'নন-সেন্স' কথামালা।। (১) **** 'ব্যাঞ্জো' র হলুদ লুঙ্গি।

'নন-সেন্স' কথামালা।। (১)

'ব্যাঞ্জো' র হলুদ লুঙ্গি।

ঘটনা ঘটে যায় সময়ের সাথে সাথে। প্রভাব পড়ে মনের উপর। ছোট-বড় সবার উপরই। তারপর একসময় আমরা সেগুলো ভুলে যাই। বহুবছর পেরিয়ে এসে মনের অজান্তে সেই ঘটনার একটুকরো  মনের গভীর অতল থেকে বুদবুদ এর মতো জেগে ওঠে। কোনো কার্য-কারণ ছাড়াই। কখনো মন খারাপ হয়ে যায়, কখনো বা মন ভালো হয়ে যায়। কখনো বা কিছুই মনে হয় না, শুধু শুধুই মনে পড়ে যায়। অনেক কিছু মনে থাকে, আবার অনেক কিছুই ততদিনে ভুলে গেছি। তাও মনে পড়ে। চরমতম বাস্তব ভাবে বেশী করে মনে পড়ে এমন এক ছোট জিনিস, যার সেই ঘটনার সাথে হয়তো কোনো যোগাযোগই নেই। তাও যেন সেই এক ছোট সুতোর খেই ধরে আস্তে আস্তে সবই মনে পড়তে শুরু করে। এ এক অদ্ভুত খেলা। স্মৃতি সব সময় হয়তো সাথ দেয় না, তাতে কি আছে! কিছু স্মৃতি এতো দগদগে হয়ে বসে থাকে, যাতে একটু মনের উপর জোর দিলেই কেমন যেন সেই জমাট বাঁধা অন্ধকারের মতো জট পাকিয়ে যাওয়া লাটাই থেকে একটু একটু করে গিঁট খোলার মতো করে সুতো খুলতে থাকে। আস্তে আস্তে মনে হয় যেন সেই সময়টায় ফিরে গেছি। তারপর আরো একটু, আরো একটু করে ভাবতে ভাবতে মনে হয় কেমন যেন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হচ্ছে ঘটনাগুলো। এটা আমার বেশ একটা মজার খেলা। সারাদিন ধরে সেই ঘটনাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে সেই সময়ে পৌঁছে যাওয়া: কেমন যেন এক ঘোরের মধ্যে থাকা! সবই খুব অদ্ভুত লাগে। তবে এই সময়ে আমি খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখেছি কিছু জিনিস বা কিছু মানুষকে আমি কিছুতেই মনে করতে পারি না, মানে তারা ঠিক সেই সময় কোথায় ছিল বা কি করছিল, কিন্তু এতটুকু মনে আছে যে সে ছিল বা কি বলেছিল, কিন্তু মনে করতে পারি না তার মুখটা। কি ভয়ঙ্কর অসহায় লাগে নিজেকে। এ যেন গোলক ধাঁধায় ঢুকে একটার পর একটা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ধাক্কা খাওয়া। আর যেটা মনে পড়ে না সেটা নিয়েই যেন বেশী করে ভাবতে থাকি, আর যেটা খুব সহজে মনে পড়ে, খুব সচেতন ভাবে ঘটনার সেই দিকটা আর ভাবি না। কিরকম এক অবাক হয়ে যাওয়ার মতো আমাদের মানসিক গঠন! প্রতি মুহূর্তে আমি অবাক হই, প্রতি বার আমি হেরে যাই মনের সাথে এই মানসিক যুদ্ধে। যেগুলো আমার মনে পড়ে সেগুলো আমার জয় মনে হয় না, আমার মনে হয় এই স্মৃতিগুলো নিয়ে আমার মন যেন খেলা করছে আমার সাথে, বার বার চ্যালেঞ্জ করছে আর বলছে:
- কি রে! পারলি না তো মনে করতে, ওইদিন সন্ধ্যাবেলায় ঠিক কোনখানে বসে মুড়ি খেলি? (১)
- কি অদ্ভুত মাইরি! বারবার মনে পড়ছে মুড়ি খেয়ে বেরুলাম আমরা তিনজনে একসাথে। (২)
প্রথমটা হল আমার হেরে যাওয়া। আর দ্বিতীয়টা যেটা আমার আপেক্ষিক ভাবে জয় মনে হচ্ছে, সেটাও আমার মনে হয় আমার হেরে যাওয়া। এ যেন এক সীমাহীন ফাঁদ। আমার মন ফাঁদ পেতেছে, আর আমি তাতে বার বার ধরা পরে যাচ্ছি। কিছুতেই আমার ভাবনাকে বের করে আনতে পারছি না। আমায় যেন চালনা করছে। আমার ভাবনার গতিপথ যেন ঠিক করে দিয়েছে। এ যেন সেই বাচ্ছা ছেলেকে গন্ডি কেটে খেলতে দেওয়া, যত খুশী ছোটাছুটি তুমি কর, কিন্তু গন্ডি পেরোলেই মায়ের ডাক, কি রে, কোথায় গেলি!
যাই হোক, দেখা যাক কতদিন এরকম চলে! একদিন আসবে সেদিন আমি হয়তো এই লড়াই করবো না আর। তবু তার আগে যা নিয়ে এতক্ষন ভাবছিলাম বা যার সূত্র ধরে ফেলে আসা একটা দিনের কিছু সময়ে কাটিয়ে এলাম তার কথা বলি।
সেটা হল একটা হলুদ লুঙ্গি। সত্যি বলছি, একটা ক্যাট-কেটে হলুদ রঙের লুঙ্গি।
কৌতূহল হবার মতো কিছু নেই, কারণ এ আমার যৌবনের কথা নয়, আর আমি জীবনে কখনো লুঙ্গি পড়ে শুই না। প্রথমেই বলেছি যে, কি যে মনে পড়ে আর কেনই বা মনে পড়ে তার কোনো যুক্তি নেই। যাই হোক, সেই ভয়ঙ্কর হলুদ রঙের লুঙ্গি পড়ে  ফর্সা ধপ-ধপে একজন বাইশ-তেইশ এর যুবক খালি গায়ে বাড়ির বাইরে বেড়া-কলমী র ডালে ঘেরা ফুল বাগানে সকাল দশটার সময় দাঁত মাজছে। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগের সকাল। আমার মামার বাড়ির গ্রাম। গরমের সময়। আমাদের ছেলের দল কে দেখেই সেই ছেলের প্রথম প্রশ্ন:
-কি রে, সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস? কাল রাত্রে যাত্রা দেখলি?
না, আর গল্পের মতো কিছু নেই। ছোটবেলায় আমি প্রায় সব ছুটিতেই মামার বাড়ির গ্রাম এ যেতাম। আমার বড় মামার দুই ছেলে একজন আমার থেকে একবছরের ছোট আর একজন একবছরের বড়। তাই আমরা তিনজনে ছিলাম কখনো 'ফাইভ-সিক্স-সেভেন' বা কখনো 'সিক্স-সেভেন-এইট', তাই তিনজনে নরক গুলজার ছোটবেলা থেকেই একসাথে করতাম। আর ওদের বন্ধুরাও ছিল আমার বন্ধু। আমাদের বেশ তখন প্রায় দশ বারো জনার একটা গ্রুপ ছিল। দুপুরে পুকুরে ঝাঁপানো, বিকালে ক্রিকেট, সন্ধ্যায় পড়তে বসা মাস্টার দাদুর কাছে - সবই ছিল একসাথে। তারমধ্যে আমরা তিনটে আবার এক বাড়ির। তাই সেই সময় আমাদের কাটতো ভালোই। তবে সেসবের অনেক গল্প আছে। সেসব পরে হবে। আজ শুধু 'হলুদ লুঙ্গি'।
সেবার জগদ্ধা পুজোয় মামার বাড়ি গেছি। সকাল থেকেই অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে আমাদের তিন মূর্তির। সেসব আমার কিছু মনে নেই। যা মনে পড়া নিয়ে শুরু করে ছিলাম তা হলো পরের দিন সকাল বেলায় হলুদ লুঙ্গি পরা কোন এক দাদার প্রশ্ন। এর পর ভাবছি আরে! একে কোথায় দেখলাম! ভাবছি। এটা আমি কিন্তু সেই সময় ভাবছি। মানে আমার ছোটবেলায় ভাবছি। একটু পরে মনে পড়লো। ও বাবা! তাই! নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছি না। যাই হোক, যা ঘটেছিল, যা আজ আমার মনে পড়ছে তা হলো, পুজোর সময় প্রায় তিন চার রাত যাত্রা হতো। তার মধ্যে একদিন গ্রামের বড়রা যাত্রা করতো। সেবার কি যাত্রা ছিল তা আমার আজ মনে নেই। যাত্রায় কি হয়েছিল তাও মনে নেই। তবে যেটা মনে না পড়লে 'হলুদ লুঙ্গির' গল্পটাই হয় না সেটাই বলি। গ্রামের বড়লোক চক্রবর্তী মশাই। প্রায় ছোটখাটো জমিদার। গ্রামে প্রভাবও তাঁর খুব। সবাই খুব মান্য করে। কিন্তু তা দিয়ে যাত্রার গল্প কি চলেছিল আমার মনে নেই। যা মনে আছে তা হলো, চক্রবর্তী মশাই এর একমাত্র ছেলে হলো এই আজ সকালে হলুদ লুঙ্গি পড়া ছেলেটি। মাতাল, লম্পট চরিত্রে অভিনয় করছিল। স্টেজে উঠলো দেখার মতো করে, মনে রাখার মতো করেই। তাই তো সেদিনও মনে ধরেছিল আর আজও এতদিন পরেও মনে আছে। পরনে কালো টাইট প্যান্ট (অমিতাভ স্টাইল), লাল বুকের সাথে সেঁটে বসা সিল্কের জামা (লাইট পড়ে চকচক করছিল), চুল ব্যাক ব্রাশ করা, ঝুলপি কাটা( মিঠুন স্টাইল), মাথায় ব্যান্ড  (তিনরং এর, টেনিস প্লেয়ার রা আগে যেগুলো পড়তো। এটা কেন স্টাইল হয়েছিল কে জানে),  পায়ে সাদাবুট (জিতেন্দ্র স্টাইল, কোথায় পেয়েছিল, কে জানে) , কাঁধে কালো জিন্সের জ্যাকেট একহাতে ধরা, আর একহাতে অজস্র কালো ব্যান্ড আর স্টিলের বালা: চক্রবর্তী মশাই এর ছেলে শহর থেকে গ্রামে ফিরছে, মা বাবা স্টেজের উপর দাঁড়িয়ে। ছেলের আসা বেশ চমৎকার। তার আগে পর্যন্তই যাত্রার মাঝে যেটুকু কথা চলছিল, তা একদম চুপ হয়ে গেল মোটর বাইক এর ফ্যাট -ফ্যাট আওয়াজে ( গ্রামে সাকুল্যে হয়তো দুটো মোটর সাইকেল, ইয়ামাহা আর.এক্স.হানড্রেড আর একটা বাজাজ চেতক, যার একটা ওর নিজেরই, আর ওই আওয়াজ কারণ বাবু সাইলেন্সার খুলে দিয়েছে চমক দেবে বলে) সেই মোটর সাইকেল চেপেই সোজা স্টেজে হাজির 'ব্যাঞ্জো'। হ্যাঁ, চক্রবর্তী মশাই, মানে নারায়ণ চক্রবর্তী র ছেলে ব্যাঞ্জো। কি করে এরকম নাম হয়! কে জানে? তো স্টেজ এসেই মোটর সাইকেল স্ট্যান্ড করেই প্রথমে জ্যাকেট খুলে কাঁধে ফেলে সিগারেট ধরিয়ে নিলো। মুখটা চকচক করছে আলোর ঝলকে, জামাও ততোধিক। হাবে ভাবে মাতাল মাতাল ভঙ্গি, পা টলো-মলো, মুখে কি একটা চিবুচ্ছে, ঠোঁট লাল। মায়ের দিকে একটু এগিয়ে প্রণামের মতো ভঙ্গি করেই বাবাকে কি যেন বললো। কিছুই শোনা গেল না। দর্শকমহলে প্রচন্ড গুঞ্জন। কে একজন চেঁচিয়ে বলে উঠলো: 'ওরে তোর বাবা কাকা রয়েছে এখানে, তুই সিগারেট ফুঁকছিস!'
যাই হোক, সে বাবু তো আবার বাইকের সেই ভয়ঙ্কর আওয়াজ তুলে অন্য দিক দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গেল।
আমার গল্পের ইতি এখানেই।
না, আমার আর কিছুই মনে নেই। সেদিন আর 'ব্যাঞ্জো' বাবু আর স্টেজে উঠেছিল কিনা, উঠলেও আর কি কি কীর্তি দেখিয়েছিল তা আমার আর কিছুই মনে নেই। কিন্তু আমার আরো অনেক কিছু খুব ডিটেলস এ মনে আছে। যেমন যাত্রা শেষে 'ব্যাঞ্জো' দা বন্ধুদের সাথে কালভার্টের পাশে সিগারেট ফুঁকছিল। 'ব্যাঞ্জো' দা আমাদের ই সেই সময়ের এক বন্ধুর দাদা। ব্যাঞ্জো দার কি নাম, কি করে সব মনে পড়ছে । কিন্তু অদ্ভুতভাবে কিছুতেই মনে পড়ছে না ওদের মাঝের ভাইয়ের নাম, যদিও সেও আমাদের সাথে খেলতো। থাক আজ, এই নাম পরিচয়ের পালা।
না, সেদিন সকালে 'ব্যাঞ্জো'দার ওই প্রশ্ন ছাড়া আর কিছুই তো মনে নেই। শুধু ওইটুকুই। সেদিন সকালে মনে হয়েছিল স্বপ্নের নায়ক (যদিও তা কিনা, সেই নিয়ে সন্দেহের জায়গা আছে। কারণ 'ব্যাঞ্জো' দা বাস্তবে ওরকম ছেলেই ছিল না। আপাদ-মস্তক ভালো ছেলে, মাস্টার মশাইয়ের ভাইপো, গ্রামের পরোপকারী, সব কাজে ঝাঁপিয়ে পরা, খেলা আড্ডায় মেতে থাকা একজন। এখন মনে পড়ে, তখন আমি বেশ কিছু বছর যাবৎ 'ব্যাঞ্জো' দার ভক্ত হয়ে ছিলাম। বেশ খোঁজ খবর নিতাম কি করছে, কি বলছে।)
গল্প শেষ। আসলে গল্প নয় আমার অর্থহীন কথার ভান্ডার ফুরিয়ে গেছে। 'জিবেরিশ' বা 'নন-সেন্স' কথার মালা তো আমাদের সারা জীবন জুড়েই।
আবার অন্য কোনদিন অন্য কোনো স্মৃতি নিয়ে নিজের মনের সাথেই না হয় লড়াই চালিয়ে যাবো আর যতক্ষন না জিতবো ততবারই না হয় এই হেরে যাওয়া 'নন-সেন্স' কথামালা লিখে যাবো।

Comments

Popular Posts