নিখিলদা, কথা রাখলে না কিন্তু!

#নিখিলঘোষ


নিখিলদা, কথা রাখলে না কিন্তু!



জীবনে চলার পথে সাথে থাকা কাছের মানুষরা দূরে চলে যাচ্ছে আর ক্রমশ খালি হয়ে যাচ্ছি আমি। যাদের ঘিরে থাকা আমার জীবনকে শুধু দু হাত ভরে দিয়েছে, তাদেরকে কেমন করে হারিয়ে ফেলছি যত দিন যাচ্ছে। ঘটনার প্রবাহ আমার জীবনকে স্থবির করে না দিলেও, দিনের শেষে নিজের কাছে প্রশ্ন করি,
- এবার ট্রেকে যাবার আগে কে খাতা-পেন নিয়ে লিস্ট করে দেবে?
জানি, আজকের গুগলের দুনিয়ায় কাওকে লাগে না হয়তো, তবুও! আমরা তো তোমার কাছেই শিখেছি প্রতিটা ট্রেকের খুঁটি-নাটি। হাতে ধরেই প্রায় শিখিয়েছিলে সব তুমি। শুধু আমায় নয়, আমাদের অনেককেই, এমনকি আমার দুই ভাইঝি কেও। এরপরের বার কাকে জিজ্ঞাসা করবো যাবার আগে! জানিনা। তোমার দূরে চলে যাওয়া আমায় ব্যথিত করে না, কারণ আমি জানি আমার পাহাড়ে প্রতিটা পা, প্রতিটা বাঁকে এক ঝটকায় রুক-স্যাক তুলে মাথা নামিয়ে হাঁটায়, প্রতিটা পাথরে বসে একটু জলে মুখ ভিজিয়ে নেওয়ায় তুমি আমার পাশেই থাকবে। আসলে আমি ভয় পাই, আমার তো তুমি ছিলে সব পাহাড় জিজ্ঞাসায়, কিন্তু আমার পরের প্রজন্মের কাছে তোমার মতো করে আমি থাকবো কি করে!
আমার জীবনে আসা তোমার খুব কম দিনই। সহকর্মী হলাম যেদিন সেদিনই জানতাম তোমার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয়েছে আমার পেন-পেন্সিল ধরার আগেই। কিন্তু তোমার মত সহকর্মীকে আমি চিনেছিলাম তো অন্যভাবে। আমায় অনেকে বলেছিল তুমি কানে কম শুনতে পাও। আমিও তাই জানতাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমি বুঝলাম, তুমি হিমালয় ( মানে পাহাড় সংক্রান্ত) আর ফিজিক্স ছাড়া অন্য কিছু শুনতে পাও না সে তোমায় যতো জোরেই বলা হোক না কেন! আর অন্য ঘরেও কেউ হিমালয় নিয়ে কথা বললে তুমি ঠিক শুনতে পেতে। আর ফিজিক্স যে কি তা তো আমাদের স্টাফ-রুমের টেবিল থেকে শুরু করে প্রতিটি ছাত্রই জানে। আমার দুর্ভাগ্য আমি তোমার ফিজিক্সের ছাত্র হতে পারিনি, তবে আমার সৌভাগ্য যে আমি তোমার হিমালয়ের ছাত্র হয়েছিলাম একদিন। আজও আমি তোমার সেই হিমালয়েরই ছাত্র।
জীবন সম্পর্কে তোমার উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা অথচ কি গভীর জীবন বোধ যার ছায়ায় আমরা ছিলাম নির্ধিদ্বায়।
কিছু ঘটনা যা আজও আমায় ভাবায়। কেন তোমার মতো ভাবতে পারি না!
শিহালদহ স্টেশন। আমরা কয়েকজন। সান্দাকফু ট্রেকে যাবার জন্য ট্রেন ধরবো। তুমি সাথেই আছো। আমার দুই ভাইজিও আছে। ওদের প্রথম ট্রেক। আর আমার বড় ভাইজির পায়ে তার আগেই সার্জারী হয়েছে। আমাদের টিমে ওদের প্রায় শেষ মুহূর্তে নিয়েছি। তাই তুমি কিছুই জানতে না। তুমি তো এটাও জানতে না যে তোমার নামে কোনো টিকিট ই নেই। কারন কিছুতেই কনফার্ম হয় নি। স্টেশনে এসে একবার বললে যে, 'টিকিট টা দে তো, লিস্ট দেখে আসি।' মৃণালদা বললো যখন যে তোমার দেখার দরকার নেই, তুমি আর কোনো প্রশ্ন না করেই ট্রেনে উঠলে। মৃণালদা আবার যখন জিজ্ঞাসা করলো, 'ওই মেয়ে দুটো কে বলো তো!' তুমি বললে, 'আমাদের ছাত্রী নাকি! ছাড়তে এসেছে কাওকে!' ট্রেনে উঠে যখন জানলে যে ওরা আমাদের সাথেই যাবে তখন থেকে ট্রেক শেষ করার দিন পর্যন্ত আমার ভাইজিদের তুমি ওদের বাবার মতো করেই রেখেছিলে। আমায় কখনো ভাবতে হয়নি যে ওরা প্রথম ট্রেক করছে! ওরা আজও তোমার কথা বলে। তার পরেও আমরা অন্য ট্রেকেও গেলেও তোমার অভাব সব সময় অনুভব করেছি। ওদের কাছে তুমি হলে ট্রেকের আদর্শ। আমি গর্বিত যে ওরা জীবনে তোমার মতো একজন মানুষের সান্নিধ্যে জীবনের কিছু ভালো দিন কাটিয়েছে। ওদের পাহাড়-জীবনের ঝুলি উপচে যাবে আগামী দিনে তোমার স্পর্শে। তোমার মতো করেই আমিও যদি কারোর পাহাড়-জীবনের প্রথম পদক্ষেপে থাকতে পারতাম!
আমাদের কয়েকজনের কাছে তুমি কি তা আমি কোনোদিনই ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। সবার কথা না হয় সবারই থাক, শুধু আমাদের মধ্যেই থাক। আমি শুধু এটুকু জানি, যে কয়েকজন সহকর্মীকে আমি আমার পড়াশোনার জীবনে শিক্ষক হিসেবে পেলে গর্ব বোধ করতাম তাদের মধ্যে তুমি একজন। মৃনালদার প্রশ্ন আর হয়তো জ্বালাবে না, উৎপল আর কাকা বলে হয়তো ডাকবে না, তবুও মাঝে মাঝে সারাদিনই তুমি থেকে যাবে আমাদের সাথে। যেমন করে কাল তোমার খবর শোনার পর থেকে আজ সারাদিন আমরা তোমায় নিয়ে কাটিয়ে দিলাম। আমাদের সাথে তুমি কেন মিশলে? আর যদিও বা মিশলে কেন কথা না রেখে চলে গেলে!
তোমার একটা ছোট্ট কথা যে এবার আমাদের সবাইকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। অর্ধেক হিমালয় ঘুরে আসা মানুষটা সেদিনও আমাদের বলেছিল যে, 'চল, একবার হর-কি-দুন ঘুরে আসি।' আমরা সেই অর্থে খুব একটা পাত্তা দিই নি। ডানকুনি র নার্সিং হোমে তোমায় দেখে সেদিন ও বললাম, 'ঠিক হয়ে নিন, যাবো।' আর আপনি বার বার শুধু বলছিলেন 'আমার সব কাজ শেষ হয়ে গেছে।'
ধুর! কি যে করলেন!
জানেন, আগের সপ্তাহে একদিন ভোর বেলায় আমার কি হয়েছিল! ঘুমের ঘোরে আমি দেখছি আপনি জোর করে আমায় তুলছেন, যেমন করে ট্রেকের দিন সকালে ওঠাতে শুরু করতেন। ' নে, নে ওঠ এবার! অনেক হয়েছে!' ঝেড়ে-মেরে উঠে পড়লাম বিছানায়। আর ভাবতে পারি নি। স্কুলে গিয়েই সবাইকে বললাম। তোমার খোঁজ নিলাম, ঠিকই আছো। তারপর কি হলো!
কি করলে তুমি এটা!
বড় অভিমান করে চলে গেলে তুমি!
তুমি তো কখনো আমাদের পাহাড়ে একা ফেলে চলে যেতে না!
সবার পিছনে তুমি উঠতে!
তোমার সবুজ রুক-স্যাক টা খারাপ হয়ে গেছে, পাল্টাতে হবে যে!
আমাদের সাথে আবার পাহাড়ে যেতে হবে তো!
আমার শিক্ষক, সহকর্মী, দাদা, বন্ধু নিখিল ঘোষ বাবু বলতে আমি সবসময়ই জানি হিমালয় আর ফিজিক্স নিয়ে জীবনে চলা এক মানুষ, যে কখনো কোথাও হারিয়ে যেতে পারে না! ওই হাসি মুখ আর অপছন্দের কথা না শুনে ভাবলেশহীন হয়ে থাকা মানুষ কোথাও যায় না, প্রিয়জনদের সাথে সব সময়ই থেকে যায়!
তুমিও এরপর রয়ে গেল আমাদের সাথে সবসময় সব রাস্তায়, কারণ তুমি যে কথা রাখলে না!

Comments

Popular Posts