মন ভালো হয়ে যাওয়া দিনগুলো।

মন ভালো হয়ে যাওয়া দিনগুলো।

বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল ছেলেদের আন্তঃস্কুল ফুটবল খেলাগুলো। স্কুলের মাঠটা নতুন করে তৈরী হচ্ছিলো। পর পর কয়েক বছর খেলা বন্ধ হতে হতে আমরাও প্রায় ভুলতে বসেছিলাম অনেক কিছু। আমাদের অতীত, আমাদের কারোর কারোর কিছু-কিছু হয়ে না ওঠা স্বপ্ন- সবই প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। এবার প্রায় মাস খানেক আগে একদিন যখন আমার সাপ্তাহিক ক্লাস সিক্স 'এ' সেকশন এ ঢুকছি, একজন চিৎকার করে বলে উঠলো,
--"স্যার, আজ আমরা পড়বো না, আজ আপনি আমাদের 'গেম প্ল্যান' আর টীম ঠিক করে দেবেন আর কে কোথায় খেলবে ঠিক করে দিন।"
প্রথমে আমি ঠিক বুঝতে পারি নি, যারা ক্লাস এ ঢোকা মাত্র আগের দিনের হোম ওয়ার্ক এর খাতা নিয়ে আগে ছুটে আসে, যাতে সব গুলো দেখে আমি সই করতে পারি, তারা কি বলছে! ঠিক আছে। দেখছি। কি ব্যাপার?
--"স্যার! আমাদের সাথে সিক্স 'বি' সেকশন এর খেলা পড়েছে পরশু দিন।"
--কি খেলা?
--"ফুটবল, স্যার! আপনি জানেন না? এই মাত্র আগের পিরিয়ড এ চন্দ্রকান্ত বাবু বলে গেছেন, আমাদের টুর্নামেন্ট আবার শুরু হবে।"
পাশ থেকে কয়েকজন বলে উঠলো,
--"স্যার, আপনি আমাদের 'মেন্টর'।"
( এই মেন্টর বলা নিয়ে আমরা পরে বেশ মজা করতাম, যেমন যেই ফাইভ এর ছেলে গুলো অফিস এর সামনে আসতো, আমরা ধ্রুববাবু কে বা সেভেন এর ছেলে গুলো এলে পরেশ বাবু কে বলতাম, ' এই চলে এসেছে, 'মেন্টাল' কে নিতে, নিজের টীম এর'। আর ওদের উৎসাহ তো বলার নয়। খেলা শুরু হবে ছয় পিরিয়ড এ, আর ওরা তো প্রথম পিরিয়ড এর পর থেকেই অফিস আর ক্লাস করে বেড়াতো।)
--সেটা আবার কি রে?
মাঝখানের বেঞ্চ থেকে এফরাজ বলে একটা ছেলে খাতা পেন নিয়ে উঠে চলে এলো। আমি ভাবলাম হোম ওয়ার্ক এর কাজ দেখতে আসছে। ও বাবা!! খাতার শেষ পাতা গুলো জুড়ে শুধু ফুটবল মাঠের ছবি আর পজিশন গুলো পয়েন্ট আউট করা। ঠিক যেমন করে বিশ্বকাপ খেলার আগে আমরা দেখছিলাম কে কোন জায়গায় খেলবে, কোনখানে দাঁড়াবে বা কতদূর সে বল নিয়ে যাবে, সেই ভাবে এঁকেছে আর সেই খানে শুধু মার্সেলো র জায়গায় 'চিংড়ি', কুটিনহ র জায়গায় 'বাপি', পৌলিনহ র জায়গায় 'আরশোলা', থি সিলভা র জায়গায় আছে 'ইঁদুর' আর 'চকমকি' নাকি পাল্টে পাল্টে খেলবে। নাম গুলো উৎপল বাবুর দেওয়া ওদের ক্লাস এর ছেলেদের জন্য ওদের প্রথমদিন থেকেই এই স্কুলে। (আরো, অনেক সব নাম আছে। কিন্তু সেগুলো ডিসক্লোজ করা আমার 'মেন্টর' হিসাবে ঠিক হবে না।) আর নেইমার এর জায়গায় স্বয়ং ক্যাপ্টেন, এফরাজ। দেখতে দেখতে আমার শুধু মনে হচ্ছিলো যেন বিশ্বকাপ ফুটবল এর আগে সুনীল ছেত্রী র আলোচনা শুনছি, শুধু ওখানে ছিলো ডিজিটাল বোর্ড আর এখানে ছেঁড়া খাতার শেষ পাতা আর দু টাকার ডট পেন।
ভাবতে পারি না, যে এক্সট্রা টাইম এবং এক্সট্রা প্লেয়ার কে কখন নামবে সেটাও লেখা আছে। কার দশ মিনিট পর সুরজ নামবে সেটাও লেখা।
--দেখলাম সবই, তা আমায় কি করতে হবে?
--"স্যার! আপনি আমাদের টীম ফাইনাল করে দিন।"
--আমি কি করে করবো? আমি তো তোদের খেলা দেখিনি বা কখনো খেলাই নি!
আবার ত্রাতার ভূমিকায় এফরাজ।
শুধু ছেলেটার ক্লাস পরিচালনা দেখলাম। যে যে টীম এ আছে বা যাদের ও নিয়েছে ক্যাপ্টেন হিসাবে তাদের সবাই কে দাঁড় করালো। এর পর আমায় বলতে থাকলো কে আদান মাঠ এ প্রাকটিস করে, কে জনাই মাঠে বড় দের সাথে খেলে, কে বুট পরে কলকাতায় কোচিং এ যায়।
আমি শুধু অবাক হয়ে যাচ্ছি, ছেলেটার ভাবনা চিন্তা দেখে।
আর নিজেকে যেন মনে হচ্ছে আমি ব্রাজিল টীম এর ম্যানেজার 'তিতে', যে কিনা তার প্লেয়ার চয়েস করছি কে বার্সায় ভালো খেলে আর কে রিয়েল এ এবার তিনটে গোল দিয়েছে আর কে পি.এস.জি তে নতুন শুরু করছে।
যাই হোক, নিজেকে তো বেশ লাগছিলো।
আর এতক্ষন এ আসলে বুঝতে পারলাম ওই 'মেন্টর' এর মানে। আসলে আমি হচ্ছি এই ক্লাস সিক্স এ সেকশন এর 'মেন্টর' কাম 'ম্যানেজার' কাম 'কোচ' কাম 'আর যা যা কিছু হয়।
--শোন, আজ স্কুলের শেষে আমি খেলা দেখবো তোদের।
দেখলাম। বেশ ভালোই খেলছে। চেষ্টা করছে নিজেদের করা গেম প্ল্যান মেনে খেলতে। তাই কি পারে? ক্যাপ্টেন তো সবাই কে বকতে বকতে সময় পার করে ফেললো, 'ওরে তুই নীচে নাম, তোর ওখানে জায়গা নয়'। 'ধুর, তুই আর একটু উঁচু শট কর'।
বেশ ভালোই চলছিলো।
শেষ হলো প্রাকটিস ম্যাচ। কঠিনতম প্রশ্নের মুখোমুখি এবার আমি।
--"স্যার! আমার খেলা দেখলেন?"
--"স্যার!পাশ ভালো করেছি?"
--"আচ্ছা স্যার! যদি টাই-ব্রেকার হয়, তাহলে কে কে শট মারবে, একটু ঠিক করে দিন।"
ওরে বাবারে! তোরা একটু থাম এবার। গেম প্ল্যান, টীম এর পজিশন থেকে টাই-ব্রেকার- আর কি কি ভাববি এখন থেকে! তোরা তো এই সবে ক্লাস সিক্স। বলিনি ওদের, আমি শুধু নিজের মনেই ভেবে চলেছি আমি যখন সিক্সে পড়তাম তখন ক্লাসের এই খেলায় শুধু টীম ঠিক করে মাঠে নামতাম। কে কোথায় খেলবে! হা!ওই খেলার স্যার যেখানে বলে দিতেন। আর এরা? দু-দুজন খেলার স্যার পার করে 'মেন্টর' অবধি ভাবছে!!
আমার ঘোর কাটছে না, এদের ভাবনা দেখে।
যাই হোক। টীম হলো। 'মেন্টর' ঠিক হলো। গেম প্ল্যান ঠিক হলো। পজিশন ঠিক হলো। তারপর সবকটা বাড়ি গেল। কয়েকজনের তো মা নিতে চলে এসেছিল, তাতেও তাদের যাবার কোনো উৎসাহ নেই, উল্টে ধমক মা কে,
"দাঁড়াও না, দেখছো না, কথা বলছি।"
ওরে বাবা রে!! কি গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তি আর তার কি গুরুত্বপূর্ণ কথা!!!
মায়েরাও প্রশয় এর হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসব দেখে আমিও বেশ সিরিয়াস হয়ে গেলাম। বুঝলাম, ওরা আমার ক্লাস সিক্সের ভাবনা থেকে শত মাইল এগিয়ে আছে।
এবার 'মেন্টর' হিসাবে আমায় তো কিছু কাজ করতে হবে। যদিও এই ফাইভ আর সিক্স এ আমার ক্লাস নেই ই ওই একদিন ছাড়া। এদিকে একজন 'মেন্টর' হিসাবে তো আমায় আমার শত্রুপক্ষের সব কিছু জানতে হবে। চারিদিকে শুনছি ফাইভ 'এ' নাকি দারুন খেলছে এই সাব জুনিয়র গ্রুপ টাতে। তাই একদিন চলে গেলাম ওদের ক্লাসে প্রবিশনাল এ। ওরে!! এই 'পুঁচকে' গুলো তো আর এক ধাপ উপরে! ওদের খাতায় গেম প্ল্যান পজিশন যেমন সব আছে তেমনি আছে বেশ কয়েকটা 'গুবলে', যেগুলো মোটামুটি সিক্সের উপরে চাপলে সিক্সের বেস্ট বল প্লেয়ার 'চিংড়ি'তো মরেই যাবে। ওদের আবার একজন বলে উঠলো,
--"এই, স্যার কে কিছু বলিস না। স্যার, সিক্স এ র 'মেন্টর'।"
উঃ!!এই এক হয়েছে মেন্টর হবার জ্বালা!
বুঝলাম, কঠিন প্রতিপক্ষ!
ভাবছো, স্যার হয়ে সব জেনে নেবে। তা হবে না! সে গুড়ে বালি! ওরা যা বলার সব ওদের 'মেন্টর' এর সাথে কথা বলবে! মাঝে একবার উল্টো পাল্টা বলে উত্তেজিত করার চেষ্টা করলাম। যে তোদের 'মেন্টর' তো তোদের খেলার দিন আসবে না, বা সিক্স 'এ' যা টীম করেছে তোদের ধরে ধরে পাঁচ গোল দেবে।
ও হরি! 'গুবলে' গুলো রাগও করে না।
শুধু বলছে, "ঠিক আছে দেখবো। আপনি তো ওদের সাথে আছেন।"
বুঝলাম, এবার আন্তঃস্কুল সাব জুনিয়র ফুটবল ম্যাচ বেশ উত্তেজনাময়ই হবে।
তারপর একমাস কেটে গেছে। সাব জুনিয়র, জুনিয়র, সিনিয়র সব ম্যাচ হয়ে চলেছে প্রতিদিন নিয়ম করে।
আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়েছি ইলেভেন এর হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা , তার খাতা দেখা, দেখানো, টুয়েলভ এর প্রজেক্ট করানো, নম্বর দেওয়া- এই সব কাজ নিয়ে। আর যেহেতু ওদের কোনো ক্লাস থাকে না, তাই কি হলো খেলায় বা কে কি রকম খেলছে সে সব জানতেও পারতাম না। তবে আমার টীম যে হেরে গেছে সেটা শুনেছিলাম। অতো পাত্তা দিই নি ব্যাপারটা।
কিন্তু এটা শুনছিলাম, ফাইভ 'এ' সেকশন ফাইনাল খেলছে আর এবার সাব-জুনিয়র টীম গুলোর মধ্যে সব থেকে ভালো খেলছে। এরই মাঝে একদিন সিক্স 'এ' র কয়েকজনকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি রে, কি হলো?
--"এফরাজ স্যার একদম ভালো খেলতে পারে নি, আর আপনি স্যার মাঠেই গেলেন না! আমরা জিতবো কি করে? সব সেকশন এর 'মেন্টর' টা মাঠে ছিল।"
সত্যি, মাঠে যেতে পারিনি। ওই সময় টুয়েলভ এর ক্লাস এর খুব চাপ চলছিল। কিন্তু সেটা ওদের বোঝাই কি করে!
আমরা যে কি সমস্যায় থাকি।
স্কুলের খেলা হবে, আর সাথে বাকি ক্লাস গুলোও চলবে।
ওদের আর দোষ কি। ওরা যে স্যার দের মাঠে দেখছে তাদের যে ওদেরই ক্লাস থাকে।
যাই হোক, একটু মন খারাপ হয়ে গেল। খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পারি আমরা। তাই আমিও ভুলে গেলাম।
পুজোর ছুটি পড়বে যেদিন, শনিবার স্কুলে গিয়ে থেকে দেখি 'গুবলে' গুলোর অফিস ঘরে যাতায়াত খুব বেড়ে গেছে, আর শুধু চন্দ্রবাবু কে খুঁজছে।
--এই, শোন, আজ আবার কি আছে?
--"আজ আমরা কাপ আর মেডেল পাবো।"
--কখন?
--"সেই জন্যই তো খুঁজছি। স্যার বলেছিলেন দু পিরিয়ড হবার পর স্টেজে মেডেল দেবেন। এখন বলছেন হেড স্যার কে জিজ্ঞাসা কর।"
ঠিক আছে, দেখা যাক কি হয়? এই বলে আমিও ওগুলোকে ক্লাস এ পাঠালাম। পরের পিরিয়ড হবার পর আবার চলে এসেছে। বুঝি, জিতে মেডেল পাওয়ার উৎসাহে ওরা আর ক্লাসে থাকতে পারছে না। ছুটির ঘন্টার পর স্টেজ থেকে যখন মেডেল আর কাপ দেওয়া হচ্ছিলো তখন ওদের উৎসাহ ছিল সব থেকে দেখার মতো। বাকি বড় ছেলেরা আজ অনেকেই মোবাইল নিয়ে এসেছে। কাপ, মেডেল নিয়ে নিজের নিজের টীম এর সাথে ছবি তুলছে, হৈ-চৈ করে বেড়াচ্ছে মাঠময়। আর 'গুবলে' গুলো একবার এদিক আর ওদিক করে বেড়াচ্ছে। খুব খুশী সব কটা। কাপটা একবার সবাই মিলে দেখে নিয়েই ফেরত দিতে পারলেই বাঁচে। কারণ ওদের গলায় এখন 'সোনার' মেডেল। (প্লাস্টিক এর উপর রং করা, না হয় না ই বা বললাম আজ।)
সবকটা কে একজায়গায় জড়ো করে আমার ছবি তুলতে মন হলো। তুললাম।
কেউ নেই আজ ওদের ছবি তোলার। ওদের না আছে ফেসবুক, না আছে ইনস্টাগ্রাম। বাকি বড় রা সবাই নিজের নিজের প্রোফাইলে আজকের কাপ পাবার ছবি আপলোড করে ফেলেছে। আমি এই সুযোগে ওদের কে ধরে রাখলাম আমার ক্যামেরা তে। জানি কয়েক বছর বাদ টুয়েলভ দিয়ে ওরা যখন বেরিয়ে যাবে তখন না হয় আমি আরো একবার শেয়ার করবো ওদের এই ছবিগুলো। 'হনুমান' গুলো তখন না হয় দেখবে যে ওদের ফেসবুক এ আসার আগেই আমি ওদের এখানে নিয়ে এসেছি।
কি উত্তেজনা সেই ছবি তোলায়! ক্যাপ্টেন ধরে ধরে সবাইকে দাঁড় করিয়ে নিজে সামনে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
--"তুলুন এবার।"
তোলার পর এসে দেখে নিয়ে আবার মেতে গেল নিজেদের আনন্দে।
যে গ্রুপের যারা জিতেছিল তারাই ছিল এই মেডেল নিতে। একমাত্র এই সাব-জুনিয়র গ্রুপ এর হেরে যাওয়া আর জেতা টীম সবাই ছিল অনুষ্ঠানে। হেরে যাওয়া আমার সিক্স 'এ' সেকশন এর সবাই কিন্তু আজ ফাইভ 'এ' র মেডেল নেওয়া দেখলো শেষ পর্যন্ত।
প্রতিনিয়ত শিখি আমরা তোদের কাছে।
আরো কত কিছু শেখার আছে আমার তোদের কাছে।
তোদের মতো করে সারাজীবন যেন তোদের সাথে কাটাতে পারি।
আমার হেরে যাওয়া টীম এর সবার ছবি আমি আমি তুলেছি, কিন্তু সেই ছবি আজ আমি এই পোস্টে পোস্ট করবো না।
আজ শুধু আমার টিমকে হারিয়ে দিয়ে সাব-জুনিয়র গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ফাইভ 'এ' র টীম এর ছবি।
"থ্রি চিয়ার্স ফর ফাইভ 'এ', 'গুবলু' দের টীম।"
ধন্যবাদ তোদের, আমায় এরকম এক দুপুর দেবার জন্য।
ধন্যবাদ তোদের, তোদের সাথে থাকতে না পারলে আমি হয়তো কোন দিন জানতেই পারতাম না, জীবন কি, বেঁচে থাকা কত সোজা, কত ছোট তে খুশী হওয়া যায়।


** খেলার স্যারদের কাছে আমার অনুরোধ ওদের কাপটা আর একটু বড় দেওয়া যায় না! বা হয়তো স্কুলের সবথেকে বড় কাপটা ওদেরই দেওয়া হোক, ফেরত তো দিয়েই দেবে।
** পরের বছর থেকে কোনো 'গুবলে' দের টিমের 'মেন্টর' হলে , খেলার দিন অব্যশই মাঠে থাকবো।
ধন্যবাদ তোদের, আমার মন ভালো করে দেবার জন্য।

Comments

Popular Posts