গুঁড়ো গুঁড়ো নীল, স্বপ্ন রঙ্গিন।।(২)

গুঁড়ো গুঁড়ো নীল, স্বপ্ন রঙ্গিন।।(২)



পেটকাটি চাঁদিয়াল, মোমবাতি বগগা
আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক, মাটিতে অবজ্ঞা।

অবজ্ঞা, মাটিতে অবজ্ঞা কোনো কিছুই যখন বুঝতাম না তখন থেকেই আমার ঘুড়ির সাথে ভালোবাসা। আজও সেই ভালোবাসার রেশ থেকে গেছে মনের কোনে এক চিলতে। সেই কোন ছোটবেলা যখন আমার দ্বিতীয় শ্রেণী তখন থেকে আজ মধ্য চল্লিশেও 'ঘুড়ি' শুনলেই আমার বুকের ভিতর কেমন করে ওঠে। আমি আজও কেমন হয়ে যাই। আমি আর আমার ঘুড়ি, শুধু এইটুকুই আমি আমার জীবনে বহুবার বহুভাগে আসক্ত হয়েছিলাম। আর আজ? আজও কি আমার সেই আসক্তির মুক্তি ঘটেছে? সত্যিই কি হয়েছে? একটু দেখি নিজেকে নিজের মতো করে ভেবে।
গ্রামের স্কুল। ৮২ সাল। শীতকালের ছুটি। আমি আর ভাই। একটা ঘুড়ি আর কিছুটা সাদা সুতো, ধান তুলে নেওয়া না-চষা জমির উপর দিয়ে ছুটে চলেছি। সুতো ধরে আমি সামনে আর ঘুড়ির পিছনে ভাই। সে ঘুড়ি একবার হওয়ায় ওঠে তো পরক্ষনেই জমি দিয়ে ছেঁচড়ে চলেছে আমার টানে। মাঠে এসে পৌঁছালাম যখন তখন ঘুড়ির মাথা ফেটে, ছিঁড়ে-খুঁড়ে একসা। মাঠে তখন দাদারা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। বসে থাকলাম। দু চোখ ভরে দেখলাম ঘুড়ি ওড়ানো। আমার মতো রাস্তায় টেনে-টেনে আনা নয়। ঘুড়ি আকাশে থাকে। আকাশ। এক পৃথিবী নীল আকাশে ঘুড়ি উড়ে বেড়ায়। প্রেমে পড়লাম সেদিনের সেই বিকালে, ঘুড়ির প্রেমে। 'চেষ্টা করে ঘুড়ি ওড়ানো যায় না, ঘুড়ি ভালোবাসায় না থাকলে ঘুড়ি ওড়ে না', এক দাদা বলেছিল। সেদিন কিছুই বুঝি নি, তবে সেই ভালোবাসার খোঁজ যেন মনে ছিলই, তাই অবস্থান পরিবর্তনে সাথে সাথে তা আবার চাগার দিয়ে ওঠে। একটু একটু করে মনে পড়ে যায় সব, সওওব।।
বর্ধমান শহর। ৮৫ সাল। সর্বমঙ্গলা পাড়ায় দু-কামরার ভাড়া বাড়ী। মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো এখানে নেই, সবাই বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়ায়। আর আমি সেই বাড়ির ছাদ দেখেছিলাম পাঁচ বছর বাদ। তাই যাতায়াতের রাস্তায় সাইকেল, রিকশা বাঁচিয়ে আকাশে ঘুড়ি দেখি আর মায়ের বকুনি খাই, 'কি হাঁ করা ছেলে রে তুই!' ছাদে উঠতে না পারা আর ঘুড়ি ওড়াতে না পারা এই শীতের দিনগুলো কাটানো ছিল বড়োই কষ্টের।
অবসান করতেই যেন ভগবান পাঠালো পার্থদা কে। ততদিনে আমি বর্ধমানে এসে জেনে গেছি ঘুড়ির মেলা, মাঞ্জা আর অনেক প্যাঁচ লড়ার কায়দা, কিন্তু নিজের হাতে কিছুই করিনি। মাসিমা আর বাবার বারণ ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আমায় নিয়ে বেরুল ঘুড়ি আর সুতো কিনতে। বরাবরের একবগ্গা পার্থদাকে কেউ কিছু বলতো না। আমার তখন ক্লাস নাইন। ঘুড়ি মেলার আগের দিন রাত্রে সব কিনে এনে ভাত খেয়েই দুজনা শুরু করলাম ঘুড়ির 'যুক্তি' বাঁধতে। প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত সব ঠিক করে শুতে গেলাম আর পরদিন রাধানগর এর ছাদে আমি বর্ধমানে আমার 'মুক্তি'র ঘুড়িটা উড়িয়ে খবর পাঠালাম, 'আমি এসে গেছি'। ততদিনে পার্থ দা আমায় হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছে মাঞ্জা করা থেকে শুরু করে ঘুড়িতে জীবন-যাপন। প্রতিবছর মেলার ওই দিন তিনেক সেই সময় ছিল ছাদ-ময় জীবন। বৌদি (ছোটন) আর সোমাদি আমাদের সাথে থাকতো, আর যত থাকতো ততো আমাদের নামে নীচে 'মাসিমা'র কাছে গিয়ে আমাদের নামে লাগাতো। আসলে আমরা দুজনেই খুব ভালো ছেলে ছিলাম তো! পাশের বাড়িতে যে ওড়াচ্ছে সে আমাদের ঘুড়ি কেটে দিলে বা সুতোর 'হপ্তা' মেরে দিলে আমাদের মুখ থেকে তো তখন 'ব্রজবুলি' বেরুত। নীচে থেকে 'মাসিমা' র সেই চিৎকার:
- ওরে পার্থ! ওর বাবা দিয়ে গেল পড়তে, আর তুই পরের ছেলেকে গালাগাল শেখাচ্ছিস!
আমারও ওসব কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতাম কারণ তখন হয়তো পাশের ছাদের বুবুর দাদা খোকনদার ঘুড়ি আমার ঘাড়ে এসে প্যাঁচ লাগছে। পার্থদা পাস থেকে আমায় বলে যাচ্ছে:
- আস্তে সাগর, আস্তে! লাগুক আগে, বা* এর খোকন কে এমন কাটবো শা* এবছর আর ঘুড়ি ওড়াতেই উঠবে না। তুই শুধু 'ঢিল' দিয়ে যা।
(এই সময় নীচ থেকে আবার চিৎকার)
- এই পার্থ! আবার মুখ খারাপ করছিস! এবার তোদের ঘুড়ি ওড়ানোই বন্ধ করে দেবো।
- ধূর বাবু! তুমি খোকন কে বলো! লাগছে কেন আমাদের সাথে?
- আমি কাওকে বলবো না। তুই মুখটা ঠিক কর!
সে এক মজার দিন ছিল আমার। সন্ধ্যা নামার পরই কিন্তু বৌদি আর সোমাদি বাজার গেলে মাসিমাকে লুকিয়ে ভেজিটেবল চপ নিয়ে আসতো। নীচের তলায় একপেট মুড়ি-আলুভাজা খেয়ে এসেও লুকিয়ে খাওয়া হতো তিনতলায়। আমার ঘুড়ির হাতে খড়ি থেকে পাকা ঘুড়ি উড়িয়ে হয়ে ওঠা সবেতেই ছিল 'এক এবং একমাত্র ' পার্থ দা।
-'তুমি আমার সাথে না থাকলে আমি ঘুড়ির প্রেমে পড়তামই না। তুমি না থাকলে আমি আকাশ চিনতামই না। তুমি না থাকলে আমি হাওয়ার দিক জানতেই পারতাম না।'
আমরা আবার অন্য পাড়ায় অন্য মেলায় ঘুড়ি ওড়াতে যেতাম। পার্থদার মামার বাড়ী ছিল খোসবাগান। প্রথমদিন রাধানগর এ উড়িয়ে পরের দিন যেতাম ওখানে। পার্থ দা ছিল তখন প্রায় সব দিকেই আমার 'ঘুড়ি' টা উড়িয়ে দেবার জন্য। সবসময়। সবেতে। 'আমার ঘুড়ি'র সাথেই ছিলাম ওর সাথে।

হারিয়ে যাচ্ছিলো দিনগুলো আসতে আসতে কলেজ জীবন এর সাথে সাথে। ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করতাম। হয়ে উঠতো না। রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে যাবার সময় ঘুড়ি ওড়ানোর দিনগুলো খুব মানসিক ভাবে কষ্ট পেতাম। আবার কখনো কখনো দাঁড়িয়ে পড়তাম। আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখতাম 'লাল-সাদা' টা কেমন করে 'তিলকধারী' কে কাটবে বলে 'পেট' বরাবর ঢুকছে! বুঝতাম, 'লাল-সাদা' টা ওড়াচ্ছে কোন এক ক্যা *নে! হুঁশ ই নেই যে, কতো টা সুতো নিয়ে কাটবে। আবার অনেক দিন হয়েছে কার্জেন গেট এর আড্ডায় বসে অলস দুপুরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, কি সুন্দর একটা কালো 'বাঁদরমুখো' খুব ধীরে ধীরে একটা 'দু-বগগা'কে 'লপটে' নিয়ে আসছে! শিল্পী মানুষ সব! আমাদের পাড়ায় দুই ভাই ছিল সেই সময় এই 'শিল্পী' ধরণের মানুষ। কার্তিক আর গণেশ, দীপালি রেডিও সার্ভিস, বি.সি.রোড। কিছু বলার নেই। কার্তিক যে ঘুড়ি কাটবে গণেশ সেই ঘুড়ি একটু পিছন থেকে তাকে 'লপটে' নিজেদের ছাদে আনবেই। আর প্যাঁচ লড়তে কার্তিকের মতো টান আমি আজ অবধি খুব কম লোককেই দেখেছি।
প্রতিটা ঘুড়ির মেলা ছিল আমার কাছে স্বপ্নের মতো। কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে মাঞ্জা করা থেকে ঘুড়ি কেনা, সে তো সবাই করে। আমাদের ছিল আরো অন্যরকম। দুটো লাটাই ভর্তি মাঞ্জা, যার একটা মেলার তিন দিন আগে হতো মেলা স্পেশাল, এক-এক বছর এক-এক লট এর ঘুড়ির অর্ডার দেওয়ার জন্য গোটা বড়বাজার আর জেলখানার মোড়ের দোকানগুলো চষে ফেলা (আমাদের ছাদের এটাই পরিচিতি), 'যুক্তি' বাঁধা শুধু কালো সূতোয়, ফিস্ট আগের দিন রাত্রে ছাদেই করতে হবে, বক্সে বাজবে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কয়েকটা গান তাই তার ক্যাসেট জোগাড় করে সেগুলো 'এ' পিঠ আর 'বি' পিঠে আগে থাকতে রেকর্ডিং করে আনা, কাঁচি-আঠা- নিকোপ্লাস্টার জোগাড় করা, একটা ত্রিপল দিয়ে ছাদের এক কোনে তাবু করে নীচে শতরঞ্জি পেতে শুরু হতো ঘুড়ি মেলা।
চোখ বুজলেই ছবির মতো একটার পর একটা দৃশ্য যেন পর পর চলে যায়:
ছাদের তাঁবুতে এক গাঁট পরে থাকা ঘুড়ি, দু প্রান্তে দুজনা বাড়িয়ে দিয়েছি দুটো 'দেড়-তাইয়া' কালো-ল্যাজ, পাশাপাশি সব বক্স বা মাইক বেজে উঠেছে প্রচন্ড আওয়াজে, কোথাও 'তোফা, তোফা, তোফা....লায়া, লায়া, লায়া' তো কোথাও 'আই এম এ ডিস্কো ডান্সার..', চোখে কালো ফুটপাথে কেনা সানগ্লাস, মাথায় টুপি, হাতের প্রায় সব আঙুলে সাদা নিকো-প্লাস্টারের স্ট্র্যাপ, ধরে রাখা মাঞ্জা প্রাণপনে টানতে টানতে পিছিয়ে চলেছি ছাদের শেষ প্রান্ত বরাবর, ঠিক সেই সময়ই চিৎকার করে মাইকে বলে উঠলো কেউ একটা, 'ভো-কাট্টা, ভো-ও-ও-কাট্টা'। আর আমাদের ছাদ থেকে উত্তর গেলো, 'তোর দাদুর লেজ কাটা'। যার কাটলো সেই ছাদে আবার নতুন ঘুড়ি নিয়ে 'বাপ্পি' উঠে পড়লো চিলেকোঠায় আর আমি বাড়িয়ে চললাম আরো, আরো, একটু। আমি বরাবর বেশী সূতোয় বাড়িয়ে লড়তে ভালোবাসি। আর পার্থ দা বলতো, 'যাবে দেখবি, একদিন তোর সব যাবে!' গেছে। অনেক বারই গেছে। লাটাই খালি হয়ে গেছে, কিন্তু যখন যার কেটেছি, তাকে বুঝিয়েছি কাকে বলে ঘুড়ি ওড়ানো! আর সূর্য ডুবিয়ে ঘুড়ির রেশ না কাটিয়ে যখন নীচে নামতাম তখন মাসিমার অমোঘ বাণী:
- 'মুখপোড়া' হনুমান দুটো নামলো। কাল থেকে আমায় লোকের কথা শুনতে শুনতে কান ঝাল-পালা হয়ে যাবে! (আক্ষরিক অর্থেই সারাদিন রোদের দিকে তাকিয়ে আমাদের সেই অবস্থাই হতো, চশমা-টুপি তো ছিল প্রথম ঘন্টার সাজ!)
অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। কেউ আর পার্থদার মতো মেলার আগের দিন বিকালে এসে বলে না, 'চল, ঘুড়ি কিনে আনি।'

আমি কয়েক বছর আগে শুরু করেছি আমার ছেলের সাথে আমাদের ছাদে মেলার দিন ঘুড়ি ওড়াতে। ও পারেনা ঘুড়ি ওড়াতে, যদিও আমি ওকে নিয়ে চারতলার ছাদে উঠি। ঘুড়ি ধরে উড়িয়ে তাকে নিয়ে খেলা করার যে মজা, তা তো ওর মতো বয়সেই আমি পেয়েছিলাম। 'ঘুড়ি আমার কথা শুনবে, আমি যেখানে নিয়ে যাবো সেখানেই যাবে', কে দেবে তার স্বাদ ওকে, ওর তো আমার মতো পার্থদা নেই! তাই আমি যখন বলি একটু চেষ্টা কর, পারবি, তখন ও হতাশ হয়ে যায়। একটু পরেই ছাদ থেকে নেমে আসতে চায় কারণ দেখে যে বাবা তো মোহিত হয়ে আছে তার 'প্রেমিকা' কে নিয়ে স্বর্গেরপানে চেয়ে। চাইলেও কিছু করতে পারি না, এতো সময় কম। তারথেকে একটুও ভাগ দিতে মন চায় না।
আবার খুব কষ্ট হয় যখন ঘুড়ি মেলার দিন সকালে আমায় চান করে ভাত খেয়ে স্কুল বেরুতে হয় সাইকেল নিয়ে। শেষ বারও ছুটি ছিল না, আর যথারীতি আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে এক টোটোভাইয়ের সামনের লাইটের জরিমানা দিলাম। তা যাক। কাটেনি তো শেষপর্যন্ত 'সাদা চাঁদিয়াল'টা।
আজ আমার আকাশ কি এতো ছোট হয়ে গেছে যেখানে আর 'ঘুড়ি' র দেখা নেই?
'আমার ঘুড়ি' কি আজ অন্য আকাশে?

তবে কিছুই হারিয়ে যায় না। তা না হলে কোথাকার আমি আর তার সাথে পার্থদার আকাশ এক হয়ে যাবে কেন কিছু সময়ের জন্য হলেও!
আশা রাখি, এবার না হোক, পরের বার; না হোক তার পরের বার আমার ছেলের আকাশময় উড়ে বেড়াবে পেটকাটি, চাঁদিয়াল, এক বগ্গা, তিলকধারী, সিঁদুরমুখো, লাল-ল্যাজ।

** আমার চরিত্ররা আমার খুব কাছের, অতি প্রিয় এবং আমার জীবনের চরমতম বাস্তব, যাদের না পেলে হয়তো আমার ছোটবেলাটা ছোটবেলা হয়ে উঠতো না।
** আজ হঠাৎ কেন এসব কথা লিখতে বসলাম! সকালবেলার রোদ্দুরের মতো এসে এক অজানা 'মোনালিসা' খুঁচিয়ে দিয়ে গেল। তাই!
** ছবিগুলো তুলে দিয়েছে। বলতে হবে কে? বলছো? আচ্ছা বললাম। Swati Dan

08/01/2019

Comments

Popular Posts