলা কাটিয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশেই মনে হয় এটা সম্ভব যে একমাত্র বিজ্ঞাপনেই যে কোন শর্তেই মিথ্যা কথা বলা যায়, সে শচীন এর 'সিক্রেট এনার্জি' র জন্য 'বুস্ট' হোক বা সৌরভ এর 'ছায়া প্রকাশনী' পড়ে ভালো রেজাল্ট করাই হোক। এরকম অনেক আছে সে আমরা সবাই জানি। কিন্তু মুশকিল হলো যে আমি এই জানার আগেই কয়েক পেটি 'বুস্ট' খেয়ে ফেলেছি আর প্রয়োজন থাক আর না থাক 'ছায়া-প্রকাশনীর' সব মানে বই কিনে ফেলেছি। যাই হোক, বাদ থাক সেসব। তার থেকে বরঞ্চ আবার গা-ভাসিয়ে দিই সেদিনের সেই রঙিন জগতে।
ভারতীয় বিজ্ঞাপনের জগতে সব থেকে পরিচিত মুখ ঐশ্বর্য রাই এমন কিছু বিজ্ঞাপন দিয়ে তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিল যা আজ হয়তো আর নেই, কিন্তু তার রেশ আমরা যারা সেই সময় দেখেছিলাম তারা আজও ভুলিতে পারি নি।
'পামোলিভ সাবান' থেকে 'ফেয়ার এন্ড লাভলী', 'সিনথল সাটিন পাউডার' থেকে 'টাইটান ঘড়ি' এই সবেতেই সে ছিল সমান ভাবে স্বচ্ছন্দ। স্টারডমে পৌঁছানোর পর তিনিই একমাত্র হিরোইন যিনি একসাথে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানীর একই প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনে অভিনয় করছেন আর দুটো বিজ্ঞাপনই একই সময়ে দেখানো হচ্ছে।
আমীর খান কে সঙ্গে নিয়ে 'পেপসি'র 'রাইট চয়েস' বিজ্ঞাপনে যেমন ছিলেন তেমনই আমীর খানের সাথে "যো চাহে হো যায়ে, /কোকা-কোলা এনজয়" এর বিজ্ঞাপনেও তিনিই ছিলেন। মনে নেই! ই-মেইল করে একে অপরের সাথে দেখা করতে চেয়ে নীচে নেমে এসে দেখে যে সবার হাতেই
কোকা-কোলার বোতল। তাই শেষ করে আবার নতুন বোতল নিতে এসেই ওই বিখ্যাত লাইন।
কিছু বিজ্ঞাপন তো আমাদের শুধু সেই প্রোডাক্টটার সাথে পরিচয় করিয়েই ক্ষান্ত থাকে নি, চিনিয়ে দিয়েছে সেই বিজ্ঞাপনে অভিনয় করা মানুষজনকেও, যারা তখনো বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের পায়ের জমি শক্ত করতে পারে নি। কিন্তু অভিনয়ে তারা তখনই নাম করে গেলেও সেই অর্থে পপুলার মেইনস্ট্রিম ফিল্মের হিরো না হয়েও আমাদের বাড়ী গুলোর অন্দর মহলে ঢুকে গিয়েছিল।
"ম্যাগী হট এন্ড সুইট টম্যাটো সস।"
আর আমায় কিছু বলতে হবে না জানি। জাভেদ জাফরী আর পঙ্কজ কাপুরের সেই অনবদ্য জুটি যারাই আমাকে প্রথম শিখিয়েছিল 'সামোসা' (আমাদের সিঙ্গারা) শুধু সস দিয়েই খেতে হয়। আমরা তো এর আগে মুড়ি দিয়ে মেখেই 'সামোসা' খেতাম। যুগ যুগ ধরে সেই একই স্বাদ। কারন কি? এর গোপনীয়তা শুধু একটা জায়গাতেই: 'ইটস ডিফারেন্ট'।
আবার প্রতিটা ফেভিকল বা ফেভিকুইক এর বিজ্ঞাপন ছিল আমাদের কাছে বেশ মজাদার, যে মুরগি ফেভিকলের কৌটাতে খাবার খেয়ে যে ডিম দেয় তা ভাঙা যায় না, বা ফেভিকুইক লাগিয়ে মাছ ধরতে বসা একবারে অনেকগুলো মাছ ধরে। এই 'না-বিজ্ঞান' 'না-যুক্তি' মানা বিজ্ঞাপনের প্রোডাক্ট গুলো কিন্তু সত্যিই ভালো ছিল।
দু হাজার সালের পর পরই এই বিজ্ঞাপন জগতের এক
বড়-সড় পরিবর্তন হয়ে গেল। 'লুনা', 'বাজাজ' স্কুটারের বিজ্ঞাপন দেখানো টিভি তে এখন শুধু অনেক বিদেশী কোম্পানির বাইক, নানা কোম্পানির গাড়ী আর চারিদিক জুড়ে শুধু মোবাইলের বিজ্ঞাপন। আমাদের সবার ক্রয় ক্ষমতা কি এতো তাড়াতাড়ি বেড়ে গেল? আমরা সবাই কি এতো বড়লোক হয়ে গেলাম? বিজনেস ম্যাগাজিন গুলো যে দামী গাড়ী র বিজ্ঞাপন দেয় সেগুলি আসতে আসতে দূরদর্শনের প্রাইম টাইম এর দেখানো শুরু হলো। আমি আজও বুঝি না, মার্সিডিজ এক্স ক্লাস গাড়ী র বিজ্ঞাপন কি করে একটা তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দি সিরিয়ালের মাঝে দেখানো হয়। যারা ওই গাড়ীটা কেনে তারা কি আদেও এই ধরনের সিরিয়াল দেখে বসে সময় নষ্ট করে! কে জানে!
ভারতীয় দূরদর্শনে বিজ্ঞাপনের জগতে আমরা যখন একরকম প্রায় মজে আছি আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে ঠিক তখনই একদিন দেখলাম বা বলা ভালো শুনলাম, 'ইয়ে হ্যায় রাইট চয়েস, বেবি!' পিয়ানো তে রেমো ফারন্দাদেজ আর সামনে সিঁড়ি দিয়ে ফ্রক পড়া জুহি চাওলা, সদাহাস্য মুখে নেমে আসছে, পিয়ানো থেকে রেমো উঠে গিয়ে জুহির হাতটা নিয়ে এক পাক ঘুরিয়ে দিয়ে ওই বিখ্যাত শব্দ গুলো ছুড়ে দিল। ৯০ এর দশকে বেড়ে ওঠা আমাদেরকে যেন এক ঝটকায় হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট করে দিল। এরপর পেপসির বহু বিজ্ঞাপন দেখলেও আজও ভুলতে পারিনা ওই শব্দগুলো।
'ইয়ে হ্যায় রাইট চয়েস, বেবি!'
এই পাঁচটা শব্দ ভারতীয় বিজ্ঞাপনের জগৎকে এক ঝটকায় যেন রেডিওর মুখে বলা আর টেলিভিশনের ছবি দেখা বিজ্ঞাপনের বিস্তারকে আলাদা করে দিল। সেই সময় বেড়ে ওঠা সমস্ত ভারতীয় টিনএজার দের এক ধাক্কায় সব কিছু বদলে দিল। 'পিজিনাইজেশন' আর 'ক্রিওলাইজেশন' এর সমস্ত তত্ত্ব গুলিয়ে দিয়ে দুটো হিন্দি আর তিনটে ইংরাজি শব্দ দিয়ে তৈরী এই বাক্য হয়ে উঠলো আগামী জেনারেশনের ভাষা। এক নতুন কালচার এর জন্ম দিল। জেনারেশন 'এক্সে'র ভাষা, বেড়ে ওঠা আর মনে তৈরী হলো এই 'হিঙলিশ', যা তারা আজও বয়ে নিয়ে চলে। একটা জাতির দীর্ঘ দিনের সযত্নে লালন করা ভাষা, যা তার স্বত্বাকে ধারন করে চলতো, তাকে যেন ছুঁড়ে ফেলে দিল। আজও আমরা বেরুতে পারিনি সেই জায়গা থেকে।
শুধু পেপসি তার বিজ্ঞাপনের ভাষা এমনভাবে সময়ের সাথে সাথে পাল্টে ফেলেছে যে একসাথে কয়েক প্রজন্মকে মাতিয়ে রাখে। 'ইয়ে হ্যায় রাইট চয়েস, বেবি!' যদি 'জেনারেশন এক্স' তার নিজের ভাষা মনে করে ঠিক তারপরই 'জেনারেশন ওয়াই' ভাবে 'ইয়ে হ্যায় ইংগীস্থান মেরি জান!' কি সুন্দর পরিবর্তন। শাহরুখ খান, শচীন, জুঁহি সবাই যখন 'রাইট চয়েস' মনে করে 'পেপসি' কে, ঠিক তারপরেই শাহরুখ আর জন কে 'আঙ্কেল' সাজিয়ে এক 'জেন-ওয়াই' দু আঙুলের ফাঁকে পেপসির ক্যান নিয়ে বলে,
'স্টাইল থোৱা চেঞ্জ হো গয়া
আঙ্কেল থোৱা সাইড দেনা
পেপসি, মাই ক্যান।'
এর পরই আসে পেপসির সেই বিখ্যাত ক্যাচ-লাইন। গ্রামের ছেলেরা সবাই শচীনের মুখোশ পরে সাইকেলে আসা পেপসি বিক্রেতার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে আর পেপসি নিয়ে গলা ভিজিয়ে মুখোশ গুলো এক এক করে খুলছে, ঠিক তখনই! একটা ছেলের মুখ পাল্টে এখন শচীনের মুখ। মানে শচীন ই এসে পৌঁছেছে ওদের ধুলো-ঝোপ-ঝাড় ময় খেলার মাঠে।
"ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর!"
এর থেকে ভালো বা এর থেকে 'মোর' চাওয়া কি হতে পারে!
চাই, চাই! আরও, আরও, চাই!
জানি, তুমি মার্কিন পুঁজিবাদ আর কনসিউমারিজম আর ভোগবাদের গল্প শোনাবে। থাক সেসব কথা। বিক্রি হতেও আমরাও কম দেখলাম না! আমাকে সকালে সত্য পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নেওয়া খবরের কাগজের গোটা প্রথম পাতা জুড়ে ওই মার্কিন প্রভুর দেওয়া বিজ্ঞাপনই দেখি। তাই ওসব ছেড়ে শুধু এই চারটে শব্দ নিয়ে ভাবি, "ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর!" আবার সেই তিনটে হিন্দি শব্দ আর শেষ এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হলো ইংরাজিতে। 'মোর' শুধু এই শব্দটা তো আজকের পৃথিবীকে অন্য পথের সন্ধান দিয়েছে। এই 'মোর' এ জ্বরে তো আজও আমরা সবাই আক্রান্ত। দেশসেবক চায় 'মোর' টাকা, বাবা-মা চায় 'মোর' নম্বর, ছেলে-মেয়ে চায় 'মোর' গাড়ী, বয় ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, বউ চায় 'মোর' বিদেশ ভ্রমণ, স্বামী চায় 'মোর' সুন্দরী বউ যে কাজেও গৃহলক্ষী। তাই এই 'মোর' এ চক্রটা যে কত ভয়ঙ্কর আর কেমন করে এই চক্রে তোমার আমার মতো ছাপোষা কে একবার ঢুকিয়ে নেওয়া যায়, তাহলেই তো মুক্ত বাজারের তুমি দাস: টেবিলের তলায় হাত পাতা থেকে বিকালে বাড়ী ফিরে চাটাই পাতা সবই তো ওই 'মোর' এর চক্করেই। সবথেকে সাধারণ ভাবে জীবন কাটানো আদর্শবাদী মানুষটিকেও দেখি শেষ জীবনে এসে 'রীবক' এর জুতো পড়তে। তাই আর একবার আমাদের মতো করেই বলে নি না হয়, "ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর!"
ব্যক্তিগত ভাবে বিজ্ঞাপন সত্যিই আমায় এক নতুন জগতের সন্ধান দেয়। যতই কাটা-ছেঁড়া করি বিজ্ঞাপনে দেখানো জিনিস বা তার কার্যকরী গুন বা আরোও অনেক কিছু নিয়ে, আমার মনে হয় বিজ্ঞাপন হলো এক স্বপ্ন, যা দেখে যেতে হয় নিরন্তর, যার শেষ নেই, যার বাস্তবায়নের চেষ্টা 'ইউটোপিয়ান ওয়ার্ল্ড' এ পৌঁছানোর সমান। তবুও আমরা সেই জগতে থাকার চেষ্টা করে চলি কিছুক্ষণ হলেও।
৯৯ রান এ ব্যাট করছে ব্যাটসম্যান। বোলার ছুটে আসছে অন্য প্রান্ত থেকে। গ্যালারী তে মেয়েটা চকলেটের বার কামড়াচ্ছে। জানি, জানি!! আমায় আর কিছুই বলতে হবে না। এরপর ছবির মতো ভেসে উঠবে সেই বিখ্যাত ছয় আর তার পর মেয়েটির মাঠে নেমে পুলিশ কাকুকে কাটিয়ে মাঝ মাঠে সেই মন মাতানো নাচ।
'কুছ খাস হ্যায় হাম সভি মে/কুছ বাত হ্যায় হাম সভি মে'
'ক্যাডবেরি ডেইরি মিল্ক' চকলেটের এর থেকে ভালো বিজ্ঞাপন আমি এখনো দেখি নি। যদিও সত্যি বলছি, ওই চকলেট খেয়ে মেয়েটা নাচলো, না ছেলেটার ছয় মারায় নাচলো, না ছেলেটা ওই চকলেট খেয়ে ছয় মারল। ওসব বাদ দেওয়াই যায় শুধু এরকম সুন্দর শরীরে যৌবনের উদ্দীপনায় দেখানো নাচ যা শিহরণের লহর খেলিয়ে দিত আমাদের অনেকেরই মনে।
আর খুব বেশী নাম করে বা বাড়িয়ে লেখাটা তথ্যের ভান্ডার করতে চাই না।
** আমার শুধু ইচ্ছা ছিল যে আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে আমাদের পাশে-পাশে থাকা বা আমাদের সাথেই চলতে থাকা ছবি, শব্দ ও কথা গুলো ধরে রাখতে। তাই এই অপচেষ্টা। (যদিও এটা লেখার উদ্যোগ আমার মতোই সেই সময়ে পার করে আসা আর একজন মানুষের, যেও প্রায় আমার মতোই এই বিজ্ঞাপনের জগতে থাকতো এক সময়।)

23Feb2019


Comments

Popular Posts