খেয়ে-বেড়ানো! (৩)

"ও বেটা জি!
দুনিয়া কে ইস চিড়িয়া ঘর মে তরাহ তরাহ কা জ্বলওবা,
মিলে কিসি কো শুখি রোটি, কিসি কো পুরি হালওয়া!
আরে ভাই কিসি কো পুরি হালওয়া!
ও বেটা জি!
খিঁচড়ি কা মজা কভি নরম! কভি গরম!
কভি নরম-নরম! কভি গরম গরম!
কভি নরম-গরম! নরম-গরম!
ও বেটা জি!
আরে! ও বাবু জি!"





'শুখি-রোটি' আর 'হালওয়া-পুরি' দুটোই যখন একটা দু-দিনের বেড়ানোর মধ্যে খাওয়া হয়ে যায় তখন সব দিক থেকে ভেবে দেখলে বোঝা যায়, যাক! এ যাত্রায় খুব খারাপ কিছু তা হলে হল না! আসলে খিচুড়ি আমি নরম-শক্ত-গরম-ঠান্ডা সব ভাবেই খেতে ভালোবাসি, তাই দেবার সময় তুমি কি দিলে বা কিসে দিলে আমি অত শত না দেখলেও আমার মানসিক ঝামেলা শুরু হয় কিছুটা খাবার পর বা খেয়ে নেবার পর। আসলে আমি কিছুটা নিন্দুকে! বেশ ভালো করে ভেবে দেখেছি আমি যতোই বলি আমি অল্প একটুতেই সন্তুষ্ট, আসলে কিন্তু তা নই। হয়তো পরিমানে অল্প হলে আমার যত না কিছু না মনে হয় তার থেকে বেশী বিরক্তিকর লাগে যদি তার মান বা স্বাদ ঠিকমতো না হয়! এতক্ষনে সবাই বুঝে গেছে যে আমি খাওয়ার কথা বলছি। একটু বাইরে বেরুলে আমার খাবারে বেশী বাছ-বিচার শুরু হয়ে যায়। আর এবার তো অনেকদিন বাইরে খাবার কোন সুযোগ হয় নি বা খাবার ইচ্ছাও হয়নি শুধু করোনার ভয়ে। তাই সেই ভয় কাটিয়ে কোথাও একটু বাইরে দু-দিন কাটাতে (আসলে বসে খেয়ে দিন পার করতে) চলে গেলাম বাড়ীর কাছেই এক জঙ্গলের ধারে গ্রামে। জঙ্গল, গ্রাম, সবুজে ঢাকা রিসোর্ট আর বৃষ্টি- সব মিলিয়ে শুরুটা বেশ ভালোই হয়েছিল।
বৃষ্টি ভিজে পৌঁছেই কোনরকমে একটু থিতু হয়েই বসে গেলাম দুপুরের খাবারে। মাছ-মাংস না ডিম ওসব বলার সময় নেই! যা আছে তাই হলেই হবে। আসলে তখন আমার এক সমুদ্র খিদে। বাকিরা ভাবছে যখন কোন বেলায় কি দেবে খেতে বা আর কি বললে রেঁধে দেবে, তখন আমার খাওয়া শুরু হয়ে গেছে। ডাল-তরকারি শেষ করে মাংস মুখে দিয়েই আমি এতক্ষনে মাটিতে পা দিলাম। বাপরে! মুখ জ্বলে গেল না আমি লঙ্কা খেলাম! না তো, লঙ্কা দেখতে পাচ্ছি না তো! যাই হোক খেয়ে উঠে ভাবলাম, পেটটা তো ভরেছে! কিন্তু সবাই তো ভালো করে খেতে পারেনি। মুখ-চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কারোর খাওয়া পছন্দ হয়নি। ঠিক আছে! পরের বার খাবার আগে না হয় ওদের আগে থেকে বলে দিতে হবে কি খাবার চাই আমরা। এতক্ষনে বুঝলাম, না , তা আর সম্ভব নয়। আমাদের বুকিং থাকা-খাওয়া সহ। আর খাওয়া ওনাদের হাতে। বলেছেন, খুব সুন্দর খাবারের ব্যবস্থা বা লিখিত নামেও খুব ভালো লাগার কথা! কিন্তু ওই যে বলে না, রাঁধুনি যদি ভালো না হয় তাহলে দেশী মুরগীর মাংসের ঝোল ও পেঁপের তরকারি হয়ে যায়! না, না! পেঁপের তরকারি আমার ভালোই লাগে, কিন্তু শেষে নামাবার আগে একটু হালকা করে দেশী ঘি গরম করে ছড়িয়ে না দিলে কি সত্যিই স্বাদের সাথে গন্ধ আসবে! আর দুটো মিলিয়েই তো খাবারের রস আস্বাদন। আমি এর সাথে আরো একটা জিনিষ অবশ্যই যোগ করি তা হলো ওই পেঁপের তরকারি তুমি কোন পাত্রে দিয়েছো! প্লাস্টিকের বাটিতে তরকারি, স্টীলের ছোট বাটিতে তিনবার করে ডাল এনে দেওয়া আর প্লাস্টিকের থালায় জল লেগে থাকা কলা পাতায় ভাত বেশ গুছিয়ে দিলেও খাওয়ার স্বাদ না থাকলে যা হয়, তাই শুরু হল মধ্যাহ্ন ভোজ পরবর্তী আড্ডাতে! কিছুটা সমালোচনা, কিছুটা মেনে নেওয়া যদিও তার সাথে সাথে শুরু হল রুমের অব্যবস্থাপনা। সন্ধ্যার মুড়ি বেগুনি আর রাত্রের খাবারের কথা না বলাই ভালো! বুঝে গেলাম, এবারও ভালো কিছু হবে না! জায়গাটা ভালো, শুধু খাবারের এরকম হাল, মনকে খুব ব্যাথা দিল। বুঝলাম, থাকা-খাওয়ার চুক্তি পত্রে আর কোথাও না যাওয়াই ভালো। যদিও একজন বিশেষজ্ঞ অন্তর্জালে এই নির্দিষ্ট রিসোর্টের খাওয়া নিয়ে খুব ভালো কথাই লিখেছিলেন। জানি না, ওনাকে মালিক কি আলাদা খাইয়েছিলেন। পরের দিন কিছুতেই ওখানে থাকবো না সেতো জানা কথাই! পাশের বহু পরিচিত রিসোর্টে খোঁজ নিয়ে এলাম। পরের দিন সকালেই সেখানে পৌঁছে গেলাম। যে লেখার জন্য আমার এই খেয়ে-বেড়ানো সেটা একশো ভাগ সফল শুধু চলে এসেছিলাম বলেই! সকাল থেকে পরের দিন দুপুরের খাওয়া পর্যন্ত থাকা এবং প্রতিটি মনের মতো খাবারের স্বাদ নেওয়া- এক কথায় এবারের
খেয়ে-বেড়ানো আমাদের ভালোই কাটলো।
কিছু কথা না বললে তো এই লেখার কোন মানেই হয় না। তাই শুরু করলাম একেবারে পৌঁছে যাবার সাথে সাথেই যে চায়ের কথা বলেছিলাম তাই দিয়ে। আমাদের পাশাপাশি দুটো রুমের কটেজের সামনের বারান্দায় দিদিরা যখন কিচেন থেকে আলাদা আলাদা পাত্রে চা-চিনি-দুধ এনে কটেজের আলমারি থেকে আলাদা কাপ-ডিশ বের করে চা সাজিয়ে দিল, তখনই বুঝলাম আর যাই হোক খাবার পরিবেশন নিয়ে এই রিসোর্টের মান নিয়ে কথা বলার সুযোগ খুব কমই আছে।
মৌরলা মাছের ঝাল আর ভাত!
পাঁচ জন বড় মানুষ আর একজন বাচ্ছা খাবো আমরা দুপুরে। কি অর্ডার করা যায় সেটাই ভাবতে একটু সময় লাগলেও ম্যাডামজীর নির্দেশে মৌ রলা মাছের ঝাল আর ভেজ-থালি র কথাই বলা হল। দিদিরা পরামর্শ দিল, মাছ টা দুটো প্লেট বলুন যেহেতু ছেলে দুটোর চিকেন ছিল। একটু চিন্তায় ছিলাম কারণ আগের দিনের অভিজ্ঞতা। খেতে বসে বুঝলাম খাবার দেবার পরিমান আর পরিবেশন করা সব কিছুতেই যত্নের ছাপ। খেয়ে বুঝলাম স্বাদের ভালোবাসা। ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, ফুলকপি-আলুর তরকারি, চাটনী, পাঁপড়, পায়েস সাথে নুন-লেবু-আচার-লঙ্কা। খাবারের স্বাদ নিয়ে বলার কিছু নেই। যেমন হওয়া দরকার ঠিক তেমনই। শুধু পরিবেশন করা আর দেওয়া সত্যিই দেখার মতন। এই কোভিড পরিস্থিথিতে প্রতিটা খাবার আলাদা করে সীল করে থালা সমেত এনেছে। ডাল দিয়েছে একসাথে একটা ছোট পিতলের বালতিতে। পরিমান যা দিয়েছে তা কেউই প্রায় শেষ করতে পারে নি আমার মতো পেটুক ছাড়া। যেটার কথা না বললে চলে না সেটা হলো মৌরলা মাছের ঝালের কথা! বাড়িতেও এতো ভালো স্বাদের হয়তো সবদিন হয়না। রিসোর্টের নিজেদের পুকুরের মাছ সেটা আগেই জেনেছি। কিন্তু যা ছিল একপ্লেটে তা হল সর্ষের পরিমান আর মাছ সঙ্গে চিরে দেওয়া কাঁচা লংকার ফালি আর সর্ষের তেলের হালকা কাঁচা গন্ধ- আহা! একথালা গরম ভাত তো আমি শুধু এই দিয়েই খেয়ে নিতে পারি! পরিমান যা ছিল দু প্লেটে তাতে আমরা চারজন খেয়েও বাড়তি কিছুটা। না, না! ফেলে রাখার প্রশ্নই নেই, আমি আর কবি আছি না!
সন্ধ্যার মুখ চালানো আর সময় কাটানোর জোগান থেকে রাত্রের খাবার যখন যেটা পছন্দ শুধু জানালেই দিদিরা কিচেন থেকে নিয়ে এসে হাজির করছে আধ ঘন্টার মধ্যেই। কোন একটা খাবারও আমি অপছন্দ করতে পারি নি কি তার স্বাদে বা পরিবেশনে বা তার দামে- সে আমার অর্ডার করা 'একটু পেঁয়াজ দিয়ে ভাজা ছোলা' হোক আর ছেলের অর্ডার করা চপসুই বা চিকেন মাঞ্চুরিয়ান হোক। টার্কির রোস্ট বা এমুর বিরিয়ানির কথা না হয় থাক! একটা বাটার নান আর একপ্লেট যেকোন চিকেন ডিশ একজনের জন্য যথেষ্টই বেশী মনে হয়েছে আমার অন্যান্য রেস্টুরেন্টে যা দেওয়া হয় তার তুলনায়। দু-দিনের পাঁচবেলার প্রতিটি খাবার আমার বেশ ভালো লেগেছে। সত্যিই মনে হয়েছে পরের বার এলে এখানে আবার থাকবো খাবার জন্যই।
আমরা গিয়েছিলাম বাঁকুড়ার জয়পুরের জঙ্গলে।আমার প্রথম দিনের থাকা রিসোর্টের নাম এই লেখাতে করতে চাই না। আর দ্বিতীয় দিনের রিসোর্টের নাম প্রায় সকলেই জানেন। বনলতা রিসোর্ট। এই রিসোর্টের সম্পর্কে প্রায় সকলেই জানে।এখানে দেওয়া সব ছবিগুলো বনলতা রিসোর্টের খাবারের ছবি। একটা কথা না বলে এই লেখাটা শেষ করা যায় না তা হলো বনলতা তে আমাদের সবার নিজস্ব অর্ডার করা খাবার নিজের মতো করে খাওয়ার পর টোটাল খাবারের বিল আগের রিসোর্টের থেকে বেশী হয়নি!
তবে ফিরে আসার পর পাশের এক নতুন রিসোর্টের কথা এক পরিচিত জনের কাছে শুনেছি যাদের খাবারের মান খুব ভালো। যদিও পরের বার গেলে সেখানে থেকে একবার খেয়ে দেখা যেতেই পারে।

Comments

Popular Posts