খেয়ে-বেড়ানো (২): পুরুলিয়ায় কি ক্যাপসিকামের চাষ হয়!


#খেয়ে-বেড়ানো (২)

#পুরুলিয়ায় কি ক্যাপসিকামের চাষ হয়!


এবার খেয়ে-বেড়ানো আমাদের খুব ভালো কেটেছে না খারাপ, সেসব পরে ভাবা যাবে। আগেই বলে রাখি, বেড়ানো আমার কাছে আজকাল যতোটা না ঘুরে বেড়ানো হয়, তার থেকে বেশী খেয়ে-বেড়ানো হয়। এবারেও সেই ইচ্ছাই ছিল। তবে ঐ যে বলে না, তুমি যতোই ভাবো, যা হবে তা তো আগেই ঠিক করে রেখে তিনি হাসছেন। আজকাল আমি আগে থাকতেই ভেবে রাখি যে কবে কোন সময় কি খাবো বা কি কি খাবো। সেরকম ভাবেই প্রায় সব প্ল্যান করেই রাখি আর প্রায় সবই যখন মিলিয়ে খেতে পারি, বেশ নিজেকে কেউ-কেটা মনে হয়। আজকাল কি খুব লোভী হয়ে যাচ্ছি! কে জানে! তবে সেই যে কবি বলেছে না, 'আমার তো বাবা লোভ নেই, আর চার-পাঁচ পিস হলেই হবে!' আমারও তাই! লোভ একদমই নেই, তবে দু-চার পিস পেলেই হয়!
#শুরু থেকেই না হয় শুরু করি!
ইচ্ছা ছিল সক্কাল সক্কাল দুর্গাপুরের আগে বাঁশকোপায় জমিয়ে ব্রেকফাস্ট করবো। ড্রাইভার লেট করায় গিয়ে যখন পৌঁছালাম তখন বললো যে আমরা নাকি 'টু আরলি ফর ব্রেকফাস্ট এন্ড টু উ লেট ফর ব্রেকফাস্ট', তাই কিছু হবে না। অগত্যা দুর্গাপুরের এক মল এর ফুড-প্লাজার শরণাপন্ন হলাম। তারা আবার বলে, 'এই তো ঝাঁপ খুলেছি, শুধু ছোলে-বটরা হবে! অগত্যা তাই হোক! ভালোই খেলাম কিন্তু মনটা খুঁত খুঁত করতে শুরু করলো। শুধুই মনে হচ্ছে কেমন যেন আমার হিসাব মিলছে না। মানে ওই আরকি! ভালো হলেও আমার মতো করে হচ্ছে না। যাকগে, যা হবে হোক! আমার তো অতো লোভ নেই! পৌঁছালাম দুপুরে বড়ন্তি। যাবার আগে থেকেই আশা করে ছিলাম তিনদিন বৃষ্টি হবে, আর আমি বসে শুধু খাবো, ঘুমাবো আর দু চোখ ভরে পাহাড় জঙ্গল দেখবো। সে গুড়েও বালি! কাট ফাটা রোদ, গাড়ীর এসি বন্ধ না করেই পৌঁছালাম। ভেবেছিলাম জানলা খুলে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি মেখে পৌঁছাবে! যাক, সে যখন হলো না এবার খাবারে মন দিই।
দুপুর থেকে রাত হয়ে দুপুর, আর পরের রাত হয়ে সকালের জলখাবার: এই ছিল আমাদের সাথে রিসোর্টের ম্যানেজার বাবুর পেট-চুক্তি। আহা, পেট-চুক্তি মানে কিন্তু সেইরকম আমাদের ভেবো না, যে হাঁড়ি খালি অবধি আমরা শুধু ডাল দিয়েই চেখে যাবো! যাই হোক, ভাত, ডাল, আলু ভাজা আর আলু পোস্ত দিয়ে সাদা থালা এলো সামনে। দেখেই কেমন মনটা অসন্তুষ্টিতে ভরে উঠলো। যাকগে, খাই তো আগে! খিদে যা পেয়েছে! শুরু করলাম। এবার এলো মাছের ঝাল, চাটনী আর পাঁপড়। খাচ্ছি সবই কিন্তু কি একটা যেন বুঝতে পারছি না। পাশা-পাশি সবাই খাচ্ছে আর কি যেন গুন-গুন করে বলছে। আমি এসব খুব একটা কান দিই না। আমার মতোই কেউ একজন আলু-পোস্ত চাইলো যেন! চেয়েও পেলো না। কি হলো ব্যাপারটা! মানে, 'ওই যে, আপনাদের দুজন ড্রাইভার খেয়েছে, তাই আর নেই!' আচ্ছা, ঠিক আছে। খেয়াল করলাম কিছুক্ষন বাদে যে খেলাম যদিও কিন্তু মন ভরলো না। কেন এরকম হচ্ছে। আসলে আমি যে কোন খাওয়া খুব যত্ন করেই খাই। বুঝলাম, কোন খাবারেরই কোনো স্বাদ নেই। এটা কি করে সম্ভব! এবার একটু একটু করে আবিষ্কার করলাম যে কি এক অদ্ভুত প্রতিভায় রান্না হয়েছে যে ডাল থেকে আলু-পোস্ত হয়ে মাছের ঝোল, সবেতেই ক্যাপসিকাম। ভাবা যায়, আলু-পোস্ততে ক্যাপসিকাম! বর্ধমানের লোক আমরা, আমাদের রোজকার খাবার আলু-পোস্ত, আর তাতে কিনা ক্যাপসিকাম! বুঝে গেলাম কার হাতে পরেছি আর বাকি দিন কি যাবে! মাছ বাদে সব কিছুই এক পাতে ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে! এ কোথাকার লোক! সাজিয়ে গুছিয়ে খেতে দিতেও জানে না! মোটা চালের ভাত আর ক্যাপসিকাম দেওয়া কলাইয়ের ডাল আর মিইয়ে যাওয়া আলু-ভাজা! এত দূরে এসে লেকের পাড়ে বসে চালানী মাছের ঝোল! এরসাথেই ছিল ম্যানেজার দাদার ডায়লগ! বুঝতে একবেলা লাগলো যদিও তবে এটা বুঝলাম আর যাই হোক এ লোককে দিয়ে মালিক রিসোর্ট ব্যবসা বেশীদিন চালাতে পারবে না।
রাত্রে দেশী মুরগীর ঝোল বলে যা দিলো তা হলে নিখুঁত ভাবে মেশানো দেশী আর পোল্ট্রি মুরগীর ক্যাপসিকাম দেওয়া ঝোল। সে যাই হোক, রান্নাটা ভালোই হয়েছিল। সন্ধ্যায় চিকেন পাকোড়া আর চা। ওহ! আসল কথাই তো বলতে ভুলে গেলাম। চা! এ যে কি চা! চিরতার জলে কালো রঙ গুলে গরম করে কি এক জিনিষ দিচ্ছে, তা মোটামুটি একবার খেলে বেশ কয়েক ঘন্টা চা পানের ইচ্ছাই চলে যাবে। ঠিক আছে, এবার দুধ-চা! সেই একই জিনিস। শুধু ওর সাথে একটু দুধ গুলে দিয়েছে। বাদ দাও ওসব, আজ দিন খারাপ শুরু হয়েছিল, তাই না হয় সবই বাজে হয়েছে। কাল সব ভালো হবে।
#এবং আবার ক্যাপসিকাম!
সকাল সকাল উঠে একটু ঘুরে এসে জলখাবারে বসলাম। লুচি, ছোলার-ডাল আর ডিম সেদ্ধ! ছোলার ডালে আবার ক্যাপসিকাম! লুচির সাথে ডিম সেদ্ধ! এ কোথাকার ম্যানেজার রে! একে কেন মালিকরা এখানে রেখেছে! মালিকের রিসোর্ট ব্যবসা তুলে দেবার জন্য এ তো একাই যথেষ্ট। দুপরে আবার সেই এক পাতে ডাল, আলু ভাজা, পটল আলু তরকারি আর চালানি মাঝের ঝোল! ক্যাপসিকাম দিতে যদিও ভোলেনি। যদিও চালানি মাছকে ম্যানেজার দাদা আমাদেরকে বড়ন্তি লেকের মাছ বলে চালাতে চাইলেন! ভাবলাম একবার বলি, 'দাদা, আমরা গ্রামের মানুষ তো, লেক আর পুকুরের মাছের পার্থক্য বুঝি না!' যাই হোক, খেতে বসি দেখি, ভাত সবে গলে পাঁক। ভাবলাম এবার কিছু বলতে গেলে হয়তো বলবে ভাত এরকমই হয়। থাক না হয়। অনেকেই না খেয়েই উঠে গেল। আমি আর কি করি! চুপচাপ গর্ত বোজালাম।
এর মাঝেই ম্যানেজার দার ঘোষণা: আজ রাতে খাসির মাংস হবে!
সবার মুখে একটাই উত্তর: আর যাই করুন, ক্যাপসিকাম দেবেন না।
সন্ধ্যায় দাদাকে চিকেন ফ্রাই এর বদলে বললাম ভেজ কিছু দিন। ওনার নাম দেওয়া 'ফিঙ্গার বেগুন', মুড়ি আর চানাচুর দেখে সত্যিই বাড়ীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
রাতের খাবার নিয়ে আর বেশী কিছু বলে লাভ নেই। খাসি ভালোই হয়েছিল। খাসি না মাসি সে সব নিয়ে বিশদ আলোচনায় নাই বা গেলাম। তবে দেখলাম কয়েকজন এই রিসোর্টেই আছেন যারা দু-বেলা নিজেদের রান্না নিজেরাই করে নিচ্ছেন। বুঝলাম, না জেনে শুনে এসে খুব ভালো কিছু করি নি!
বেশ মজাদার মানুষ কিন্তু এই ম্যানেজার দাদা। সকাল-বিকাল বেশ ভালো ভালো ডায়লগ দেন, হাব-ভাব মোটামুটি সবজান্তা কালীঘাটের গেঞ্জিওলাদের মতনই! বাড়ীও ওনার ওই ধারে-পাশেই। পরদিন সকালে নিজেই লেগে গেলেন জলখাবারে আমাদের লুচি নিজে ভেজে পরিবেশন করতে। আবার খেতে বসেই দেখি সবাই এদিক ওদিক তাকায়। কেউ একটা কেউ একটুকরো খেয়ে উঠে পড়ছে। কি হলো! আমি তো তখন তিন-খান খেয়ে নিয়েছি। দেখি লুচি গুলো চপের মতো সাইজ আর একটু ও না-ফোলা কাদা-কাদা! দাদা কে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল যে ময়দা নেই তাই আটা দিয়েই উনি বানিয়েছেন। মাইরি! এরম এক লোককে দায়িত্ব দিয়ে মালিক রিসোর্ট চালাচ্ছে! কোনরকমে গুছিয়ে বাড়ীর পথে রওনা হলাম। ফেরার পথে বর্ধমানের কাছে এসে ছেলে-মেয়ে দুটোকে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট একটু খাওয়ালাম। আহা রে! বেচারারা কোন সকালে প্রায় না খাওয়া হয়েই বেড়িয়েছে! আজ পুজোর দিন!
আসলে আমাদের এবারের বড়ন্তি বেড়ানো নিয়ে আলাদা করে বলার কিছুই নেই। গেলাম, থাকলাম আর ফিরে এলাম। এরকম ভাবনাতেই গিয়েছিলাম। শুধু দু- বেলা জমিয়ে খাবো আর শুয়ে গল্পের বই পড়বো বা আড্ডা দেবো এটুকুই চাওয়া ছিল। সবই হয়েছে, কিন্তু ওই যে জমিয়ে খাওয়া যাকে বলে, তাতে মোটামুটি নুন-জল ঢেলে দিয়েছেন আমাদের প্রিয় ম্যানেজার দাদা। স্যালুট দাদা আপনাকে আমার পূজোর ছুটির শুরুটা ক্যাপসিকাম দিয়ে চটকে দেবার জন্য। আসার পথে আমি শুধু পুরুলিয়ার মাঠ -ঘাট জুড়ে ক্যাপসিকামের খেত খুঁজে বেড়ালাম!
** আমার সাথে এবার আমার অতি সজ্জন দুই বন্ধু আর তার পরিবার গিয়েছিল। তারা আমায় এরকম এক রিসোর্ট খুঁজে বের করার জন্য যে মার-ধোর করে নি তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
** বিশ্বাস করুন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে স্কুল থেকে বেড়াতে গিয়ে ষাট টাকা চুক্তি তে মাছ ভাত খেয়েছি, সেখানেও কেউ জল হাতে পাতে লেবু-পেঁয়াজ-লঙ্কা হাত থেকে গড়ানো জল সমেত দেয়নি। এই ম্যানেজার দাদা রিসোর্টটাকে এক অন্য লেভেলে নিয়ে গেছে!
*** দয়া করে কেউ নাম জানতে চাইবেন না। কারণ কাওকে সতর্ক করতে আমি লিখতে বসি নি। আমার লেখার উদ্দেশ্য একটাই আর সেটা সেই কবির কথা।
'সব জায়গায় তুমি পবনদা পাবে না!' কবির কথা মেনে নিয়েছি, কিন্তু এটাও তো সত্যিরে ভাই, 'পবনদা না পেতেই পারি, ফরাসী নামে রিসোর্টের নাম দিয়ে স্টার হোটেলের পয়সা নিয়ে তুই ক্যাপসিকাম দেওয়া আলু-পোস্ত খাওয়াবি! শা*, শু*য়ে* *চ্ছা!! দাদার কিছু কথা তো স্মৃতি হয়ে আমার মাথায় ঢুকে গেছে। আজও বেরুচ্ছে না। 'আমার এখানে তো সবাই রেফারেন্স নিয়ে আসে। আমি জায়গাই দিতে পারি না!' বিশ্বাস করুন, নিজেকে কি ছোট মনে হচ্ছিলো! আমায় তো কেউ একটাও রেফারেন্স দেয় নি! আবার ভাবছিলাম, কারা তারা যারা এখানের রেফারেন্স তাদের বন্ধুদের দেয়! আমি তো আমার বন্ধু কেন অচেনা কাউকেও দেবো না! দাদার পরের স্মরণীয় উক্তি, 'এখানে আমি কাউকে মদ খেয়ে মাতাল হতে বা বেশী ফুর্তি করতে দিই না!' আমি এবার নিজেকেই সত্যিই ছাত্র মনে করতে শুরু করেছিলাম! এমন বিহ্বল হয়ে মাস্টার দাদার কথা শুনছিলাম যে বন্ধু আমায় ডেকে পিছনের লনে নিয়ে গিয়ে দেখালো যে চারিদিকে শুধু বোতল আর বোতল! দাদা সত্যিই গুরুদেব! পুরুলিয়ায় জনহীন প্রান্তরে রিসোর্টের ম্যানেজার বলছে মদ্যপান এখানে বর্জনীয়! সত্যিই ভাবার মতো! আমার বেশ ভালো লেগেছে
দাদাকে। শুধু বলছি, 'মালিক জানে তো!'
*** খেয়ে-বেড়ানো (২) নামটা হয়তো যথোপযুক্ত নয় আমার আগের খেয়ে-বেড়ানো লেখাটার সাথে। কিন্তু সব সময়ই যে আমার মতো হবে না, সেটা আমি ভাবা ভুলে গিয়েছিলাম। তাই এটাও আমার আর এক খেয়ে-বেড়ানো।
*** আগের 'খেয়ে-বেড়ানো', যা আমায় লোভী করে তুলেছিল, তার লিঙ্ক দিলাম। সময় পেলে দেখবেন।
https://sagarswati.blogspot.com/2019/06/blog-post.html


7Oct2019

Comments

Popular Posts