সব চরিত্র কাল্পনিক নয়। (১) / রঞ্জাবতী কে লেখা অনিকেত এর খোলা চিঠি। (পত্র: এক)

রঞ্জাবতী কে লেখা অনিকেত এর খোলা চিঠি।  (পত্র: এক)



রঞ্জাবতী,
শোন, তোকে একটা নামের লিস্ট পাঠাচ্ছি। দেখ।
Glenfiddich, Glenlivet, Jim Beam, Blue Label, Ballentine, Chivas Regal, Maesteo, 1984, Ulysses, Sense and Sensibility, Jane Eyre, Gone Girl.
লিস্ট টা আরো বাড়াতে পারতাম। অযথা তোর উপর সেই চাপ দিয়ে কোনো লাভ নেই, আমি জানি। তাও চেষ্টা তো আমি করেই যাবো। তুই তো জানিস, মোটামুটি যা পারি, আর যা করি, তার প্রায় সব ছেড়ে বা আর করার ক্ষমতা নেই ( আদেঔ ছিল কিনা জানি না)- এটা বুঝে আমি এখন এই। মোটামুটি ভাবে উপরের লিস্ট টা যে কিসের সেটা তুই নিশ্চই অল্প বিস্তর বুঝেছিস। এগুলো র কিছু কিছু আমি জীবনের কোনো কোনো সময় স্বাদ পেয়েছি। আজকে এই সময় এ এসে আমি বুঝেছি এগুলোতেই আমার বাকি ভালোবাসাটুকু পড়ে আছে। এমন নয় এগুলোর সাথে আমি নিয়মিত দিন যাপন করি বা স্বপ্ন দেখি এগুলোর। কিন্তু, তাও খুব গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখেছি, সেই দূরে কোথাও যেন আমার এক চিলতে মুখ টা মিষ্টি হয়ে যাবার মতো, হঠাৎ করে মনের খেয়াল এ হেসে ওঠার মতো বা মনটা অন্যরকম হয়ে যাবার মতো কঠিন এক জোড়-লাগা ভালোবাসা আছে এগুলোর উপর। এমন নয়, এগুলো ছাড়া আমি চলতে পারবো না বা এগুলোই আমার সব। তাও, ওই যে বলে না, ফ্যান্টাসি!!! বা আরো ভালো করে চলিত বাংলায় সেই ঘোর লাগা মন, বা ঝিল মিল লেগে যাওয়া মন। যাই হোক, তোকে এত কথা লিখছি কেন?

এগুলো র অনেক কিছুই বেশ কিছুদিন একতরফা ভাবে তুই আমায় দিয়ে চলেছিস। থামো। থামো। অনেক কিছুই। অনেক কিছুই মানে কিন্তু সব কিছু নয়। অনেক দিয়েছিস, সব নয়। সব তুই দিবি এতটা আশাও আমি করি না। তাও, ওই যে বললাম না, চেষ্টা করে যাই। যদি শিকে ছেঁড়ে!
আচ্ছা তুই এতক্ষন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিস আমি কি বলছি।
যদি বুঝে থাকিস সব নাম গুলোই ( কারণ এর মধ্যে কিছু নাম তুই জানিস না, বা শুনিসনি, তাই অলরেডি গুগল করে ফেলেছিস। ওই যে বলে না, হেরে যাওয়া তোর ধাতে নেই। সারাজীবনই মনে করিস, তুই সব কিছুর সব জানিস।) তাহলে মুখ টা বেঁকিয়েছিস, আর যদি না বুঝিস তাহলে যা বলছি ভালো করে মন দিয়ে শোন।
হাঁ, প্রথম ছ-টা নাম আমার প্রিয় কয়েকটা সিঙ্গল মল্ট স্কচ, আর পরের ছ-টা আমার প্রিয় কয়েকটা বই।
সিঙ্গল মল্ট স্কচ বা স্কচ হুইস্কি বা ব্লেনডেড হুইস্কি আমি পছন্দ করি। ঠিক যেমন ভাবে আমি গল্পের বই বা যে কোনো বই আমি একা পড়তে ভালোবাসি। শীতকাল এর দুপুরে ছাদে রোদে চাদর নিয়ে বসে গল্পের বই, ঠিক তেমনই বেশ সন্ধ্যে বেলায় আমার উপরের ঘরে একা একটু সিঙ্গল মল্ট স্কচ আর বরফ , মাঝে মাঝে বই পড়ছি বা গান শুনলাম। এরকম ধর মাসে এক বা দু দিন ( আমার আজকাল কারোর সাথে খেতে মন যায় না, বা রোজ খেতেও মন যায় না, কিন্তু খাবার ইচ্ছা আছে, আর সেই কারণেই খাওয়া প্রায় কমেই গেছে ) তারপর ঘন্টা দুই কাটিয়ে এসে রাত্রে খাবার খেয়ে শুলাম। এই আর কি।

যাই হোক, আমি জানি 'মদ' তোর দু চোখের বিষ, তুই কোনো ভাবেই এটা নিতে পারিস না বা যারা এর সাথে থাকে তাদের সাথে তুই কোনো যোগাযোগ রাখিস না। জানি, আমি জানি। তাও আমি বললাম কেন তোকে?
মন হল। বললাম। বেশ করেছি। তোর যা মনে করার তুই করতে পারিস আমার কিছু বলার নেই তাতে। কারণ আমার বলতে মন হলে আমি বলবো।

যাই হোক, এতো সেন্টু মার্কা কথা বললাম, তাতে যদি 'বার' খেয়ে এবার আসার সময় আমার জন্য দুটো সিঙ্গল মল্ট স্কচ নিয়ে আসিস তাতে আমার ভালোই লাগবে। আসলে তখন থেকে সেই চেষ্টাই করে চলেছি। আবার আমি এটাও জানি তোকে 'মদ' ( যদিও সিঙ্গল মল্ট স্কচ কে মদ বলা যে পাপ, সে তুই বুঝবি না! ) আনতে বলা আর দেওয়ালে মাথা খোঁড়া একই !!
তাও!!! ওই যে , চেষ্টা তো করে যাবো।
যদি!!! যদি!!!
Another Brooklyn পড়ার ইচ্ছা যেমন আছে, ঠিক তেমনই The Famous Goose চেখে দেখার ইচ্ছাও থাকলো। হলে ভালো, আর না হলে বয়েই গেল।
আসার আগে আগেই এতো সেন্টু দিয়ে লিখলাম, বলছিস কোনো লাভ হবে না? সত্যি? লাভ হবে না!!! ঠিক আছে, না হোক। এটুকু অন্তত জেনে রাখ, পরে কোনো সময় কাজে লাগলেও লাগতে পারে। যদি সত্যি ই কিনিস তাহলে এয়ারপোর্ট এর ডিউটি ফ্রি শপ থেকেই নিস আর ভুলেও কলকাতায় নয়, দুবাই বা ফ্রাঙ্কফুর্ট বা যদি স্টপ ওভার এ ইউরোপের কোনো এয়ারপোর্ট থাকে সেখান থেকে। আর দুটো আনতে দেয় তো। তাই দোকানে গিয়েই জিজ্ঞাসা করিস ডাবল প্যাক এর ডিল কি আছে। থাকে , থাকে রে, সব সময় ই থাকে। একটু সময় নিয়ে খুঁজিস। আর কোনো ভাবেই দামী কিছু কিনিস না কারণ সেগুলো না শো পিস হয়ে বাড়িতে পড়ে থাকে। কি ভাবছিস, তোর বর থাকবে এবার। তাতে কি !! বলবি, আমি বলেছি এনে দিতে। সাথে এটাও বলবি এর সাথে বই কিনতেও বলেছি। (আর বই নিশ্চই কোথায় কিনবি বলার দরকার নেই)
কে আমি জিজ্ঞাসা করবে তোর বর। আরে ধুর! ওর অতো সময় কোথায়? এয়ারপোর্ট এ কোম্পানির গাড়ী আসবে, সোজা তাজ এ মিটিং সেরে তোদের বাড়ী আসবে রাত্রে খাবার আগে। আর তুই তো দাদু, মা, কাকাই করতে করতে হলুদ ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ী আসবি। কি যেন নাম তোর ওই কার্তিকটার! হুঁ শুনেছিলাম। অনির্বান। বাপরে, নাম এর মধ্যেই কেমন যেন একটা ই-য়ে ই-য়ে ব্যাপার। যাই হোক যদি দ্যাখে বা জিজ্ঞাসা করে তাহলে ওর পাসপোর্ট টা আর কিছু ডলার চেয়ে নিস, আরো দুটো নিতে দেবে, মোট চারটে নিয়ে আসিস।
জিজ্ঞাসা করবে না, নাম বলিস তাতেই হবে।
অনিকেত।
অনি।

** হতে পারে রঞ্জাবতী কে লেখা অনিকেতের প্রথম চিঠি। আবার না হতেও পারে। কি এসে গেল তাতে। হতে পারে এই চরিত্রগুলোর সমস্ত কথা, সমস্ত চিঠি আমি লিখে যাবে আমার দেওয়ালে। আবার কালকের পর ওদের নিয়ে লিখতে নাও পারি। তাতেও কিছু এসে যায় না। তবে আমি চাই আমার সব পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, মানুষজন জানুক ওদের কথা। বুঝুক ওদের কথা। ভালোবাসুক আমার মতো করেই ওদের। আমি কি ওদের ভালোবাসি? জানি না তো! উত্তর খুঁজে চলেছি আজও।
*** একটু ভূমিকা যা না করলেও চলে যায়, তবুও:
রঞ্জাবতী আর অনিকেত দুজনকেই আমি খুব ভালোভাবেই চিনি বা ঠিক ভাবে বললে আমি জানি ওদের সবাইকেই। কিন্তু ওরা কেউই আমায় চেনেনা বা আমার নামটুকুও জানে না। কিন্তু ওদের জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা, সে অনিকেতের জন্ম হোক বা রঞ্জাবতীর হাতে পাঁচিল থেকে ইঁট পড়ে আঙ্গুল রক্তারক্তি হয়ে পাড়াময় করে বেড়ানো হোক বা দুজনের একসাথে কলেজের ফর্ম তুলতে যাওয়া হোক, সবেতেই আমি ছিলাম কেমন করে যেন! ছবির মতো দৃশ্যের পরিবর্তনের সাথে সাথে ওরা আমার চোখের সামনেই পরিবর্তন করে ফেললো প্রতিমুহূর্তে। আজও ওরা কেউই জানে না যে আমি কেমন করে ওদের সমস্ত কিছু চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখলাম। আমার জানা আর না জানার মাঝেও যেটুকু ছিল তা যেন আবার নতুন করে আমায় জানিয়ে গেল প্রকৃতি। অনিকেতের অনেক চিঠি যা ও রঞ্জাবতীকে পাঠিয়েছে দিনের পর পর দিন তা কেমন করে আমি পেলাম তা আমি আজও বুঝে উঠতে পারি না। আর রঞ্জাবতী তো কোনোদিনই চিঠি লিখতে পারতো না, ও তো বরাবরই এই হোয়াটসআপ আর ফেসবুক মেসেঞ্জার এ দু এক কথা লিখেই ক্লান্ত হয়ে যেত। হ্যাঁ, ও যেটা পারতো তা হলে দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইলে ফোন করতে, সে ও পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক, সে ওর ফোন কানে নিয়ে অনিকেত ঘুমিয়ে গেলেও ওর কিছু এসে যেত না। ও আবার দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে পরের দিন সকালে আবার ফোন করতো। আর না তুলে অনিকেতের কোনো উপায়ই নেই। কারণ ওই রিং ততক্ষন বন্ধ হবে না, যতক্ষন না ও ফোন ধরবে। সুইচ অফ করে রাখার কথা ভাবছো তো! সে চেষ্টাও অনিকেত করেছিল। তার ফল হয়েছিল, সকাল সকাল বাসি মুখে নীচে সদর দরজা খুলে রাঙ্গাকাকুর ফোনে রঞ্জাবতীর ফোন ধরে কথা বলতে হয়েছিল আর দুপুরে পাড়ায় চায়ের দোকানে আড্ডায় বসে অন্তত পাঁচজনের কাছে শুনতে হয়েছিল যে কাল রাত্রে ওর কি এমন হয়েছিল যে সকালে মড়ার মতো ঘুমোচ্ছিলো বা কেউ তো আবার আর একটু উপরে গিয়ে দেখতেই চাইছিলো বাড়িতে কাওকে এনেছিস নাকি রে! এসব দেখার পর অনিকেত জানে ফোন বন্ধ করে বা না ধরে ঝামেলা বাড়ানোর থেকে ফোন ধরে নেওয়াই ভালো। আর তারপর ও আবার ঘুমিয়ে গেলেও রঞ্জাবতীর কিছু এসে যায় না। প্রথম আধ ঘন্টা তো ফোনের ও প্রান্ত থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া শব্দগুলো সকালে বাসি মুখে জলের ঝাপটার মতো এসে লাগবে। কথা শুনেও কোনো লাভ নেই কারণ তার পরের দশ মিনিট ও যখন মুখ ধুয়ে চা করতে করতে ফোনটা স্পিকারে দিয়ে রাখবে তখন কিছু শুনবে। তারপর ও ফোন কেটে দেবার আগে জিজ্ঞাসা করবে চা হলো কিনা এবং আবার পরে ফোন করছি বলে শেষ করবে। ও জানে পরের ফোনটা কখন আসবে, কি বলবে আর কি কি ঝাড় দেবে বা কখন একটু রাগ করে ওর কথা ভালো করে না শোনার জন্য রাগ করবে। আর দিনের শেষ ফোনটা আসবে ওর শুয়ে পরার পরই। সারাদিন-সারারাত বকে যেতে পারে মেয়েটা। এখানে থাকলে তো শুধুই ঝগড়া। আর আজ সাত সমুদ্র পেরিয়ে দূর দেশে বসে ওর কথায় কত কিছু যোগ হয়েছে ঝগড়ার সাথে। সে ওর গাড়ী চালানো শেখা হোক, হাইওয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় গাড়ী চালিয়ে ফিরে আসার সময় হরিণ দেখে ওর দাঁড়িয়ে পরে রাস্তার প্রান্তে ছুটে যাওয়া হোক, সকালে ব্রেকফাস্টে দুটো পাঁউরুটি কি কায়দায় ডিম আর চিকেন একসাথে দিয়ে ছাতার-মাথা কি এক বানানো হোক, দু দিন অন্তর প্রবল তুষারপাতে ওদের শহর সাদা হয়ে যাওয়া, ওদের বাড়ী, গাড়ী সব কেমন সাদা হয়ে গেছে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে তামিল ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় হওয়া: আর কি নেই সেই ফোনের বিষয়বস্তু। অনিকেত ভেবেই পায় না যে ও এসব শুনে কি করবে। জিজ্ঞাসা করেছিল একবার। তার ফলও হাতে হাতে পেয়েছিল। সেসব গল্প না হয় ধীরে সুস্থে করা যাবে। আজ যে কথা বলতে শুরু করেছি তা হলো আমি এতো সব জানলাম কেমন করে। আমি নিজের মনেই অনেকবার ভেবেছি, এগুলো কি আমার জানা ঠিক হচ্ছে। নিরন্তর যুদ্ধ করেছি নিজের সাথে। এমন সময় আমি হাতে পাই অনিকেতের লেখা বেশ কিছু চিঠি যা ও রঞ্জাবতী কে পাঠিয়েছিল। আমার সময় লেগেছিল অনিকেতের প্রতিটা কথা বুঝতে। ধীরে ধীরে আত্মস্থ করেছি অনিকেতের প্রতিটা কথা, প্রতিটা শব্দ। শব্দ নিয়ে খেলা, কথার বন্ধনে আবদ্ধ জীবন, যা আমার সামনে ঘটে গেলেও আমার চেনা ছেলে মেয়ে দুটোকে কেমন অজানা লাগতে শুরু করল। মনে হল, এই চিঠির কথা সবার জানা উচিত। কাকে জিজ্ঞাসা করব, কি ভাবে সবাইকে বলবো ? এখন তো আমি শুধু একপক্ষের কথা যা শুধু ও লিখেছে সেটাই জানি। অন্যদিকের রঞ্জাবতীর কোনো কথাই তো আমি জানি না। ও কি বলে এই ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে যা অনিকেত না শুনলেও ও বলে যায়। আমার কেমন এক ধারণা তৈরি হয়েছে আমার নিজের মধ্যেই যে আমি খুব তাড়াতাড়ি ই ওই ফোন বা হোয়াটস আপ বা ফেসবুক মেসেঞ্জার এর কথা গুলো শুনতে পাব বা দেখতে পাব। আমি চিনি এই দুজনকেই, এদের ঘিরে থাকা মানুষদের জীবন বা এদের নিয়ে বাকিদের কথা বা ধারণা। কিন্তু এরা কেউই আমায় চেনে না। তবুও বলি এরা কেউই আমার কল্পনার চরিত্র নয়, প্রতিদিন, প্রতিটা সময় আমার পাশে পাশে কাটানো মানুষজন। অস্তিত্বহীন জীবনের ঘটমান বর্তমান যেন ছায়াছবির দৃশ্যপট পরিবর্তনের সাথে বদলে যাচ্ছে। 'সিমুলাক্রা' তে আক্রান্ত এক 'অন-লুকার' বদলে ফেলছি নিজেকেই আর প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করছি এই অদ্ভুত জীবনের চরিত্রাবলীর অনুভূতিগুলো।

*** 'পরবর্তী চিঠি' ক্রমশ বলব না, বলব যে যেদিন আবার ইচ্ছা হবে বা তোমাদের ও ইচ্ছা হবে সেদিনই আবার ।।

8Feb2019

Comments

Popular Posts