নন-সেন্স কথামালা। (৭) **** না, এটা টু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন নয়। রাখ ফোনটা!

#নন-সেন্স কথামালা। (৭)



না, এটা টু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন নয়। রাখ ফোনটা!

৮২ সাল। দ্বিতীয় শ্রেণী। শুকুর প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। গ্রামের বাড়ীতেই থাকি। সকাল থেকে খেলে খেলে ক্লান্ত যখন ভাই আর আমি লক্ষী বাড়ীর চাতালে বসে আছি, বড়দি এসে বললো, 'যা দেখে আয় গিয়ে পিসিমার বাড়ী, কি এসেছে!' পিসির বাড়ী আমাদের এপাড়া-ওপাড়া। ঠিক ভাবে বললে একশ মিটার দূরে। লাফাতে লাফাতে ছুটলাম। গিয়ে দেখি সে এক বিরাট ব্যাপার। অনেক লোকজন বেশ উঠোন আর বারান্দা মিলে বসে আছে। আর একজন লোক পাঁচিলে তার হাতে আর একজন লোক অনেক যন্ত্র পাতি, দড়ি নিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে। ঢোকা মাত্র পিসিমা বলে উঠলো,
- আয়, দেখ! বাবার সাথে কথা বল। এবার সেজদা সব জানতে পারবে সারাদিন তুই কি করে বেড়াস!
গ্রাম থেকে সাড়ে তিন কিমি দূরের গঞ্জে বাবার ধানের আড়ত। বাবা সকালে যায় আর সন্ধ্যায় ফেরে। তাই এই সময়টুকু চলে আমার দৌরাত্ম। আর বাবার ওখানে পাশের হাই স্কুলে পিসির ছেলে দাদা পড়ে, হোস্টেলে থাকে যদিও দুপুরে খায় বাবার কাছে আড়তে। আমি তখন ভাবছি কি এমন হলো যে এবার বাবা সব জানতে পারবে। দেখালো পিসিমা। কালো রঙের ঢাউস এক ইঁটের মতো যার উপরে হাতল আর হাতলের মুখে ছোট বাটির মতো কিছু যাতে অনেক ফুঁটো আছে। সামনে গোল সাদা চাকতি যাতে এক থেকে নয় হয়ে শুন্য লেখা। পিসিমা দুটো সংখ্যা ডায়াল করে কিছুক্ষণ বাদে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো কথা বল। আমি তখন সেই হাতল নিয়ে কান আর মুখের প্রান্তে রেখেছি। কি রকম একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না। পিসিমা আবার বললো, কথা বল।
- বাবা!
-হুঁ, আমি বাবা বলছি। তুই কি করছিস?
- আমি পিসিমার বাড়িতে, তুমি কোথায়?
-আমি আবার কোথায় থাকবো, আমি তো আড়তে। এই নে দাদার সাথে কথা বল।
দাদা প্রথমেই বললো কি করছিস। আর আমি যখন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম তুই কি করছিস, তার উত্তর দিল যে ও চান করছে। কথা শেষ। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল সাহেবের কথা বলার যন্ত্রে মাত্র একশো বছর বাদ আমরা বাপ-বেটা আর ভাই-দাদা কথা বললাম বর্ধমান শহর থেকে পনের কিমি দূরে দুই গ্রামের বাড়ী থেকে। আমার আজও মনে পরে সেদিনের সেই হাটগোবিন্দপুর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ (যারা আবার পরবর্তী কালে আমার মামার বাড়ীতেই ভাড়া ছিল) অফিসের দুই প্রথম গ্রাহক আমার পিসেমশাই (শুকুর গ্রামে প্রথম) আর আমার বাবা (হাটগোবিন্দপুরে ব্যবসার বাড়ীতে) যে টেলিফোন দুটোর নম্বর ছিল: ২০ আর ২২। আর এর পাশেই পিসেমশায়ের রাইস মিলের নম্বর ছিল: ১৮। কথা বলে বাড়ী যেতে যেতে শুধুই ভাবছি, 'আচ্ছা, দাদা কি করে চান করছে বললো আর কথা বললো, আমি তো কথা বলার সময় বারান্দায় ফোনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ও কলাতলা থেকে কি করে কথা বললো!
আসলে, একটু বেশী আগেই অনেক কিছু ভেবে ফেলেছিলাম। বরাবরই ছোট থেকেই আমি বেশী পাকা, সবাই বলে আরকি।
আমার টেলিফোন দেখা আর সেই নিয়ে আমার, দাদার আর ভাইয়ের সব পরীক্ষা -নিরীক্ষা ছিলো এই ফোন গুলো নিয়েই। এমন নয় যে রোজ রোজ আমরা এসব কিছু করতে পারতাম, কিন্তু পুজোর দিন, ছুটির দিন আর অন্য কোন আত্মীয়রা যদি ফোন করতো তাহলে আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম কখন একবার আমাদের কথা বলতে দেবে।
এরপর আসতে আসতে এই টেলিফোন জিনিষটা বেশ ঘরের লোকের মতোই হয়ে গেল। যে আত্মীয়ের বাড়ী টেলিফোন ছিল তারা বেশ কেউ-কেটা গোছের মনে হতো। আর তাদের বাড়ী গেলেই আমাদের ছোটদের বেশ আকর্ষণের জিনিষ ছিল এই টেলিফোন নিয়ে খেলা।
টেলিফোন নিয়ে আদেখলাপনা আমাদের খুব একটা কম ছিল না। আমার আবার তার মধ্যে একটু বেশীই ছিল।
৯৫-৯৬ সাল।
বর্ধমান 'সংস্কৃতি' লোকমঞ্চে তখন সিনেমা শো শুরু করা হয়েছে। আমরা কয়েকজন সমস্ত কাজে দায়িত্বে। এখানে একটা টেলিফোন আছে। সেটা এমন কিছু নয়। সব অফিসেই থাকে। কিন্তু এর সাথে একটা কর্ড-লেস ফোন লাগানো আছে। সেটা হাতে নিয়ে চারিদিক ঘুরে বেড়ানো, সে গেট থেকে স্টেজ পর্যন্ত- তখন সেটাই বেশ লাগতো। যদিও লোকাল ফোন অবধি করার আমাদের কিছুই ছিল না। আবার খারাপ লাগতো আমাদেরই কয়েকজনকে দেখতাম প্রতিদিন নিয়ম করে গোটা কতক এস.টি.ডি কল ওখান থেকেই করতো।
৯৭-৯৯ সাল।
মাঝে মাঝেই ফোন করতাম স্বাতীদের বাড়ী তে, কানপুর থেকে। তবে সেটাও বেশ লজ্জারই ছিল, কারণ ফোন তুলে সাগর বলছি বললেই স্বাতীর কাকিমা বলতো, 'স্বাতী, তোমার সাগরের ফোন'। তবে এসটিডি বুথের লোকজন বেশ পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় কানপুরে আমাদের কারোর কাছে মোবাইল ছিলো না যেমন তেমনি সোমদত্ত প্লাজায় দু-একজনের হাতে মোবাইল দেখলে বেশ ক্যাবলার মতোই তাকিয়ে থাকতাম। আমার শ্বশুর মশাই সবসময়ই ফোন তুলেই বলতেন, 'হ্যাঁ, বলছি! আপনি কে বলছেন?' আমি কোনদিন 'হ্যালো' বলতে শুনি নি। আজও এই মোবাইলের যুগেই সেই একই কথা বলেন। আমরা অনেক বার বলেছি 'কে বলছে সে তো দেখছো!' তাতে ওনার কিছু এসে যায় না যদিও। আমি কিন্তু এই একটা ওনার থেকেই নিয়েছি, পরিচিত বা অপরিচিত কেউ ফোন করলে আমিও বলি, 'বলছি'। সেই সময় স্বাতীদের বাড়ীর ফোন নম্বর ছিল ৪৪২৬, যদিও পরে অনেকবার বদলে গেছে আর আমিও আর কোনটাই মনে রাখিনি।
৯৯ -০১
মিজোরাম যাবো যেদিন, সেদিন ভোর বেলার ট্রেনে বেরিয়ে গাংপুর পৌঁছে মনে পড়েছিল যে প্লেন এর টিকিট আনতে ভুলে গেছি। স্টেশনে নেমে স্বাতীদের বাড়ী ফোন করেই টিকিট আনতে হয়েছিল। মিজোরামের ফোন ছিল এক অদ্ভুত। এক্সচেঞ্জে গিয়ে বাড়ীতে ফোন করতে হতো এবং তারজন্য সেই লোকাল অপারেটরকে বেশ তেল দিতেই হতো। পরে আমাদের পরিচিত কিছু বাড়ী থেকে আমরা ফোন করতে পারতাম কোন ঝামেলা ছাড়াই। তবে তারজন্য বহুবার ডায়াল-রি ডায়াল করে যেতে হতো।
ফিরে এলাম ২০০১এ। আর নিজে মোবাইল কিনলাম ২০০৪ সালে। এরকম ভাবে শুধু কিছু দিন আর তারিখ দিয়ে আমার ফোনা-ফুনির গল্প শেষ তা নয় কিন্তু! অনেক অনেক ঘটনা আছে যার কিছু আজও মনের কোনায় রয়ে গেছে আর কিছু হারিয়ে গেছে। দেখি মনে করতে চেষ্টা করি।
* রাজ কলেজে পড়ার সময় এক নামকরা বাড়ীর নামকরা সুন্দরী আমাদের গ্রূপে একসাথে আড্ডা মারতো। সব সময়ই আমাদের সাথে থাকতো। সে তাদের বাড়ীর ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিল, যখন দরকার ফোন করতে। একদিন কি এক দরকারে সবাই পার্কে আড্ডা মারতে যাবো, সে আসেনি। কলেজের পাশেই এসটিডি বুথ থেকে একজন ফোন করলো। এদিক থেকে হ্যালো বলে কিছু বলার আগেই দেখলাম সে ফোন রেখে দিলো। কি হলো জিজ্ঞাসা করায় কিছু বললো না। আর একজন করলো, একই অবস্থা। শেষে আমি বললাম, 'ধুর, কি হলো? কি বললো? ফোনটা কেটে দিচ্ছিস কেন? *রা, পয়সা লাগছে না!' ওরা বললো 'তুই কর'। করলাম।
- হ্যালো!
ওপাশ থেকে একজন মহিলা ভারীগলায় বললো:
-- কিরে! * ঠাঁর বাচ্ছা! ফোন রাখ না হলে পুলিশ ডাকবো!
মানে! কিছু বোঝার আগেই ফোন রেখে দিলাম। তিনজনের ছ-টাকা বুথে মিটিয়ে এসে বাইরে এসে বুঝলাম তিনজনেই ওই একই গালাগাল খেয়েছি। কেন? সে সব গল্প পরে হবে। কিছুদিন ওই বান্ধবী আর কলেজ আসেনি, আর পরীক্ষা দিতে এলো যখন তখন দেখলাম বিয়ে হয়েছে।
** এটা আমার নয়, আমার পরিচিত জনের। আড্ডায় আমাদের এক দাদার অফিসে ফোন ছিল। খোলাই থাকতো। দু-একজন একটা, দুটো ফোন করলেও সে ছিল মাস্টার পিস। ফোন তখন তাকে করতেই হতো এবং সেটা ঘন্টার পর ঘন্টা। কারণ নিশ্চই বোঝা যাচ্ছে। তার সত্যি ফোনের কথা:
- আই লাভ ইউ।
-- আই লাভ ইউ টু।
- ধুর, আই লাভ ইউ টু, থ্রি, ফোর... আর সব।
তা, যাইহোক তার এই ভাটের গল্পের ঠেলায় সেই দাদা এবার ফোনে চাবি দিল। চাবি দেবার পরের মাসে বিল আরো বেড়ে গেল। বলেছিলাম না, মাস্টারপিস ছেলে। শেষ কালে জয়নালদা দেখলো এ ফোন আর রেখে কাজ নেই। দিল, লাইনটা কেটে। জয়নালদা নামটাই শুধু বললাম, আর বাকিদের নাম জেনে কাজ কি! কিন্তু সেই মাস্টারপিসের সেই ক্যারিশমা আজও আমরা জানি না। তবে তখন থেকেই ঠেকের সবাই বুঝেছিল, 'এ যন্ত্র ছেলে'। আর আমরা বন্ধুরা বুঝেছিলাম, 'যন্ত্র ওর দাস!' আজও তাই।
*** একবার আমি, বোন, স্বাতী সবাই মিলে বাড়িতে বসে আছি। একটা ভুল-ভাল ফোন দু-তিনবার এসে বিরক্ত করছে। শেষবার আমি ধরলাম। ফোনের ওপার থেকে প্রথম শুনলাম কেউ বলছে, 'এই নিন ধরুন'। আমি তো ধরেই আছি! যা বাবা! একজন মাঝ-বয়সী ভদ্র মহিলা কথা শুরু করলেন
- এটা নাসির নাকি!
-- না, নাসির নয়।
- ও! বিলাল নাকি! নাসির কুতা?
-- নাসির নেই, আপনি ভুল জায়গায় ফোন করেছেন?
- এটা কুথায় লেগেছে?
একটু মজা করার ইচ্ছা হলো। বলেই দিলাম,
-- এটা পাকিস্তান!
আর আমায় কিছু না বলে, ফোন না রেখেই পাশের লোকের উপর চিল্লাতে লাগলো,
- এই দেখো কেনে, পাকিস্তান লাগলো কি করে! কি যে করো! নাসির তো দিল্লীতে থাকে!
আর বেশীক্ষণ শোনার ইচ্ছা হোল না। রেখে দিলাম। তবে ওই ফোন আর আসে নি।
**** আর একবার আমাদের বাড়ীর ফোনটাতে রাত-দুপুর-সকাল প্রায় সবসময় একজন ফোন করতো আর বলতো, 'চ্যাটার্জী দা, মালটা পাঠিয়ে দেবেন কিন্তু সময়মতো।' আমরা কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দিত। একদিন আমি ফোন ধরেছি। যথারীতি সেই এককথা। আমি হাফ শুনেই শুরু করলাম,
- ধুর মশাই! আপনাকে আর মাল পাঠানো যাবে না!
-- কেন? কি হলো?
- আপনার পেমেন্ট ঠিক নেই!
-- কেন? আমি তো রতন কে দিয়ে প্রত্যেক সপ্তাহে টাকা পাঠাই। এই রবিবারও আপনাকে পঞ্চাশ হাজার দিয়েছি!
- না। আমি শেষ একমাস কোনো টাকা পাই নি। আর রতন তো আমার কাছে আসেই নি অনেকদিন।
-- কি বলছেন? এটা কি করে হয়! (পাশে, এই রতন)
- কি করে হয় আপনি দেখুন, আমায় আর জ্বালাবেন না। রাখলাম আমি। এবার থেকে মাল লাগলে নিজে টাকা নিয়ে আসবেন।
কেটে দিলাম। ভাবলাম আপদ গেল! ওমা! আধঘন্টা বাদে আবার ফোন।
-- হেঁ হেঁ! চ্যাটার্জী দা, রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি যাবো সামনের সপ্তাহে আপনার সাথে দেখা করতে। আপনি শুধু এবারের মালটা পাঠিয়ে দিন।
ভেবে দেখলাম এর সাথে আর কথা বলে লাভ নেই। বললাম, 'আচ্ছা পাঠিয়ে দেবো।' তবে সেদিনের পর এই ফোনটা আসাও বন্ধ হলো।
** ক্রস কানেকশন এর গল্প তো সবারই শোনা আছে। সবাই আমরা এরকম অনেক বার শুনেছি জীবনে। তবে আমার জীবনে এমন এক ক্রস-কানেকশনে দুজন মানুষের কথোপকথন শুনেছি যারা দুজনেই আমার পরিচিত। কেমন অলৌকিক ভাবেই হয়েছিল সেদিন। আমি তাদেরই কোন একজনকে ফোন করবো ভেবে তার নম্বর ডায়াল করার পরই শুনতে পেলাম সে আর একজনের সাথে কথা বলছে এবং বেশ কিছুক্ষণ পর তারা আমার সম্পর্কেই কথা বলে চলেছে। অনেক কিছু জেনেছি, অনেক কিছু শিখেছি সেদিনের সেই ক্রস কানেকশনের ফোন থেকে। সব থেকে বড় কথা, মানুষ চিনেছি।
আমাদের বাড়ীর একবার ফোন নম্বর ছিল, ৫৫৯১১. পরে সেটা ২৫৫৯১১ যখন হলো তখন আমার মোবাইল নম্বরের শেষ তিনটে সংখ্যা কিন্তু ৯১১। যদিও সেই মোবাইল নম্বর আর সেই ল্যান্ড লাইন আর নেই। এর পরেও আমি আবার ল্যান্ড লাইন নিয়েছিলাম যার নম্বর ২৬৫৭২৫৬, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেন যে এই লাইনটা আজও আমাদের চালু কিন্তু ১৮ সালের জানুয়ারী মাসের পর থেকে আর এতে কোন আওয়াজ নেই। কমপ্লেন, হরলিক্স, বৌনভিটা সব করেও কিছু হয়নি, আর আমিও লাইনটা কেটে দিইনি। দেখা যাক, কি হয়!

(14.5.2019)

Comments

Popular Posts