নন-সেন্স কথামালা (১৮): আজ একাদশী। না, একটাও নাড়ু পাইনি।

একটাও নাড়ু পাইনি আমি আজ। একটা নাড়ুও আমাদের বাড়ীতে কাওকে দিতে হয়নি। কি মনে হচ্ছে? খুব অসামাজিক আমরা বা আমি! জানি না। হয়তো তাই। সারাদিন শুধু ফোন জুড়ে মিষ্টি-নাড়ু র ছবিতে ইনবক্স উপচে পড়ছে। কিন্তু একটুও মন ভরে নি। তাই তো সেগুলো একটাও ফেরত পাঠাই নি। কাওকে ই পাঠাইনি। না, আমার এরকম ভাবে বিজয়ার প্রণাম, ভালোবাসা, শুভেচ্ছা জানাতে ভালো লাগে না। কেন দিনের শেষে এসে এরকম ভাবছি! আসলে এর একটা ছোট স্মৃতি আমাকে আজও তাড়া করে বেড়ায়। কিছুতেই ফেলে রেখে আসতে পারি না। বার বার ফিরে ফিরে যাই। তাই হয়তো লিখতে বসলাম।

ছোট থেকে একবাড়ীতে দুই দিদি, এক ভাই নিয়ে আমরা চারজন আর পরের দিকে আমার বোনকে নিয়ে পাঁচজন, পাশে পিসির বাড়ীর দুই দিদি আর এক দাদা নিয়ে মোট আট জনের এক বড় দল গোটা গ্রাম জুড়ে যে নরক-গুলজার করে বেড়াতাম তার কোন লিখিত ইতিহাস না থাকলেও আজও গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা দেখা হলেই সেই কথা তুলেই বেশ লজ্জায় ফেলে দেয় আমাদের। তা যাই হোক, সেইসময় পুজোয় যেভাবে চারদিন কাটাতাম তার গল্প পরে হলেও আজ আমি শুধু একাদশীর দিনের সকালের কথা মনে করবো। চারদিন পুজোয় বাঁধন-ছাড়া গরুর মতো কাটিয়ে, মানে ওই পড়াশোনা শিকেয় তুলে, কারোর কোন কথা না শুনে, পুজো প্যান্ডেলে দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটিয়ে, সবথেকে বড়ো কথা দুপুরে ভাত খেয়ে না ঘুমিয়ে বেড়িয়ে গোটা গ্রাম ঘুরে, সকাল-বিকাল জামা-প্যান্ট পাল্টে, ইচ্ছেমতো বাড়ীর লোকের উপর অত্যাচার করে, দশমীর সন্ধ্যায় ঠাকুর বিসর্জন করতে গিয়ে পুকুরে চান করে বাড়ী ঢোকার পরই প্রথম যে কথাটা শুনতে পেতাম তা হলো, 'হয়ে গেল তো এবার! কাল থেকে এসব আবার এক বছরের জন্য ভুলে যাও!' আরে, বললো তো বললো! আমি আর ভাই শুতে এসে শুরু করতাম হিসাব যে কবে লক্ষী পুজো আর কবে কালী পুজো! যতোই হোক, এক দিন করে ছাড় পাওয়া তো যেত! যাই হোক, যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তা হলো একাদশীর সকাল। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। জানিনা, আজও এরকম আছে কিনা! ছেলে-মেয়েরা আজও মেনে চলে কিনা! কিন্তু আমাদের কাছে ছিল শেষ সকাল যখন পড়তে বসতে হতো না! পুজোর ছুটির শেষ আনন্দের সকাল। একবার শুধু খাতা নিয়ে জ্যাঠা র কাছে বসে খাতায় দশবার 'ওঁ দুর্গা মাতা সহায়' লিখলেই ছুটি হয়ে যেত। তারপর শুরু হতো আমাদের সবাই মিলে গ্রামের প্রায় সব বাড়ীতে প্রণাম করতে যাওয়া। এ পাড়ার আমরা যখন দল বেঁধে শুরু করেছে ওপাড়ায় পিসির বাড়ী দিয়ে তখন ওপাড়ার ওরা আমাদের বাড়ীতে চলে এসেছে। সব বাড়ী বাড়ী গিয়ে সবাইকে প্রণাম করা ছিল আমাদের রীতি। বেশ কিছুক্ষণ করার পর আমাদের অভ্যাস হয়ে যেত কোন বাড়ীতে ঢুকেই প্ৰথমে কে কি করছে না দেখেই লাইন দিয়ে একধার থেকে প্রণাম করা। প্রণামের পালা শেষ হলেই কাকীমা, মামীমা, জ্যাঠাইমা, দিদিরা যেই থাকতো সে আমাদের একধারথেকে একটা বা দুটো নারকেল নাড়ু দিত। বাড়ী অনুযায়ী সেগুলো পাল্টে পাল্টে যেত। কোন বাড়ীতে চিনির নারকেল নাড়ু তো কোন বাড়ী তে গুড়ের নাড়ু, কোথাও একটা করে তো কোথাও দুটো করে, কোথাও সাথে কুঁচো নিমকি তো কোথাও বিস্কুট! প্রথমে দু-একটা মুখে চালান করে দিলেও সকাল-সকাল আর কটাই বা খাওয়া যায়! তাই ভাগ হয়ে সেগুলো পকেটে ঢুকিয়ে নিতাম। বাঁ পকেটে চিনির নাড়ু তো ডান পকেটে গুড়ের নাড়ু। আর বুক-পকেটে নিমকি বা বিস্কুট। পকেট ভরে উঠতো সকাল জুড়ে। বাড়ী এসেই সব খালি করেই খেলতে বেড়িয়ে যেতাম কারন ততক্ষনে তো সকালের পড়ার সময় পেরিয়ে গেছে! একবাড়ী থেকে আর একবাড়ী যাবার সময়ই আলোচনা হতো কারা বেশী আদর করলো আর কারা পাত্তা দিল না। চিনির নাড়ু দিলে বেশ ভালো লাগতো আর গুড়ের দিলে একটু মন খারাপ লাগতো। তবে সব থেকে বেশী রাগ হতো যখন কোন বাড়ীতে আবার ডিশে করে রসগোল্লা খেতে দিত! খেতেও মন যেত না আবার পকেটেও ঢোকানো যেত না! চারদিন নাড়ু খেয়ে খেয়ে তখন আর মিষ্টি খাবার কোন আলাদা আনন্দ ছিল না, কিন্তু দল বেঁধে সবাই মিলে সব বাড়ী বাড়ী গিয়ে প্রণাম করা, পেরিয়ে যাওয়া পুজোকে জোর করে আর এক বেলা ধরে রাখার চেষ্টা- সব মিলিয়ে আজ মনে হয় বেশ ভালো ছিলাম। বাড়ী গিয়ে আবার বলতে হতো কাদের কাদের বাড়ী গেছি আর কাদের বাড়ী যায়নি! এরকমই একবার আমাদের বাড়ীর পাশের গলিতে এক কাকুর বাড়ীতে আমরা যায়নি প্রণাম করতে কারন কিছুদিন আগে আমাদের সাথে ওদের কোন একটা কিছু নিয়ে খুব ঝগড়া হয়েছিল। শোনার পর জ্যাঠা প্রথমে দুই দিদিকে বেশ কয়েক ঘা আর আমাকে আর ভাইকে বকে ফের পাঠিয়েছিল ওদের বাড়ীতে প্রণাম করে আসতে। গিয়েছিলাম আমরা আবার। আবার নারকেল নাড়ু নিয়ে এলাম প্রণাম করে। সেদিন ভুলে গেলেও আজ বুঝি কেন দরকার ছিল ওই বাড়ীতে যাবার। বুঝি,কাউকে বাদ দিয়ে বিজয়ার প্রণাম নয়, গুরুজনরা সকলেই প্রণামের ছোটদের কাছে। আজ বুঝি, কি সময় ফেলে এসেছি! আমার ছেলে বাড়ীতে যারা আসে তাদের হয়তো প্রণাম করলেও পাড়ায় দোলবেঁধে সব বাড়ীতে প্রণাম করতে তো যায় না! ঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলাম কি! নাকি আমিই সেই অসামাজিক ব্যক্তি যার জন্য আজ আমাদের বাড়ীতে কেউ একটাও নাড়ু নিতে আসেনি! প্রশ্নগুলো থেকেই যায়!
বিজয়ার প্রণাম, ভালোবাসা, শুভেচ্ছা সবার জন্য।
*** সান্ত্বনা দিই নিজেকে এবছর তো করোনার জন্য কেউ তো বেরুচ্ছে না বাড়ী থেকে আর কাছাকাছি এসে প্রণাম করতেও নিষেধ আছে।
27102020

Comments

Popular Posts