গুঁড়ো গুঁড়ো নীল, স্বপ্ন রঙ্গিন।। (৭)

সতেরোয় পা।

ষোল বছর পার করে দিল। দিনগুলো একটু একটু করে পেরিয়ে যাচ্ছে। আর যত দিন যাচ্ছে তত একটু একটু করে নিজের মতো করে নিজের জগৎ তৈরি করে নিচ্ছে। একটা সময় ছিল আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম, কি করতে হবে এরপর বা কি জামা পড়বে কাল বা কি খাবে বা কখন শোবে, কখন উঠবে - এই চিন্তায়। সবই শুনতো বা হয়তো শুনতে বাধ্য থাকতো ছোট ছিল বলে। আমার স্বভাবমতো আজও আমি সেই একই উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ি ওর কোন কিছুতে আমার মত দিতে বা কিভাবে কি করবে সেটা বুঝিয়ে দিতে। কিন্তু আগের থেকে এখনকার পার্থক্য খুব কিছু চোখে না পড়লেও বুঝতে পারি যে যে সমস্ত কিছুতেই নিজস্ব মতামত তৈরি হয়েছে। নিজের মনের মতো হলে মেনে নেয় না হলে হাজারবার বললেও সেটা না মেনে ঠিক পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করে। এমন নয় যে সবকিছুতেই তীব্র বিরোধিতা করে কিন্তু নিজের মতটাই বাকিদের মানিয়ে নেবার চেষ্টা করায়। যদিও নিজেও খুব দ্বিধায় থাকে যে যেটা ও করছে, সেটা ঠিক করছে কিনা! এই সময়টাই তো এই সব হবার। আমার নিজেরই মনে পড়ে যায় আমার সেই সময়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার পরবর্তী সময়ের কথা। হয়তো বাবা-মায়ের তখন অতো সময় ছিল না আমাকে নিয়ে ভাবার তাই নিজের মতো করেই নিজের বিপ্লব চালিয়ে গেছি বাড়িতে যা বলবে তার উল্টো করার। আমি কিন্তু সেইভাবে ওকে অতো বিরোধিতা করতে না দেখলেও, বুঝতে পারি ওর কি চলছে এই সময়টা জুড়ে। একে প্রথম বোর্ড পরীক্ষা শেষ করার আনন্দ আর অন্যদিকে কিছুই না করে লকডাউনে সারাদিন বাড়িতে বসে থাকার মনোকষ্ট, দুয়ে মিলিয়ে বেশ ঘেঁটে আছে। আমার এই সময়টায় তো সাইকেলটা প্রতিদিন রাত্রে বলে উঠতো, ছেড়ে দে বাবা, কেঁদে বাঁচি, সেখানে ওর সাইকেল আজ চার মাস সিঁড়ির তলায় বন্দি। আজকের সারাদিন হতো ওর বন্ধুদের সাথে কাটানোর সেখানে বাড়িতে বসে কাঁহাতক এই মোবাইল, ল্যাপটপ, নেটফ্লিক্স আর আমাজান প্রাইমে দিন কাটাতে পারে! এর মাঝে আছে অনলাইনে ক্লাস, স্কুলে প্রজেক্ট জমা দেবার দিন। তাই তো আজও বাচ্ছা ছেলের মতো রবিবার আর ভালো-ভালো দিন এখনো সেই 'নো-পড়া ডে' বলে দাগিয়ে আলাদা কিছু করে নেবার চেষ্টায় থাকে! দিনে শুতে যায় আর রাত্রে ঘুম থেকে উঠে সারারাত গোটা বাড়ি ঘুমতে গেলে শুধু শুধু 'রাত জাগছি, বড় হয়ে গেছি' গোছের আনন্দে দিন কাটাচ্ছে। মাঝে-মাঝে রেগে-মেগে চিৎকার করলেও বুঝতে পারি যে কি ঝামেলায় পড়েছে ও! নতুন ক্লাস-নতুন বন্ধু-নতুন বই-খাতা, নতুন আড্ডা ভুলে কি এক ঘরের মধ্যে সারাদিন পার করছে! কবে সব কিছু ঠিক হবে, কবে আমার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, সে উত্তরতো আমার কাছেও নেই! এরমাঝেই চলে আসা জন্মদিন যে কি কষ্টের! আগের বার জন্মদিন ভালো করে না কাটালেও এবারের কথা ভেবে করে রাখা সব প্ল্যান এক ধাক্কায় সব ছেড়ে ফেলে দেওয়া সত্যিই কষ্টের! এমন নয় যে বিরাট কিছু ভাবনা ওর জন্মদিন পালন করা নিয়ে, তবুও এবার অন্তত একবার বন্ধুদের সাথে বেরুবে ভেবেছিল- সেটাও গেল। আর খাওয়া? সেটা নিয়ে ও অতো ভাবে না! জানে ওর মা সারাদিন আজ ওর পছন্দের রান্না করে খাওয়াবে। আর চিকেন পেলেই ও এমনিতেই খুশি, সে সকালের চা দিয়ে হোক আর রাত্রের ভাতে হোক! কেক! সেটাও জানে মা একটা না হয় দুটো বাড়িতে করে দেবে! নাই বা হোল দোকানের মতো সাজানো! সেসবে ওর কিছু এসে যায় না! এরপর পরে থাকে গিফ্ট! সেটাও যে যেমন দেবার সেটাও পাবে। টাকা-পয়সা পেলে আজও খুশি হয়না বা কেউ দিলে সেটা মনেও রাখে না! এবারেও পাওনা কয়েকটা টাকাও এখনো অবধি আমারই হস্তগত। সবই সময়মতো চলছে, শুধু একটু বাইরে যাবার, বন্ধুদের সাথে ঘুরে-বেড়াবার উপায় নেই! মনখারাপ হবার মতোই!
তবুই দিন পেরিয়ে চলেছে! একটু একটু করে ওর সাথে আমরা দুজনে ওর সাথে দিনগুলো পার করে চলেছি। জীবনের সব থেকে রং-বেরঙের দিনগুলো একরকম প্রায় ঘরবন্দি হয়ে কাটাতে হচ্ছে ওকে আর সেটার চব্বিশ-ঘন্টাই আমাদের চোখের সামনে- দুদিক থেকেই এক নতুন অভিজ্ঞতা। চোখের সামনে এতো কাছ থেকে এই ষোলো বছরে কখনো এতো সময় একসাথে কাটানো হয়ে ওঠেনি যা এই চার মাসে কাটালাম। আমার তো আজও মনে পড়েনা ক্লাস ইলেভেনে আমি দিনে-রাত্রে বাড়িতে ভাত খাওয়া আর রাত্রে ঘুমানো ছাড়া অন্য কোন সময় ছিলাম কিনা! সারাদিনই তো টিউশন, স্কুল, বিকালে আড্ডা আর আবার টিউশন পড়ে বাড়ি আসা ছিল রাত্রে দশটার পর। ওর বাইরে বেরুনো একটু কম হলেও এই সময়টা ছিল এবার একা বেরুনোর। এতদিন যেখানে গেছে সেখানে বাবা না হলে মায়ের সাথে। সেই একা পড়তে যাওয়া বা স্কুল যাওয়ার ভাবনা-সবেতেই ধাক্কা।
এখন চলছে ওর অনিয়মের নিয়ম- সবাই যখন ভাত খাবে ওর তখন খিদে পায় না। পাবে কি করে! দুপুর বারোটায় ঘুম থেকে উঠে কি একটায় ভাত খাওয়া যায়! আবার সকালে তাড়াতাড়ি উঠলে (মানে আমাদের ঝাড় খেয়ে) দুপুরে এমন ঘুমবে যে রাত্রে আর না খেয়ে পরের দিন ভোর তিনটেয় উঠে ভাত খেয়ে দিন শুরু করবে! এই রুটিন ওর নিজেরই বানানো! বুঝি! এই 'না-মানায়' এক বড় হয়েছি ভাবনার প্রকাশ। বেশ ভালোই লাগে মজা দেখতে! ভালোও লাগে আবার ঝামেলাও হয় আমার সাথেই! এরপর ওর মাকে বলছে, 'আমার গায়ের যা জোর বাবা পারবে না! বেশি ঝামেলা করলে পুরো ফেলে দেব!' আমার সাথে তো সবেতেই ঝামেলা! তাতে কি আছে! ঘুমোলেই সেই ছোট ছেলের মতোই!
শুভ জন্মদিন! জন্মদিনের অনেক অনেক ঝামেলা!
আজ সব ঠান্ডা তো কি আছে! কাল থেকে আবার শুরু হবে!
ভালো থেকো। সুস্থ থেকো। মানুষ হয়ে ওঠো।
* আমার সবথেকে পছন্দ ছোট থেকেই ওর চুল নিয়ে ঘেঁটে দেওয়া। চারমাস চুল কাটাতেই যায়নি। আর এখন নিয়ম আছে জেগে থাকা অবস্থাতে ওর চুলে হাত দেওয়া যাবে না। তাই চুল নিয়ে কিছু বলা যাবে না! এটাও সেই একরকম নিয়ম-ভাঙার খেলা! চলুক। বেশ মজার!
- একবার দেখি চুলগুলো কতো বড় হল?
- গায়ে হাত দেবে না বলছি! খুন করে দেবো!
- তাই! দেখবি!
- ডার্থ ভেদার্স এর মতো মেরে দেবো পুরো।
- সেটা আবার কি?
- বুঝবে না! সারাদিন বসে বসে কি টিন-এজার সিরিজ দেখো?
(আসলে কয়েকদিন আগে আমায় দেখেছে কিছু না পেয়ে আমি গসিপ গার্ল দেখছিলাম। যদিও সিরিজ দেখায় ওর আমার পছন্দ কিছুটা হলেও একই। দুজনেই ট্রিয়িয়ান ল্যানিস্টার কে পছন্দ করি। দুজনেই প্রফেসরকে ওভার-রেটেড মনে করি, টোকিও কে মনে করি এরপর সব ঝামেলা সামলাবে, জেসি পিনকম্যানকে বেশ ইন্টেন্স মনে হয়। তবুও কিছু আলাদা তো থাকবেই!)
- ছবি দুটো দ্যাখ তো, ফেসবুকে দেবো। কোনটা ভালো বলতো!
- দেখি! কখন তুললে?
- আমি তুলি নি। মা তুলেছে। আমি একটু এডিট করলাম। পোষ্ট করছি, ওয়ালে এল্যাও করে দিস।
- দেখছি ভেবে।
- মানে!
- মানে আবার কি! ছবি দুটো পাঠাও আমায় দেখছি!
(পালা, এখান থেকে! আমি পোষ্ট করবো আমার দেওয়ালে। তোর যা মন, তুই কর।)
15082020



Comments

Popular Posts