ধন্যবাদ বর্ণীলা তোমায়, আমার ‘টাইটাস’ দেখানোর জন্য ।















১৪ টা হত্যা (যার মধ্যে স্টেজে ৯ টা), ১ টা রেপ (২ -৩ টে না দেখা), ৬ জনের জীবন ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া, ১টা জীবন্ত কবর দেওয়া, ১ জনের পাগলামো বা অতি-বাতুলতা, ১ বার নরমাংস ভক্ষণ, ১ জন হাতকাটা, জিভ উপড়ে নেওয়া মহিলার মাঝে মাঝেই আর্ত চীৎকার, ভয়ানয় পশুদের ডাক ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড এ অর্ধেকের বেশী সময় জুড়ে, - নৃশংসতার চূড়ান্ত ( আধুনিক স্কেল এ যার মাপ হয় ৫.২ প্রতি অঙ্কে/ বা প্রতি ৯৭ লাইনে একবার/ বা বমি পাবার মাত্রায় ৯৪) রক্তক্ষরণে প্রতিপদে সবাইকে পিছনে ফেলে ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনে আজ থেকে কত শতাব্দী আগে (১৫৮৮-৯৩ এর মাঝামাঝি কোন এক সময়ে) আমাদের সামনে এনে হাজির করিয়েছিল, যাকে একসময় ভিক্টোরিয়ান যুগের দর্শকরাও স্টেজ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল এই ভয়ঙ্কর হত্যালীলা আর অত রক্ত চোখের সামনে সহ্য করতে না পেরে - হ্যাঁ আমি ‘আনড্রোনিকাস’ এর গল্প বলছি। শেক্সপীয়ার এর ' টাইটাস আনড্রোনিকাস' এর গল্প বলছি। তা, ওই রানী ভিক্টরিয়ার লোকজন নরম মনের মানুষ হতে পারে, আমরা তো আর নই! আমরা যেখানে এখন কথায়-কথায় প্রভাস বা মহেশ বাবু র প্রতিটা অ্যাকশন দৃশ্যে গোটা কুড়ি লোকের মাথা উড়িয়ে দেওয়া, তলোয়ার হোক আর চপার হোক, বা নিদেনপক্ষে ছোট ছুড়ি দিয়ে গলার নলি কেটে দিয়ে গল গল করে টম্যাটো সস এর মতো রক্ত পড়া দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, (আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আচ্ছা এই যে সিনেমায় নায়করা এতো মারে, সে হাত বা অস্ত্র যা দিয়েই হোক, লোকগুলো যে উড়ে গিয়ে পড়ে যায়, তাদের তারপর কি হয়! না, না, সত্যিতে বলছি না। অভিনয়েতেই বলছি। মরা কি এতো সহজ! আবার তো উঠতে হবে। কে জানে বাবা, ডিরেক্টর কি ভেবে কি দেখায়! হয়তো পয়সা আর সময় দুটোই কম! এককাজ করলে পারে, পাঁচ মিনিটে কুড়ি থেকে চল্লিশ জন কে না মেরে, পাঁচ মিনিটে তিন জন ভিলেন এর চামচাকে মারতে পারে। তাহলে বেশ ঠিক ঠাক ভাবে দেখাতে পারে। অনেক ভেবেছি এটা নিয়ে। উঁহু, পারবে না। তাইতো আমরা দেখি আর ভুলে যাই দেখার পরই।) সেখানে 'টাইটাস' আর আমাদের নতুন করে কি ভয় দেখাবে, কি কষ্ট দেবে, বা কি ভাবেই বা বমি পাওয়াবে!
'টাইটাস' পড়ার কথা আমি এখানে বলছি না। সে তোমরা তোমাদের নিজেদের সুযোগমতো পড়ে নেবে। আর শেক্সপীয়ার পরে উদ্ধার করতে সময় লাগলে নিদেনপক্ষে গুগলদার কাছে অনেক রেডি নোটস আছে, সেগুলো দেখে নিও। আমাদের তো বাধ্যতামূলক ভাবেই পড়তে হয়েছে পরীক্ষায় নম্বর পাবার জন্য। তবুও বলি, সেই সময়, সেই বয়সে পড়া, নোটস এর চাপে চরিত্রের স্তর খোঁজার সময় হয়ে ওঠেনি, গল্পের নারকীয়তা বোঝবার আগেই হয়তো কিছু সামাজিক প্রেক্ষাপট মুখস্ত বা কি করে এটি একটি ট্রাজিডি তার পয়েন্ট মুখস্ত করতেই চলে গিয়েছিল। আজ এই মধ্যবয়সে আবার 'টাইটাস' এর কাছে ফিরে গিয়ে নতুন করে বুঝলাম, জীবন কি।
আসলে এমন কিছু নয় যে আমি এই বয়সে এসে আবার নতুন করে শেক্সপীয়ার পড়া শুরু করেছি। এবার পুজোর সময় ব্যাস্ততা আমার প্রায় কিছুই ছিল না। তাই কয়েকটা শারদীয়া পুজো সংখ্যা শেষ করে আর কিছু উল্টো-পাল্টা, হাবি-জাবি সিনেমা দেখে কাটাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে একদিন একটা নাম না শোনা, নাম না জানা ডিরেক্টর এর একটা সিনেমা দেখতে শুরু করলাম আমাজন প্রাইম ভিডিওতে রাত্রে খাবার পর। সিনেমাটা শেষ হলো কম বেশী দুই ঘন্টার মধ্যে। এবার আমার চোখে মুখে জল দিয়ে ঘুমিয়ে পরার সময়। পারলাম না ঘুমোতে। প্রথমে বসলাম কম্পিউটারে গুগল নিয়ে। কে এই ডিরেক্টর, কি কাজ করেছে, কি করে করতে পারলো এরম এক ফিল্ম, কি ভাবে সাহস করলো এই রকম এক বিষয় কে এই নতুন রূপে ধরতে। ধাতস্থ হলাম। অনেক কিছু জানলাম, শিখলাম। ভোরের দিকে বসলাম মাস্টার ডিগ্রি র সময় কেনা 'টাইটাস' নিয়ে, পুরোনো দাগ দেওয়া জায়গাগুলো আর পাশে পেন আর পেন্সিল দিয়ে লেখা নোটসগুলো যেন তখন আর দেখতে পারছি না, পাগলের মতো গিলে চলেছি 'টাইটাস' এর পাতার পর পাতা। মনে পরে যাচ্ছে স্যার এর বলা সব লাইনগুলো। অদ্ভুত এক ট্রমা র মধ্যে দিয়ে সকাল হল। কিছুতেই মাথা থেকে আর সরাতে পারছি না 'টাইটাস' কে। ভুলতে পারছি না,
এ্যারন দ্য মুর এর কথা:
'Vengeance is in my heart, death in my hand, Blood and revenge are hammering in my head.'
বা তামোরা দ্য কুইন এর কথা হোক:
'Revenge it as you love your mother’s life,
Or be you not henceforth called my children.'
বা টাইটাস এর কথাই হোক:
'There’s meed for meed, death for a deadly deed.'
পাগলের প্রলাপ এর মতো করে জপে চলেছে 'revenge' শব্দটা প্রতিটা চরিত্র, প্রতি মুহূর্তে। যতবার মনে পড়ছে ততবার শিউরে উঠছি। একি এক অস্থির সময়, অস্থির প্রেক্ষপটে লেখা এই নাটক, যার প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্যতা কে যেখানে শেক্সপীয়ার নিজেই কিছুটা গুলিয়ে দিয়েছিলেন কোনো নির্দিষ্ট সময়কে বাস্তবে না আনার জন্য, ঠিক এই রকম এক সময়কে, এরকম নানা স্তরের চরিত্রগুলোকে একসাথে ভারতীয় প্রেক্ষপটে উপস্থাপনের জন্য চাই ধৈর্য, সাহস আর একাগ্রতা। [আমি বিশাল ভরদ্বাজ এর শেক্সপীয়ার এর নাটক এর ভারতীয়করন করে তৈরি তিনটি হিন্দি ফিল্ম, মকবুল (ম্যাকবেথ), ওমকারা(ওথেলো), হায়দার (হ্যামলেট) এর কথা মাথায় রেখেই বলছি 'টাইটাস' এ হাত দিতে কলজের জোর লাগে। বিশাল ভরদ্বাজ এর এই তিনটি ফিল্মই আমার খুব প্রিয়, কারন এগুলোর সার্থক ভারতীয়করন উনি করেছেন। সেগুলো আমার অন্য লেখায় আছে। ওনাকে শুধু 'হায়দার' এর মতো একটা ফিল্ম তৈরী করার জন্যই সব পুরস্কার দেওয়া যায়। আর বাংলা জুলফিকার এর কথা যত না বলা যায় ততই ভালো]
'টাইটাস' এ হাত দিতে লাগে সাহস। লাগে ভালোবাসা। লাগে মনের গভীরে পৌঁছে যাবার ক্ষমতা।
ধন্যবাদ বর্ণীলা চট্টোপাধ্যায় কে। 'দা হাংরি' ফিল্মটা তৈরী করার জন্য। ফিল্ম ইতিহাস বহুদিন তোমায় মনে রাখবে। ডিরেক্টর মহাশয়া কে নিয়ে পরে বলছি, আগে যাই আনড্রোনিকাস এর গল্পে।
রোমান জেনারেল টাইটাস আনড্রোনিকাস দশ বছর যুদ্ধ করে রোমে ফিরে এসেছে, সঙ্গে এনেছে জয় করে গথ রানী তামোরা আর তার তিন ছেলেকে আর রানীর চাকর তথা রানীর গুপ্ত প্রেমিক এ্যারন দ্য মুর কে, আর হারিয়েছে তার অনেক পুত্রদের। পঁচিশ জন ছেলের আজ মাত্র চার জন বেঁচে, আর আছে একমাত্র মেয়ে লাভিনিয়া। প্রথম ধর্মানুষ্টানে টাইটাস বলি দেয় তামোরা র প্রথম সন্তানকে, নিজের সন্তানদের জীবনের উদ্দেশ্যে। শুরু হয় প্রতিশোধ এর খেলা। একদিকে টাইটাস, তার চার ছেলে লুসিয়াস, কুইন্টাস, মারটিউস, মুটিউশ ও এক মাত্র মেয়ে লাভিনিয়া, ভাই মার্কাস আনড্রোনিকাস আর তার ছেলে পাবলিয়াস, রোমান রাজা সাতারনিনিয়াস আর তার ভাই বাসিনিউস, আর অন্যদিকে গথ কুইন তামোরা আর তিন ছেলে দিমিত্রিয়াস, চিরণ, আলবাস, সঙ্গে আসা একমাত্র মুর এ্যারন, আরো অনেক ছোট বড় বহু চরিত্র, তাদের প্রতিশোধস্পৃহা, তাদের প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে চালনা করা প্রতিটি পদক্ষেপ শেক্সপীয়ার তার নাটকে ধরলেও 'দা হাংরি' ফিল্মে বর্ণীলা দেখায় তার সার্থক ভারতীয়করণ তার গল্প বলে চলার মুন্সিয়ানায়। জানা গল্পে কাজ করতে যেখানে অনেকেই হিমশিম খায়, শেষ আর শুরু যার দর্শকের কাছে জানা, যার প্রতিটা চরিত্র এবং তার ওঠা-পড়া যখন পৃথিবীর সব ভাষার সব ক্রিটিকদের পেন-খাতায় সেখানে ছবি দেখতে বসে আনড্রোনিকাস এর প্রতিশোধ, তামোরা র প্রতিশোধ কখন আহুজা আর যোশী পরিবারের শোধ-প্রতিশোধের পালা হয়েছে তা ভাববার অবকাশ থাকে না। তুলসী যোশী (তামোরা) সকালে উঠে দুই ছেলে অঙ্কুর (আলবাস) আর চিরাগ (চিরণ) এর আহুজ পরিবারের সাথে ব্যবসায় মন্ত্রীর সাথে ডিল করতে আসার জন্য ড্রেস কোড ঠিক করে অঙ্কুর কে পাঠায় মিটিঙে আর চিরাগকে পার্টি তে। তুলসী নিজে যায় তথাগত আহুজার (টাইটাস) এর সাথে সেই পার্টিতে। একই হোটেল এর ঘরের আর তলার পার্থক্য একই জায়গায়। যোগাযোগ রাখে দুই তলায় একমাত্র অরুন কুমার (এ্যারন দ্য মুর)। মন্ত্রীর সাথে মিটিং শেষ হবার আগেই খুন হয় অঙ্কুর যা আত্মহত্যা না খুন! ( যে যেমন ভাবে বুঝবে) তুলসী র বিয়ে ঠিক হয়েছে সানি আহুজার (সাতারনিনিয়াস) সাথে। এই বিয়ে শুধু তুলসী আর সানি র বিয়ে নয়। একসাথে মিলে যাবে উত্তর ভারতের দুই বিখ্যাত ব্যবসায়ী পরিবার, আহুজা আর যোশী। আরো বেশী সম্পদ, আরো বেশী অর্থ, তাই তো জমির ডিল হয় মন্ত্রীর সাথে। একই পার্টি তে লাভলিন (লাভিনিয়া) কখনো অঙ্কুর কে নিয়ে সিঁড়ি তে যৌবনের খিদে মেটাতে চায় তো কখনো প্রেমিকা বেনটালী র সাথে বাবার পরিচয় করায়। এক ছেলের মৃত্যু আর অন্য ছেলের লন্ডন চলে যাবার পরও তুলসী যখন সানি র সাথে বিয়ের উৎসব এ আহুজা দের বাড়ী তে হাজির তখন প্রাক বিবাহ এক ভোজ সভার আয়োজন করে তথাগত আহুজা।
গল্প বলার ভঙ্গিমা, আর গল্পকে ছবিতে রূপান্তরিত করা: দুয়ের সঠিক সংমিশ্রণ এই সিনেমার ডিরেক্টর আর ক্যামেরাম্যান এর কাজ। আলাদা করে প্রতিটা চরিত্রকে নিয়ে লেখা সম্ভব না হলেও তথাগত (নাসিরউদ্দিন শাহ) আর তুলসী যোশী (তিসকা চোপড়া) র চরিত্রের যে স্তর বিন্যাস বর্ণীলা করেছে তা ছবিতে বোঝানো এক অসম্ভব প্রয়াস। তথাগত শুধু বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টই নয়, সাথে খুব ভালো রান্না করে, এবং পছন্দ করে তার রান্না ভোজসভায় সবাইকে খাওয়াতে। একদিকে শের-শয়ারী, অন্যদিকে রাজকীয় রান্না এই নিয়ে কয়েক একর জোড়া রাজপ্রাসাদ এ থাকে এই আহুজা পরিবার। চাকর-বাকর, মালী, ড্রাইভার, দারোয়ান আর তার সাথেই খেতি-বাড়ি করার মতো ছাগলের পাল, ট্রাক্টর সাথে অডি গাড়ী পাশাপাশি রয়েছে কাঁঠাল তলা জুড়ে। তথাগত র প্রতিটি রান্না র গুনগত মান অথিতির তৃপ্তির কারণ হলেও মেয়ে লাভলীন এর সূক্ষ চোখে ধরা পরে তার সাংকেতিক উপস্থাপনা রূপে। তাই তো ক্ষীরের বাটি সবার কাছে এক রকম মিষ্টান্ন হলেও সে বলে ওঠে, সূর্যের মতো ক্ষীর এর রং, গোল বাটি আর তাতে দেওয়া কোনো এক ছোট সবুজ পাতা, যা তথাগত তৈরী করেছে, ‘সানি-তুলসী’ র বিবাহ বোঝাতে। এই সাংকেতিক দৃষ্টি দিয়েই সে তার শেষ দিনের আক্রমণকারী কে পর্যন্ত চিহ্নিত করেছিল। নিয়মিত ড্রাগ নেওয়া সানি কে ড্রাগের যোগান দেয় তুলসী তারই আজ্ঞাকারী, প্রেমিকা অরুন এর কাছ থেকে নিয়ে। বুঝতে পারি আমরা, তুলসী তার প্রতিশোধ শুরু করেছে। দেশ হারিয়ে, আত্মীয় পরিজন ছেড়ে শত্রুপুরী তে বাস করতে এসে সন্তান হারিয়ে তামোরা আর তুলসী এক হয়ে গেছে। আর এক সন্তান চিরাগ যখন লাভলীন কে দোষী করে তার ভাই কে খুন করায় তথাগতর হাত আছে বলে, শুরু হয় লাভলীন আর চিরাগ এর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, শেষ হয় লাভলীন এর রেপ আর তার জিভ ছিঁড়ে নেওয়া দিয়ে। না, শেষ হয় না। মা তখনো জানে এর পরও ছেলের ক্ষতি হতে পারে। তাই চিরাগ কে লন্ডন এ পাঠাতে চায় অরুন কে দিয়ে আর নিজে হাতে শেষ করে বাকি কাজ।
আর আমাদের আনড্রোনিকাস!
কি করবে আজ তথাগত!
তার ছেলে তো আজ তুলসী র হাতের পুতুল! যে অরুন তার ব্যবসার সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী, সে আর আজ তার হাতে নেই, এটুকু সে বোঝে। শেষ বোঝাপড়ার জন্য তৈরী হয় সে।
বিবাহ পরবর্তী ভোজসভার আয়োজন করে তথাগত। না, এই ভোজসভা সবার জন্য নয়। পুত্র আর পুত্রবধূর জন্য। আর নিজের প্যারালাইসিস এ ভোগা স্ত্রী কে নিয়ে আহুজা এর ব্যবস্থা করে রান্না করার জায়গার পাশেই। প্রথমে মিটিয়ে নিতে চায় অরুন এর সাথে। সাদা রান্নার এপ্রোন পরে, রান্নার টেবিলের সামনে প্রতিটি সবজি নিখুঁত মাপে কেটে, শিক এর মধ্যে ঢুকিয়ে তন্দুর এর ব্যবস্থা করতে করতে হাতে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে, অরুণকে নিজের পেগ বানাতে বলে নাসিরুদ্দিনের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কথা বলা ভাবায় আমাদের যে প্রতিশোধ এর মুখ কি এরকম হয়! অরুণকে করা সোজা প্রশ্ন: কত দাম তুমি নিজের ঠিক করেছ? ঠিক একই ভাবে নিজের ছেলে বউকে ভোজসভায় খাওয়াতে খাওয়াতে নিজের রান্নার প্রসংশার গুপ্তকথা ফাঁস করে একটা শব্দে: 'ভালোবাসা'।
সত্যিই মনে হয় ভালোবাসা না থাকলে কেউ এতটা করতে পারে না। পট্রিয়ার্কি র সীমা ভেদ করে তামোরা নিজের জাতির প্রতি, নিজের স্ত্রী সত্তার প্রতি, নিজের সন্তানের প্রতি অবিচারের সমস্ত প্রতিশোধ নিতে চায় রানী হবার পরই। টাইটাস এর দুই ছেলের মুন্ডু আলাদা করে দেবার নির্দেশ দেয় রাজা তার ভাই বাসিনিউস কে হত্যা করার জন্য, লাভিয়ানা র রেপ আর তারপর নৃশংস ভাবে তার জিভ আর হাত কেটে নেয় তামোরা র দুই ছেলে চিরণ আর দিমিত্রিয়াস মা এর নির্দেশে, শেষ বেঁচে থাকা টাইটাসপুত্র লুসিয়াস বিতাড়িত করার আদেশ দেয় রাজা রোম থেকে। শোকে দুঃখে জর্জরিত টাইটাস তখন পাগল। কথা বার্তা অসংলগ্ন। আবার সুযোগ নেয় তামোরা। লুসিয়াস যাতে রোম আক্রমণ না করতে পারে তার নিশ্চয়তা দেওয়ায় টাইটাস এর কাছ থেকে। কিন্তু শেষ কি তাই বলে! প্রতিশোধে পাগল টাইটাস আবার শুরু করে তার গোপন ছক। তামোরা র দুই ছেলে যারা তার ফুলের মতো মেয়ে লাভিনিয়া কে বাক-রহিত পঙ্গুতে পরিণত করেছে, তাদেরকে ছলে বলে কৌশলে বন্দী করে, আর ছেলে চিরন এর মাংস পাই (বেকড) বানিয়ে রানীকে খাওয়ায়। টাইটাস শেষ হত্যা করে রানীর সাথে তার অতিপ্রিয় আদরের লাভিনিয়া কেও। বেঁচে থাকে না কেউই যারা যারা ছিল এই প্রতিশোধ চক্রে। লুসিয়াস এ্যারন কে জ্যান্ত কবর দেয় আর তামোরা র মৃতদেহ পশুদের দিয়ে খাইয়ে দেয়।
টাইটাস রাজা হয়। রাজা হবার মতোই ছিল সে বীর, রোমানরা তাকে পছন্দ করত, তাদের রাজা হিসাবে মানত।
তামোরা, মাতৃত্বের প্রতীক, সন্তান স্নেহে পাগল মা, যার একহাত ছিল বর্বরতার প্রতীক অন্য দিকে ছিল অপ্রচলিত যৌনতার তীব্র চাহিদা। যে ফেমিনিস্ট ভাবনায় তামোরা হল নির্যাতিত মায়ের প্রতিভূ, সেখানেই দেখি এই মা উল্টে আরো এক মেয়ে কে রেপ করার উৎসাহ দেয় তার ছেলেদের। তামোরা তার অবদমিত যৌনতা র ফলক হিসাবে যেন কাজে লাগায় তার ছেলেদের। এখানে তখন থাকে না কোন স্ত্রী-পুরুষ ভেদাভেদ, মা-সন্তান এর সমীকরণ, সব ছাড়িয়ে উঠে আসে শুধু : প্রতিশোধ
এ তো শুধু প্রতিশোধেরই গল্প!
আর কিছু বলার নেই গল্প নিয়ে। গল্পের ভারতীয়করন নিয়েও আমার জানানোর কোন ইচ্ছা নেই, কারণ চাই ছবিটা সবাই দেখুক। নিজের মতো করেই ভাবুক।
আমার শেষ কথা: নাসিরউদ্দিন শাহ, এই ছবির প্রতি দৃশ্যে, তোমার প্রতিটা চোখের ফেলা পলকের দৃশ্যে, তোমার প্রতিটা শব্দ প্রক্ষেপণে, তোমার প্রতি মুহূর্তের হাঁটা চলায় আমি একবারও তথাগত আহুজা বলে দেখতে পাইনি, আমার না দেখা প্রতিশোধের আগুনে জ্বলা 'টাইটাস' কে দেখেছি। ধন্যবাদ বর্ণীলা তোমায় আমার 'টাইটাস' দেখানোর জন্য। প্রতিটা চরিত্র তুমি তৈরী করেছ নিক্তি মেপে। তিসকা চোপড়া কখনো শুধু তুলসী যোশী হয়ে থেকে যায়নি, হাজির হয়েছে তামোরা হয়ে, ভালোবাসা, ঘৃণা, প্রতিশোধ, যৌনতা, দুঃখ, কষ্ট সবের মূর্ত প্রতীক হয়ে।
এবার আসি ডিরেক্টর এর কথা। বর্ণীলা চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার মেয়ে। পড়াশোনা নিউ ইয়র্ক থেকে। এই ছবিটার আগে অনেক গুলো ছবিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করলেও প্রথম ডিরেক্টরেল ডেবিউ ছবি হল: 'Let's Be Out, The Sun is Shining' (2012) বাকি কথা গুগলে আছে, কবে, কোথায়, কি প্রাইজ, কে, কি বলেছে বা ডিরেক্টর কি বলেছে, সেসব দেখে নেওয়াই ভালো।
ছবির নামঃ ‘The Hungry’ (2017)
ডিরেক্টর: Bornila Chatterjee
**সাথে ডিরেক্টর এর ছবিটা আর সিনেমা র পোস্টার আমি IMDB থেকে নিয়েছি। আমার মতো অনেকেই বর্ণীলা কে চিনুক এই ভেবে দিলাম।
***আমি চাই আমার বন্ধুরা এই ছবি টা দেখুক। (যারা দেখে নি, আর যারা দেখেছে তাদের গালাগাল দিলাম আমায় দেখতে না বলার জন্য।)

Comments

Popular Posts