প্রথম লিঙ্গের পাঠকের খোলা চিঠি দ্বিতীয় লিঙ্গের কথককে।।

প্রথম লিঙ্গের পাঠকের খোলা চিঠি দ্বিতীয় লিঙ্গের কথককে।।



আমায় কি আদেও চেনো তুমি? শতাব্দী প্রাচীন সেই সারাজীবন পাশা-পাশি থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ দুই সামাজিক জীব, যারা সেদিনের সেই গোচারণ ভূমি থেকে আজকের বামন গ্রহে যাবার স্পেসশিপের মধ্যেও নিয়ত লড়াই করে চলেছি! চিনতে পারলে না! আমায় চিনতে গেলে যে তোমায় আমার মতই নৃশংস, কলুষিত হতে হবে। সেপিয়েন্স এরও অনেক প্রজাতির ধ্বংস তো আমি নিজের হাতেই করেছি। তাও তোমার কাছে এসে হেরে গেছি। ধ্বংস করলে আখেরে নিজের ক্ষতি বুঝেই তো বারে-বারে তোমায় শৃঙ্খলিত, ধর্ষিত, কলুষিত, প্রতারিত করেছি নিজের প্রয়োজনেই। তাই তো বেছে নিয়েছি যখন যাকে যেখানে প্রযোজন।

ড্রাকারিস!

শুধু এই একটা শব্দেই দেওয়া যায় সমস্ত অপমান, বিশ্বাসঘাতকতা, পিছন থেকে ছুরি মারার গোপন অভিসন্ধির জবাব। প্রেমহীন দেহে নিংড়ে নেওয়া জৈবিক চাহিদায় শরীরের নিঃশব্দ গোঙানি আর চোখের কোনে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ যখন নতুন করে যন্ত্রণার সাথে সহবাসে বাধ্য করে, কর্তব্য আর যৌথ পরিবারের সম্মানের দোহাই দিয়ে পুরুষ যখন হাসতে হাসতে তোমার ভালোবাসাকে খুন করবে, তখন তুমি সেই পচা-গলা ভালোবাসার দোহাই দিয়ে ভুলে যাবে তোমার সেই বরফ শীতল কঠিন গলায় উচ্চারণ করতে 'ড্রাকারিস'! শুধু যে শব্দের জোরে তুমি সাত-সাতটা রাজত্ব জয় করে, শুধু ভাবতে শুরু করেছ, 'রাজতন্ত্রের চাকাটা থামিয়ে নয় ভেঙে দেবার' কথা, ঠিক তখনই আমার শত বিশ্বাসঘাতকতার জবাবেও একবারও উচ্চারণ করতে পারবে না সেই শব্দ। আমি জানি ওই 'চাকা'র নাগপাশেই আমি বার-বার তোমায়ই আবদ্ধ করব আর তুমি বার-বার আমায় বিশ্বাস করে শেষ হয়ে যাবে।

ফ্যালোসেন্ত্রিক আমার সমাজ সেই দ্বাপর থেকে আজকের ডিকন্সট্রাকশন কোথাও তোমায় একটুও জায়গা ছাড়বে না জেনেও তুমি ভুল করবে বার-বার। তোমার সন্তান তোমার হত্যার পরেও তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়েই তোমার মৃতদেহ নিয়ে হারিয়ে যায়। প্রতিশোধের শিক্ষা দিতে যে তুমি ভালোবাসার ছলনায় ভুলে গেছ। তুমি স্বপ্ন দেখ ঈশ্বরী পাটনী আর অন্নপূর্ণার আর আমি ভাবি বেহুলা, সীতা আর দ্রৌপদী হয়ে তুমি কখন আমার রাজধ্বজা বহন করবে তোমার সমস্ত শরীর আর মন দিয়ে। রাজ-রাণীর দোহাই দিয়ে আমি কি ভাবে তোমায় শৃঙ্খলাবদ্ধ করে চলেছি তা তো তুমিই সবথেকে ভালো জানো।

হে নারী! তোমার তো একটাই অস্ত্র। ভালোবাসা। আর সেই অস্ত্র তো তুমি সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত ব্যবহারে ক্লান্ত। তুমি খেয়াল করে দেখতেই ভুলে গেছ যে বারে-বারে যুগে যুগে আমি তোমার এই ভালোবাসা পায়ে মাড়িয়ে তোমাকেই কখনো পাতাল প্রবেশে কখনো বা অগ্নি গহ্বরে নিক্ষেপ করেছি কখনো বা একটুও ভুল না করে নিখুঁত মাপে ঠিক তোমার বুকের বাম দিকে একটু তেরচা করে আমূল বসিয়ে দিয়েছি আমার বিশ্বস্ত তোমারই দেওয়া ঐ ভালোবাসার শেষ নিশান, তোমারই দেওয়া আত্মরক্ষার কবজখানি।

নার্সিসিজম তো আমার আত্মরক্ষার কৌশল, তোমার কাছে আমার হেরে যাবার আগের মুহূর্তের তীর যা আমি সযত্নে লালন করি অস্তিনে। 'বিজয়ী যন্ত্রনা পেলে নিহতের কিসের পরাজয়?' ভেবে তুমি খুশী থাকলেও বার-বার আমি কিন্তু তোমায় বদলে ফিরে যাই আবার রাজ অনুগ্রহে। বূহ্য রচনা করি আমিই, তোমায় সেই চক্রে আবদ্ধ করার ছলে। তোমার দীর্ঘশ্বাস আমায় আজ আর ভাবায় না।
রানী। না তুমি শুধু রাণী নয়, তুমি হলে 'খালেশি'। তোমায় রাণী করে রাখলেই আমি খুশি। তুমিও ছিলে সেই রাজপোশাকের মোড়কে সোনা-দানা আর দাস-দাসীর সাহচর্যে আমার সম্ভোগের উপাদান হয়েই। তোমার রানী হওয়া ক্রমে বাঁচতে থাকল আমার রাজ গৌরবে। তুমি তো ভুলেই গেলে সেদিনের সেই গোধূলি বেলায় বিশালাকার ম্যামথকে কব্জা করে বুনো শুওরের মাংস ঝলছে খেয়েছিলাম দুজনে একসাথে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আর তারপরেই কবে কখন কিভাবে যে তুমি অন্তপুরবাসিনি হয়ে উঠলে তা আজ তুমি ভুলে গেলে। আমি যে মেনে নিতে পারছিলাম না তোমার ওই ঔদ্ধত্য, চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস আর বর্শার ফলায় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া শত্রুর মাথা। এরপরও বলি, সবাই নয়। কেউ কেউ তো আমাকে ছাপিয়ে সিংহাসনের দখল নিয়েছিল নিজের যোগ্যতাতেই। আমি কি করে মেনে নেব! আমি সেদিনও মানি নি আর আজও তো তাই। তাই তো ছলনায় হত্যা করেছি তোমায়। আর আজ তুমি উচ্চ ন্যায়ালয়ের দরজায় কড়া নাড়িয়ে যাও শুধু আদেশ দেবার অধিকার প্রতিষ্ঠায়। তাই নারী বার-বার বলি, রানী নয় 'খালেশি' হয়ে ওঠো। সমাজ বাঁচবে, পুরুষ বাঁচবে, আমি বাঁচবো।

তুমিই বলার ক্ষমতা ধরেছিলে যে তোমার কোনো ক্ষতি করার সাহস কোনো পুরুষের নেই। কারণ তুমি জননী, তুমি জানো তোমার পুত্ররাই তোমায় রক্ষা করবে। আসলে তুমি তো শেষ পর্যন্ত জেনে এসেছো যুদ্ধ মানে সম্মুখে থাকা দুই শত্রুর অস্ত্রের আস্ফালন। কিন্তু তুমি তো ভুলেই গেছ আমার কথা। আমি যে আলিঙ্গনের পাশে তোমায় আবদ্ধ করে তোমার সাথে বিছানায় যাই, সেই একইভাবেই দুবাহু প্রসারিত করেই তোমায় আমার বুকে জায়গা দিয়ে যে কোন শিথিল মুহূর্তে তোমার বুকে বসিয়ে দেব ছুরি। আমি যে পুরুষ! আমার ছলনা, আমার বিশ্বাসঘাতকতার সবকিছুই তো পুরুষকারের মোড়কে জয়-জয়কার হবে!

তুমি যখন বলার সাহস দেখিয়েছিল তোমার দিকে তোলা যে কোন পুরুষের হাত, পুরুষের শেষ হাতের অস্তিত্বের কথা জানাবে, প্রতিটি পুরুষের মৃত্যু হবে তোমার আগুনে, তখনই পুরুষ দেখেছিল সেই নির্বিচারী অশনি সংকেত, বুঝেছিল শেষ রাতের গল্প। ছলনা, যা তুমি হাসতে হাসতে ছেড়ে আসতে পার ভালোবাসার দোহাই দিয়ে, তাকেই পুরুষ তুলে নিল আত্মরক্ষার বর্ম হিসাবে। মান, সম্মান, ধর্ম, জাত, সংসার আর বৃহত্তর সমাজের দোহাই দিয়ে সেই ছলনায় তোমায় বলি দিল।
'আত্মায় ছ্যাঁদা হয়, শিশ্নে এমন ধার নিয়ে কোন পুরুষ জন্মায়নি' জেনেও আমি যখন বার-বার সেই একই গুপ্ত-ঘাতকের ভূমিকায় থেকে যাই, তখন মনে হয় আমায় সামনে দাঁড় করিয়ে 'ড্রাকারিস' বলার জন্যই তোমার দরকার। পচা-গলা, বিষাক্ত, না-মানুষী এই সমাজে আপাতত শুধু এই শব্দটাই স্পর্ধার সাথে উচ্চারণ করতেও তো কাউকে প্রযোজন।
দ্বিতীয় লিঙ্গ, এজন্মে না হয় তুমি শুধু তাই-ই করলে!
ভালো থেকো। সুস্থ থেকো। আর শুধু জীবনে থেকো।।

*** এমনি এমনিই শুধু আমার কথা।
কেন লিখতে শুরু করলাম? কি নিয়েই যে লিখতে শুরু করলাম? খুব অদ্ভুত এক সমাপতন যা কখনো মনে হয় ভাবনারা বেশ গুছিয়ে বাস করে সংগোপনে কবির মনে, আবার কখনো মনে হয় সবকিছুই যেন অতিরঞ্জিত উর্বর মস্তিষ্কের ফসল।
সোনালি চক্রবর্তী সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত নাম যার লেখা আমি পড়ি। যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধুবৃত্তে থাকা তাই তুমি চাও বা না চাও অনেকে অনেক কিছুই জেনে যাবে তোমার সম্পর্কে। এবং এই জেনে যাওয়ার অসংখ্য ভুল ভাষান্তর তুমি করতে থাকবেই নিজের অজান্তেই। কিছু ভুল জানা আর কিছু তোমার কল্পনায় তুমি অবশ্যই মানুষটাকে তোমার মতো করেই ভেবে নিয়ে তার বিশ্লেষণে মগ্ন থাকবে। তার প্রভাব থেকে যাবে যতবার তুমি তার লেখা পড়বে। সাহিত্য পড়ার শুরুর দিকে জানতাম লেখককে জানার প্রয়োজনীয়তা, আর আজকে যখন লেখক নিজেই আমাদের ঘরের মানুষের মতো নিজেকে চেনাতে চান, (সবাই নয়, আবার কিছু জনকে তো আমি নিজেই জানতে চাই।) তখন আমি ভয় পাই। আমি ভয় পাই এই সোশ্যাল মিডিয়ার বহুল প্রচলিত এই মাধ্যমটিকে কারণ এই একমাত্র জায়গা যেখানে তুমি নিজেই নিজেকে উপস্থাপন করতে পারবে নিজের মতো করেই। তুমি তৈরী করতে পারবে আত্ম-পরিচয়। সিমুল্যাকরায় আক্রান্ত আমি রিয়েল আর হাইপার-রিয়েলের ধাঁধায় লেখককে কখনো আমারই প্রতিচ্ছবি ভেবে নেব আর কখনোবা দূর গ্রহের মানুষ। মানুষ-অতিমানুষের এই খেলায় না-মানুষেরও যে ভূমিকা উপেক্ষা করে যাবো, তা হয়তো খেয়ালই থাকবে না। লেখকের
সেই পরিচয় আমার কোন সমস্যার নয় যতক্ষন তুমি আমার বন্ধু, কিন্তু সেই একই পরিচিত হওয়া আমায় ভাবায় যখন আমি তোমার পাঠক। শুধু একগোছা পলাশ নিয়ে আমি যে কোন সময়ে আমাদের ব্যবধান শূন্য করে নিতেই পারি।
কবি সোনালী চক্রবর্তী, তার বই "পদ্মব্যূহে নিম অন্নপূর্ণা" তার সমস্ত কবিতা, গদ্য-কবিতা, সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে চলা দিনের পর দিন টুকরো দু-এক লাইন, যেটুকু আমি পড়েছি শুধু তাই দিয়েই কবিকে চেনা যায় ভেবেই এই লেখা। বই, প্রচ্ছদ, রঙ, নামকরণ, উপস্থাপনা আরও যত কিছু, যা না হলে কবিতারা কবিতা হয়ে ওঠে না, সেসব না হয় অন্যসময় হবে। ভালো লাগার অনেক কিছুই না হয় না-লেখাই হয়ে থাক। কবি, কবির সৃষ্টি, কবিময় জীবন-লেখা সবই আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি। কবিতার আলোচনা-সমালোচনা কোন ভাবেই আমার এই লেখার বিষয়বস্তু নয়।
[দ্যানিরিস টার্গেরিয়ান (দ্যানি): শুধু এই নামটুকুই থাক না হয় রেফারেন্স হিসাবে, বাকিটুকু সবাই জানে।]
22.02.2020

Comments

Popular Posts