সব চরিত্র কাল্পনিক নয়। (২) / রঞ্জাবতী কে লেখা অনিকেতের খোলা চিঠি। (পত্র: দুই)

সব চরিত্র কাল্পনিক নয়। (২)


রঞ্জাবতী কে লেখা অনিকেতের খোলা চিঠি। (পত্র: দুই)





রঞ্জাবতী,
তোর শান্তিনিকেতনে বাড়ী করার ব্যাপারটা আমায় বেশ ভাবাচ্ছে। জানি, কল্প-কলা (বিজ্ঞান নয়)। কিন্তু, তাও ব্যাপারটা ভেবে বেশ ভালোই লাগছে। কিরকম মনে হচ্ছে জানিস তো? এমন নয় যে তুই এসে শান্তিনিকেতনে থাকবি। কিন্তু, একবার এসে বলছিলিস, বা হয়তো বলিসনি, কে জানে! আসলে এতরকম বলিস যে কি বুঝতে কি বুঝি কে জানে! আচ্ছা যদি বলে থাকিস, তাহলে কিরকম হবে জানিস? তোর বেশ একটা ছোট বাড়ী, দুটো ছোটো ঘর, একটা বারান্দা, ছোট রান্না ঘর, একটা ওয়াশ রুম, বাইরে ছোট্ট একটা বাগান, বাগানে একটা কুয়ো। বাইক রাখার একটু টিনের শেড, বড় কিছু নয়, কারণ গাড়ীর প্রয়োজন কখনোই হবে না। একটা ঘরে তুই প্রচুর বই কিনে ভর্তি করে রাখবি, দিনের পর দিন বই কিনে কিনে জমিয়ে রাখবি। ওই ঘরে হলুদ পর্দাই রাখবি আর একটা ছোট তক্তা রাখবি। একটা ফ্যান, একটাই টিউব লাইট। বিছানার চাদরও হলুদ কটকি। আর অন্য তোর শোবার ঘরটায় বাকি সব কিছু থাকবে, মডার্ন ইকুইপেমেন্টস সমস্ত কিছু, এ. সি, ওটার সাথে আলাদা বাথরুমও। রান্না ঘরে একদম মিনিমাম জিনিস, কিন্তু যেগুলো দরকার সেগুলো থাকবে। বাড়ীটায় সব কিছু থাকবে, কিন্তু কখনোই সেগুলো চলবে না। যেমন ধর, একটা বড় টি.ভি সাথে ডিস, কিন্তু ধূলো এমন পড়ে থাকবে যে বোঝা যাবে চলে না। এবার বারান্দায় শুধু বসার একটু ব্যবস্থা আর বাগানে একটা বা দুটো বড় গাছ (একটা আম, আর একটা জাম, ঢঙের সাজানো কোন ফুল বাগান থাকবে না, কারন দেখা বা যত্ন করার কোন সময়ই তোর নেই, আর আমিও দেখবো না।) তুই এখানেই একটা চাকরী নে। কিসে নিবি, সেটা পরে বসে ঠিক করা যাবে। যদি চাকরী নিস, তাহলে সারাদিন কাজের পর ওখানে অনেক ছেলে মেয়ে আছে তাদের নিয়ে থাকবি, তোর তো আরো অন্য কিছু করার ইচ্ছা আছে, সেগুলো করবি, আর না হলে তোর পড়ার অখণ্ড সময়। এটা গেল তোর ব্যাপার। আমি কি করবো। আমি তো থাকবো না তোর সাথে সব সময়। সেটার দরকারও নেই। কারন তাহলে তুইও বিরক্ত হবি আর আমিও। আমি যবে মন হবে যাবো, যতদিন মন হবে থাকবো, আমায় কোনো ভাবেই যেন কেউ বিরক্ত না করে, আমি কোনো ফোন নিয়ে যাবো না। আমি সারাদিন তোর ভালো ভালো করা রান্না খাবো, বই পড়বো, একা একা মদ খাবো, ঘুমোবো, আর কি! আমার কোনো বন্ধু কে আমার ওখানে দরকার নেই। তুই সময় পেলে বসবি, গল্প করবো। তোর সময় না হলেও আমি কিছু বলবো না। আমি আমার মতো যাবো, থাকবো, খাবো, পড়বো। এবার প্রশ্ন হলো তুই কেন এই প্রস্তাবে মত দিবি…?
তোদের ভবিষৎ প্ল্যান তো এদিকে চলে আসা। জানি, জানি, তোর ওই 'কার্তিক' না কি যেন দিল্লী, মুম্বাই এইসব যে কোনো জায়গায় চাকরী পাবে, আর করবেও সেখানেই। ঠিক আছে, তখন না হয় তুই এখানে এরকম একটা ব্যবস্থা করলি নিজের জন্য। আমি করতে পারবো না আমি জানি। কিন্তু আমি চাই আমার কেউ এরকম করুক আর আমি সেটা নিজের মতো করে থাকবো। না, আমার কাওকে বলার দরকার নেই। কিন্তু আমার বেশ ইচ্ছা এটা। ধর, তোর গ্রীষ্মের ছুটি পড়লো, আমি বেশ পাঁচ দিন ওখানে যাবো। যাবার সময় কিছুই নিয়ে যাবো না। কলকাতা থেকে ট্রেনে উঠবো আর তিন ঘন্টায় ওখানে নেমে পৌঁছে যাবো। বই তোর ওখানেই আছে, তুই শেষ তিনমাস আমার না যাওয়ার সময়ে অনেক বই, ম্যাগাজিন কিনে রেখেছিস, সেগুলো শেষ করবো, তারপর আসবো। আর আমার যেটুকু মদ দরকার পড়বে, সেটা তো আগের বারই রাখা আছে যা তাতেই হবে। ফুরিয়ে গেলে আর লাগবে না এবার। বাজার, হাট, মাংস, মাছ, সবজি সব তুই কিনে আনবি, রান্না করবি, আর আমার সাথে বকবক করবি যখন মন হবে। তোর সাথে কি রকম চাকর বাকর এর মতো ব্যবহার করছি!! মোটেই এরকম নয়, দু একবার হলে, তুইও বুঝে যাবি আমার কোনো চাহিদা নেই। তাহলে এগুলো এতক্ষণ ধরে কি বলছিলাম তোর সাথে। আসলে আমি তোকে আর আমাকে একটা অন্য পার্সপেক্টিভে ভাবছিলাম। আর সেই ভাবনাটা ভাবতে ভালো লাগছে, মানে ওই সময়টায় আমি থাকতে পছন্দ করছি।
এবার কিছু পার্থিব জগতে আসি। কে তোর (তোর থেকে বেশী আমার!) ওই স্বপ্নের বাড়ী তৈরী করবে। কেন, আমি আছি। আমি মন প্রাণ দিয়ে করবো, কিন্তু আমি আটকে যাবো তো একটাই জায়গায়। সেটা হলো টাকা। সেটার জন্য তুই আছিস। তবে আমি এটা বলতে পারি, সব থেকে কম খরচে এটা শেষ করবো। কোনো হাই-ফাই বাড়ীর দরকার নেই, শুধু একটা জায়গা। এবার কথা হলো তুই কেন আমার জন্য তোর টাকা খরচ করবি? করবি, কারন আমার মন হচ্ছে, তাই করবি। আমার কাছে তো তোর কিছু পাওয়ার নেই, তাই আমি তোকে কক্ষনো (বেশী এক্সপ্রেশন হচ্ছে, ওটা কখনো হলেই ভালো) ছেড়ে যাবো না, সেটা তোর দরকার থাক আর না থাক।
আচ্ছা এরম তো হতে পারে। অনির্বান না হয় শান্তিনিকেতনেই চলে এলো । তখন তো তোরা এসে থাকতেই পারিস। আমার সাথে ওর খুব ভালো কিছু বন্ধুত্ব হবে না, এটা আমি জানি, তবে আমার এই মাঝে মাঝে যাওয়াতে ও খুব ঝামেলা কিছু করবে না। ওটা ও পাত্তাই দেবে না, কে অনি এলো না গেল। রু এর (ওই নামেই তোকে ডাকে, তাই তো!) আর এক নতুন খেয়াল মনে করে পাত্তা দেবে না। বলে দেখিস না, কি বলে। এখন থেকেও ওর কাজ সব হয়ে যাবে। বিদেশ, পেপার, রিসার্চ সবই হয়ে যাবে। আর মন না হলে না হয় অন্য কোথাও থাকবে।
ধুর অনেকক্ষন ফালতু বকছি।
আজ কতদিন বাদ তোকে মেইল লিখতে বসলাম, দিয়ে যত আজে বাজে বকে যাচ্ছি।
শোন, বাড়ীটা কিন্তু একতলায় হবে, গরম যতই করুক, আমার ঘর টায় শুধু ফ্যানই থাকবে। আমি অব্যশই গ্রীষ্ম ও বর্ষা তে যাবো। বাকি সময় জানি না কবে কখন যাবো। আমার যখন মন যাবো। আমার সাথে কেউ যাবে না এটা আমি বলতে পারি। আর মেলা আর দোল এর সময় তুই ও থাকবি না, ওই সময় তুই কলকাতা তে এসে থাকবি। প্রচুর বই কিনে ঘর ভর্তি করে রাখবি। আমায় ঘুম থেকে উঠে থেকে যেন কেউ কোনো কিছুতে বিরক্ত না করে, আমার মন হলে আমি লিকার চা খাবো, আর মন হলে মদ খাবো। একটা কম দামী চেয়ার যাতে বসে বা একটু শুয়ে বই পড়া যায় সেরকম একটা ব্যবস্থা রাখবি। একটা মাথা বালিশ, একটা পা বালিশ আর দুটো কুশন রাখিস ঘর টায়। একটু মেঝে যেন থাকো। মেঝে তে শুতে পারি যেন মন হলে। এই ঘরের মেঝেটা সিমেন্ট এর হলেও চলবে। কিন্তু অন্য আর একটা ঘর তোদের যেটা, বা তোর যেটা সেটা মার্বেল এর হবে। ছাদ টায় বর্ষাতে যাতে বসতে পারি তার জন্য ব্যবস্থা থাকবে। তুই শাড়ী পড়তে ভালোবাসিস, তাইই পড়িস। ওয়েস্টার্ন না পড়লেই ভালো। আচ্ছা থাক, তোর উপর এতো জোর খাটাবো কেন, তোর যা মন তাই করবি, তাই পড়বি। আচ্ছা, রান্না বাজার করতে তোর খুব অসুবিধা হবে না মনে হয়। কারন তুই খুব বেশী খাস না, আর আমার যা হোক হলেই হবে। তবে মাঝে মাঝে একটু চিকেন ভাজা হলে ভালো হয়, না হলেও কিছু নয়। তোর যা খেতে পছন্দ তাই করবি আমার তাতেই চলবে। আচ্ছা এই পর্ব টা যাক। যেমন ভালো মনে হয় তেমনই করবি। তবে তুই এমন কাজ করবি যাতে তুই মাঝে মাঝে বিদেশে যেতে পারিস এক-দু মাস এর জন্য। আর আসবি যখন তখন আমার জন্য দুটো করে ভালো স্কচ নিয়ে আসবি। জানি একটার পর একটা বোঝা চাপছে তোর উপর। বেশ করছি। স্বপ্ন দেখছি যখন তখন ভালো করেই দেখবো।
আচ্ছা যদি শান্তিনিকেতনে না থেকে তুই কলকাতায় থাকিস, তাহলে আমার খুব কি অসুবিধা হবে। একটু হবে। তোর ওই পাকা দাদুটা না থাকলেই বা, তোর খুড়তুতো ভাই থাকলে আমার এসব মন-মানি চলবে না। তাই আমি যাবো না। যদি তুই তোদের ওই নাগের বাজার এর বাড়িতে এসে থাকিস তাহলেও আমি যাবো না। কারন আমার ওই বাড়িতে তোর কাছে গিয়ে মাঝে মাঝে থাকতে কেমন লাগবে। কে কি বলবে, সেটা নয়। সেই সব ভেবেই শান্তিনিকেতন টাই ভালো।
স্বপ্ন, চাওয়া, অলীক ভাবনা যাই হোক, এটাই আমার পছন্দ, পেলে এটাই চাই। কোনো অংশই কম করে নয়, যেমন করে লিখলাম তেমন করেই চাই।
"হওয়ায় মিলিয়ে যাক ভাবনারা,
থাকি, আমিই থাকি না হয় ভাবনায়।
তোমায় চাই, কে বললো…?
চাইনি তো, বলেছি।
চাই কিনা, সে তো তুমি জানো।"
অনিকেত
(পুরো নাম লিখলাম, অনেক দিন লিখিনি)
**চিঠির শেষে কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা আমি লিখেই থাকি। আসলে প্রায় একমাস আগে যখন অনিকেতের প্রথম চিঠিটা প্রকাশ করেছিলাম তখনই অনেকে ওর সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আমার কাছে। বলছি, বলবো, দেখি কবে সময় হয়, এইসব বলছিলাম। কাল বিকালে এক্সাইড মোড়ে বাস ধরবো বলে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক তখনই পাশ দিয়ে দু তিনটে ছেলে মেয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে। কল-কল করে প্রচুর কথা বলছে বাংলা-ইংরাজী মিশিয়ে। ওর মাঝে একটা ছেলে চুপ করে হেঁটে যাচ্ছে, কারোর দিকে না তাকিয়েই হাঁটছে। অনেকদিনের না-কাচা জিন্সের প্যান্ট, কালো রঙের গেঞ্জি, বুকের কাছে হিজি-বিজি ছবি আঁকা, গালে কয়েক দিনের না কাটা দাড়ি, কাঁধে কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ, পায়ে সস্তার চপ্পল কিন্তু মুখটা কি অদ্ভুত শান্তি মাখানো সরল। আমি দেখেই চিনেছি। পেরিয়ে যাবার পরই ডেকে উঠলাম, এই অনি! ভালো আছিস? রঞ্জার খবর কি? মুখ ফিরিয়ে পিছন দিকে আমার মুখের দিকে তাকাল। তারপর কেমন যেন অচেনা মানুষের মতো তাকিয়ে রইলো। সঙ্গের ছেলে মেয়ে গুলো একটু এগিয়ে গিয়েছিলো। ও আবার আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কিছু না বলেই মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তারপর ফ্লাইওভারের ঠিক নীচে টায় যেখান থেকে নন্দনের দিকে বেঁকে যায় ওখান থেকে ও মিলিয়ে গেল। দিনের বেলায় এত লোকের মাঝে একটা জল জ্যান্ত ছেলে হওয়ায় মিলিয়ে গেল। ওর সঙ্গের ছেলে মেয়ে গুলোকেও আর দেখতে পেলাম না। হয় নাকি এরকম। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমি যেন ওকে হারিয়ে ফেললাম। বাড়ী এসে সারারাত ওদের সব চিঠি মেইল আবার নতুন করে পড়তে শুরু করলাম। তারপরই মনে হল, না!এরকম হতে পারে না। কিছুতেই হারিয়ে যেতে পারে না ওরা এভাবে। তাই আবার অনির চিঠি নিয়ে বসলাম। দুজনের বাক্তিগত চিঠি, মেইল, চ্যাট, মেসেজ সবই যখন প্রকাশ করছি তখন আমার সাথে ওদের যোগাযোগ যেমন আগের বার জানিয়েছি, ঠিক তেমনই এবার ওদের দুজনকে নিয়ে কিছু ভূমিকা করবো। এর আগে আমি এমন ভাব করেছি যেন পৃথিবী শুদ্ধু মানুষজন ওদেরকে চেনে। ওদের চিঠি দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। না, সেরকম কিছু নয়। তবে ওদের মতো অনেক চরিত্ররাই আমাদের আশেপাশে বাস করে, ঘুরে বেড়ায়, গল্প করে আর তারপর সময়ের সাথে সাথে মিলিয়ে যায়। আমি 'অন লুকার' যে আজও কিছুটা হলেও খোঁজ রাখি ওদের। চিনলাম কেমন করে ওদেরকে? সে কথা পরে হবে না হয়। কারা ওই দুজন? দেখা যাক না, শেষ হয় কেমন করে এই পর্বগুলো। 'সিমুলাকরা' তে আক্রান্ত এক থার্ড পার্সন আর তার চরিত্রদের কিছু বাস্তব, কিছু অতি-বাস্তব আর কিছু না হয় পরা-বাস্তবের মধ্যে দেখা হয়ে যাক কোথাও না কোথাও!
এইটুকু ভূমিকা, যা না করলেই নয়।।
রঞ্জাবতী। রঞ্জু, দাদুর দেওয়া নাম। দাদুই ছোট করে ডাকা শুরু করেছে। বলেছে, সবাই তোকে রঞ্জাবতী বলে ডাকবে কেন? তারপর থেকে মা, বাবা, কাকাই কারুর সাহসই হয় না এবাড়ীতে ওকে আর রঞ্জাবতী বলে ডাকার। তাই ছোট থেকেই ও সবার কাছে রঞ্জু আর দাদুর কাছে রঞ্জাবতী।দাদুর কথার উপরে কথা বলার সাহস এই চ্যাটার্জী বাড়িতে যেমন কারোর নেই, ঠিক তেমনি এই নাগের বাজার ১এর বি বাই লেন পাড়াতেও নেই। ঠিক সাহস নয়, দাদুর উপর পাড়ার সবার কেমন যেন এক সম্মান মেশানো ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর ভয় কাজ করে। আর এর সাথে যোগ হয় দাদুর সবার সাথে বন্ধুর মতো মেশা। তার দাদু রিটিয়ার্ড জজ, যদিও দাদু বলে, জজগিরি ছাড়ার পর আমার নতুন জন্ম হয়েছে। এখন সকাল থেকে দাদুর বৈঠখানায় আসর জমায় দাদুর বন্ধুরা, দুপুরে দাদু গল্প বইয়ে ডুবে থাকে আর বিকালে দাদু আসর জমায় কাকাইদের ফুটবল মাঠের পাশে ক্লাবে। পাড়ার বুড়ো থেকে বাবাদের গ্রুপ হয়ে কাকাইদের গ্রুপ-সর্বত্র দাদুর অবাধ বিচরণ। এরকম এক মানুষ যাকে সবাই মানে, ভালোবাসে, ভয় করে, তাকে তুমি কখনোই অবজ্ঞা করতেই পারবে না। রঞ্জু তো কখনোই করে না। বরঞ্চ কাকাই এর পর ওর সব থেকে কাছের বন্ধু
দাদুই। সেই ছোটবেলা থেকেই ও দাদুর খুব কাছের। দাদু বলে, "এ আমার তরোয়াল চালানো মেয়ে রে, রঞ্জন। তোদের দিয়ে তো কিছুই হলো না, একেই আমি যুদ্ধে পাঠাবো "।
না, দাদু ওকে কখনো যুদ্ধে পাঠাবে এরকম বলে না। শুধু বলে, "মা, যুদ্ধ তো প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন, প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটা বাঁকে। তোমায় যেন সেখানে কাওকে লাগে না। তোমার সব যুদ্ধ যেন তুমি নিজেই করবে। না বাবা, না কাকাই, না বন্ধু, কারোর দরকার থাকে না যেন তোমার যুদ্ধে, তুমি না আমার রঞ্জাবতী।"
দাদুর কথা বলতে শুরু করলে শেষ হবে না। আর তাই তো ওর বন্ধু বান্ধবী থেকে পাড়ার অটো কাকু পর্যন্ত জানে দাদু রঞ্জার কি।
শুধু একজন। এই একজনকে নিয়ে আর পারে না রঞ্জা। সেই ছোটবেলা থেকেই ওর সাথে পেরে ওঠে না কিছুতেই। ওর সব কাজে ঝামেলা পাকানো, সব জায়গায় ওকে ছোট করা, সব থেকে বড় কথা পাড়ায় প্রতিটা কাজে, প্রতিটা অনুষ্ঠানে, সব কিছুতেই ও দাদুকে অবজ্ঞা করে। কিছুতেই যেন দাদুকে সহ্য করতে পারে না। অথচ যেদিন বিপ্লব কাকু মা-মড়া একদিনের ছেলেকে নিয়ে নার্সিং হোম থেকে বাড়ী ফিরলো, দাদুই হাতে তুলে নিয়ে বলেছিলো, "বিপ্লব, এ ছেলের নাম দিস 'অনিকেত', আর অন্য কারোর কাছে দিয়ে আসিস না একে, পাড়ায় আমাদের সাথেই রাখিস।" বিপ্লব কাকু তখন বদলির চাকরী- এ রাজ্য, ও শহর করে বেড়াচ্ছে। মা-হারানো ছেলেকে নিয়ে পড়েছিলো খুবই সমস্যায়। দাদু সব দিক দিয়ে সামলে রেখেছিল- সে অফিসের বস কে চিঠি লিখে বিপ্লব কাকুর বদলি আটকানো পর্যন্ত। সেই অনিকেত। অনি। পাড়ার সবার কাছে অনি। শুধু রঞ্জু ওকে অনেক রকম নাম ডাকে- ভালো মন থাকলে অনিকেত বা অনি, রেগে গেলে 'অনে' কখনো বা 'হনে', আর সেটাও আবার মাঝে মাঝে হয় 'হনু'। আর ও নিজেকে কোথাও 'অনিকেত' বলে না। রঞ্জু কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলে, "ওই বুড়োটার ভীমরতি ধরেছিল, আমার নাম দেবার সময়! তা না হলে বিপ্লব আর সুধাময়ীর ছেলের নাম কি করে অনিকেত দেয়! রঞ্জা হেসে জিজ্ঞাসা করতো, "তাহলে কি নাম দিলে ভালো হতো, বিপ্লবসুধা?"
-"দ্যাখ! যা বুঝিস না সেই নিয়ে কথা বলতে আসিস না।"
আমি হলাম বিহঙ্গ
জন্মের পর থেকেই মুক্ত বিহঙ্গ
জন্মের পরেই মা বাড়ী না এসে প্রথমেই কেটে পড়লো, আর বাবা পাড়ার লোকের কাছে গছিয়ে চাকরী করে সারাজীবন কাটালো। আর এখন চাকরী থেকে রিটায়ার্ড করে এসে কিনা আমায় বলে,
"নে, এবার তোর সংসার তুই সামলা। আমি তো এতদিন চালালাম।"
তুমি আবার কবে শা.. সংসার চালালে?
হ্যাঁ, টাকা তুমি অব্যশই দিতে। তবে সেটা প্রথমে কাজের লোককে দিতে আর পরে আমায় দিতে, যখন দেখলে আশাদি মাঝে মাঝেই ঝাড়ছে। সে তো ওই বাড়ীর বুড়োটাও মাঝে মাঝে ভীমরতি হলে আমায় ডেকে নিয়ে দিতো। ছোটবেলায় দু একবার নিয়েছি বটে! পরে দেখলাম, ধুর, বা..,তুমি কে হে, তোমার কাছে টাকা নেবো কেন? ভামটা আবার কথায় কথায় প্রচুর জ্ঞ্যান দিতো। এখন তো মালটা টেঁশে গেছে, মানে ওই আরকি। বাড়ী থেকে বেরোয় না। আগে দেখোনি মালকে! উরিতারা! কি রয়াল সব ব্যাপার! যাক সেসব কথা পরে বলা যাবে। আজ এই থাক।
**ক্রমশ বলবো না, তবে মন হলে আবার কোন একদিন অন্য কোন চিঠি নিয়ে হাজির হবো।
12/03/2019

Comments

Popular Posts