আপনি এখনো শোনেন নি?


আপনি এখনো শোনেন নি?
আমি জানি, আপনি এখনো শোনেন নি।
(ভুল বললাম একটু, আমরা সবাই জানি)
আমরা সেদিনও জানতাম আপনি কিছুই নিজে শোনেন না বা দেখেন না, মধ্যমেধার কিছু দালালের কথায় আপনি সমাজ বা মানুষ চেনেন আর তার বিচার করেন।
অনেক, অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। আজও সেই ধারা চলে আসছে। 'উন্নততর' হবার বুলি শুনিয়ে আপনি যখন নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাতেন, তখনও বুঝিনি স্বপ্ন দেখানোর লোকটাই জানে না যে কিভাবে স্বপ্ন দেখতে হয় বা দেখলে কেমন করে তাকে বাস্তবে পরিণত করতে হয়! মধ্য চল্লিশে এসে বুঝলাম, আপনি আসলে নিজেই দেখতে বা শুনতে পান না। শেষ বার কবে দেখেছিলেন বা শুনেছিলেন তা নিজেই ভুলে গেছেন। সেদিনের আঠারোর সবাই যখন আজ মধ্য চল্লিশে, আপনি কিন্তু সেদিনও প্রস্তরযুগের আর আজও তাই!
আসুন। একসাথে একবার শুনি।
চুপ করে কান পেতে শুনুন।
একবার নয়, বারবার।
জানি! এ ভাষার সাথে আপনার পরিচয় নেই।
তাই তো বললাম, একবার নয়, বারবার শুনুন।
কি বললেন! কিছুই বোঝা যায় না!
ঠিকই! তাই তো বললাম, আবার শুনুন।
দেখবেন আপনার কথাই বলছে।
কি ভাবছেন!
ভাববেন পরে। কি সাহসে আর কিসের জোরে সবার সামনে আপনার কথাগুলোই বলে যাচ্ছে! যে কথাগুলো শাসকের মুখের উপর বলার ছিল আপনার দেখুন, কি নির্দ্বিধায় বলে চলেছে সদ্য ত্রিশে পা-দেওয়া ছেলেটা!
কি বলছেন, এগুলো আপনার কথা নয়?
ভুল বলছেন আপনি। এগুলোই আপনার কথা।
আপনার বলার ভঙ্গিমা আর শব্দ চয়নে পার্থক্য
থাকতেই পারে, কিন্তু এগুলোই আপনার কথা।
কি? ওই পোশাক আর চুল?
ঠিক। এই তো এইবার আপনি আপনার লাইনে এসেছেন। দিন এবার অপসংস্কৃতির ছাপটা মেরে দিন।
সাথে উৎশৃঙ্খল আর বেলেল্লাপনা, আর কি কি যেন শব্দগুলো ব্যবহার করতেন!
বাজে শব্দ ব্যবহার করছে? খিস্তি দিচ্ছে তো!
ঠিক বলেছেন। আপনি বলছেন এই কথা! পেটে লাথ খাওয়া চাষীকে নিয়ে যেদিন 'লাঙল যার জমি তার' বলে জোতদার বাড়ী জ্বালিয়ে ছিলেন, সেদিন আপনার শব্দ চয়ন কেমন ছিল! না, আজ দীর্ঘ দিনের সযত্নে লালিত 'অন্য জীবন' আপনার ভাষাকে ব্যাকরণ সম্মত করে তুলেছে। শাসকের চোখে চোখ রেখে অধিকার ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ে আজ আপনি ভাষা, শব্দ শেখাচ্ছেন! না, দীর্ঘদিনের শাসক জীবন কি আপনাকে শাসকের সমব্যথী করে তুলেছে!
আবার বলছি, ভালো করে শুনুন। প্রতিটা শব্দ ভালো করে শুনুন। ওর প্রতিটা না-কবিতা, না-গান ভালো করে শুনুন। দেখতে হবে না আপনাকে। ওকে দেখার চোখ আপনার তৈরি হয়নি। হলে বুঝতেন, মঞ্চ জুড়ে ওর হাঁটা-চলা, চোখের ভাষা সেদিনের আপনার মতোই। সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতে জানে। প্রশ্নের জবাব হাতড়ে বেড়ায় না। সমাধান জানে।
হ্যাঁ। আমি আপনাকে EPR Iyer এর কথা বলছি। কি অদ্ভুত নাম বলুন! আসলে এই প্রজন্ম টাকেই তো চিনলেনই না! ওর আসল নাম শান্তানাম শ্রীনিবাস আইয়ার। আর EPR বলে নিজেকে পরিচয় দেয় যার পুরো শব্দ গুলো হল Emcee Poet Rapper.
কি হলো? র‌্য‌াপার শুনে কেমন কেমন লাগছে!
বেশী ভাবতে হবে না। ওটা এই প্রজন্মের অনেক ভাষার মধ্যে আর একটা সুপ্রচলিত এবং মনোরঞ্জনের ভাষা। এর বেশী জানতে হলে পড়াশোনা করুন। অনেককাল আগে শেষ পড়েছিলেন।
নিজেকে ও কবি বলে জানেন!
সাহস দেখেছেন!
নিজেকে গায়ক বলার থেকে কবি বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আর সর্বভারতীয় মন্ঞ্চ থেকে সংবাদমাধ্যম ওর এই লাফানো-চেঁচানোকে কি বলে জানেন?
প্রটেস্ট পোয়েট্রি।
ভাবতে পারেন?
দেখবেন আবার মঞ্চ বলছি মানেই এখন আবার ওই
এম টিভিকে গাল দিয়ে আবার পুঁজিবাদ আর আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের ফাটা রেকর্ড শোনাবেন না! ওসব জানি। জেনেছি-পড়েছি-আত্মস্থ করেছি, আপনার মত ফাঁকা বুলি আউড়াইনি। যাই হোক, ওই এম টিভির মঞ্চে ওকে লাইভ দেখেছিল কতজন সেই খবরটা একটু রাখুন। আপনার পেটোয়া কাগজ আর মিডিয়া যখন মহারাষ্ট্রের কৃষক মার্চের দীর্ঘ লাইন আর চাষীর রক্ত-ভেজা ফাটা পা দেখিয়ে ভারতবাসীর মন টলাতে পারেনি তখন শুধু ওই এম টিভির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ও নিজের সাথে ওর প্রজন্মের অধিকারের প্রশ্ন তুলেছিল ওর র‌্য‌াপ দিয়ে। এই প্রজন্ম কিন্তু একসময় সদ্য কলেজে পা দিয়ে এমনি এমনিই দাঁড়িয়ে যেত ডায়াস মিটিং বা স্ট্রিট কর্নার্রিং এ আপনার গলার শিরা ফুলিয়ে বলা যে কোন কথা শুনতে।
খেয়াল করে দেখুন আজ সেই প্রজন্মের এক জনও
নেই আপনার কথা শুনতে। এরকম তো হবার কথা ছিল না, বন্ধু! যাহা বিজ্ঞান, তাহা সত্য আর সেই বিজ্ঞান, সেই সত্য আর সেই আপনার কথা কেন এই প্রজন্ম শোনে না! ভুল বিজ্ঞান না সত্য হওয়া বা না হওয়ায় ছিল না, ছিল আপনার মধ্যে।
কতজন জানে ওর কথা!
আপনার জানার বাইরে যে জগৎ আছে, যে প্রজন্মের সাথে আপনি আর যোগাযোগ করতে পারছেন না তাদের বেশীর ভাগই ওর কথা জানে, ওর গান শোনে।
সদ্য যৌবনে পা রাখা ছেলেটা নিজের শহর ত্রিচি থেকে আপনার শহরে কলেজে পড়তে এসে শুধু ভালোবেসে আপনার কথা নিজের করে নিয়ে নিজের মতো করে সর্বভারতীয় মঞ্চে নিয়ে গেল।
পাশে থাকবেন না!
কি ভাবছেন আবার?
স্টুডিওর মঞ্চে নীল-সবুজ ফ্লুরোসেন্ট জামা-কাপড় পরে, মাথার চুল থেকে পায়ের জুতো পর্যন্ত এক চোখে লাগা ঝকঝকে উপস্থিতি তে লাল-নীল আলোর সামনে পাঁচ মিনিটের কম সময়ে কি এক পাগলের মতো লাফা-ঝাঁপি করে হিন্দি-ইংরাজি-বাংলা মিশিয়ে কিছু শব্দ যার মধ্যে গালাগালি ও থাকে কিরকম এক দমে শুধু বলে যায়!
কারা শোনে এসব?
ঠিক। এই এতক্ষনে আপনি ঠিক প্রশ্ন করেছেন। আপনি ঠিক দিকে ভাবতে শুরু করেছেন। শুধু এইটুকুই ভাবুন, কারা সেই মানুষ যারা এই চার-পাঁচ মিনিটের শুধু ওই পাগলের কথাগুলো শোনে! যারা একসময় আপনার কথায় স্বপ্ন দেখতো, আপনার প্রতিটা কথা বেদ-বাক্যের মতো বিশ্বাস করতো, সেই যে প্রজন্মটা দীর্ঘ সময় ধরে আপনার কথা আর শোনে না কারণ তেল-চুকচুকে ঘাড়ে পাউডার মাখা আপনাকে দেখেছে নাইকির জুতো আর নোকিয়ার ফোল্ড হওয়া ফোন নিয়ে আবালের মতো খোঁচা-খুঁচি করে নিজের আ-পড়া পান্ডিত্য ফলাতে সেদিনই বুঝে গিয়েছিল আপনি আর যাই হোক যা বলছেন তা নিজেই পছন্দ করেন না। তাই তো তারপরই আপনাকেই দেখিয়ে দিল যে, শুধু যে চে দিয়ে আপনি বিপ্লবের আগুন জ্বালাবেন ভেবেছিলেন সেই চে এর ছবি দেওয়া গেঞ্জি গায়ে দেয় আপনার সারা মাসের খরচের দামে একবর্নও চে না জেনেই। এসব আপনারই দান। সেই প্রজন্ম কিন্তু আজ ইপিআর আইয়ার এর কথা শোনে। তাই আপনিও শুনুন। এখানে কোন হিপোক্রিসি নেই। নেই কোন ছল-চাতুরী। নেই কোন অন্ধকার কানা গলির দিকে ঠেলে দেওয়া। সোজা কথা সোজা ভাবে শোনানোর গল্প। ও জানে কে ওর বন্ধু। কে ওর শত্রু।
না! এখানে নেই কোন 'পরিবর্তিত পরিস্থিতি' অনুযায়ী শ্রেণী শত্রু বদলানোর গল্প। নেই কোন মানিয়ে নিয়ে শত্রুর অল্প শত্রুকে বড়ো বন্ধু করে নেবার গল্প।
আবার আবার বলছি, কান কামড়ে বলছি ভালো করে শুনুন। আবার শুনুন। শুধু এই দশ বছরে ও যতগুলো বাক্য ওর কবিতা-গান-র‌্য‌াপারে বলেছে শুধু একবার ভেবে দেখবেন এগুলোর সব বাক্য গুলো কি আপনার হওয়া উচিত ছিল না! ও তো সব আপনার কথাগুলোই বলে চলেছে। আপনি কোথায়?
আপনি যেদিন কৃষিকে ভিত্তি করে শিল্পে ভবিষ্যতের কথা শুনিয়ে কৃষিকে সুরক্ষিত না করেই চলে গেলেন সেদিন থেকে আজকের এই দিশাহীন প্রজন্মকে আর আপনার কিছু শোনানোর গল্প নেই। আপনার বলা ভাষা বদলে নিয়ে এই প্রজন্ম এখন 'আপনা টাইম আয়েগা' বলে আর বিশ্বাস করে 'বহুত হার্ড, বহুত হার্ড, উই আর ইন্ডিয়ান'। বদলে গেছে ভাষা, বদলে গেছে প্রকাশের ভঙ্গিমা, বদলে গেছে মানসিকতা। আর আপনি?
এবার সব প্রশ্ন আপনি নিজেকেই করুন।
স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আপনি। দায় তো আপনাকেই নিতে হবে।
উন্নততর সমাজ ব্যবস্থার কথা শোনানো আপনি আজ এতো তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে দিশাহীন কেন! চারিপাশের মোসাহেবের ভীড় যে আপনাকে পাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে আপনি তো পথ দেখবেন এই প্রজন্মের সাহসের বলে বলীয়ান হয়ে।
আপনার কৃষক-শ্রমিক আজ যখন দু-পয়সার মাসিক বা বাৎসরিক দানে বা ধর্মের দয়ায় নিজের আশ্রয় হারিয়ে ফেলছে তখন তাদের কথা বলে যে, সে কেন আজও আপনার থেকে এতো দূরে। শুধু টাকা-পয়সা কামানো, নিজের প্রচার আর সেলিব্রেটি জগতে নিজের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবার গল্পের বাইরেও ওর আরো কিছু আছে যার ভিত্তি সততা আর সৎ সাহস যা একদিন ছিল শুধু আপনার। সেই আগের আপনাকে আজ আপনি চিনতে পারছেন না! কেমন অবাক লাগে আমার আজ!
***সেপ্টেম্বর ২০২০ কৃষিবিল পাশ হয় লোকসভায়। তার প্রক্রিয়া আর উদ্দেশ্য আমাদের অজানা নয়।
***এই গান প্রথম মঞ্চে আসে সম্ভবত ২০১৯ এর শেষ দিকে। না! আমি এর আগে ইপিআর আইয়ার কে চিনতাম না। তবে সেদিনের শোনার পর মনে হয়েছিল আমার বন্ধু, না-বন্ধু সবাইকে আমার জানানো উচিত ওর কথা। ধন্যবাদ আমার সেই জুনিয়রকে যে আমায় চিনিয়েছিল। শুধু বলবো, ফেসবুক, ইউ টিউব, ইন্সটা দেখে একটু ইপিআর কে জানা খুব কঠিন কিছু নয়। শুনতে পারেন দশটা গান। আর দশটার থেকে আলাদা কিছু যে সেটা মনে হয় আর আমায় বলতে হবে না। এই গানটার একটা ভিডিওগ্রাফি করেছে সৌরভ। দেখা যেতে পারে।
*** 'আপনি' আমার কোন পরিচিত বা কাল্পনিক ব্যক্তি নয়। তাই ব্যক্তিগত কোন আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। আপনার ব্যক্তিগত মতামত আপনার কাছেই থাকলে ভালো যদি তা কোনভাবেই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হয়।
22092020

Comments

Popular Posts