গুঁড়ো গুঁড়ো নীল, স্বপ্ন রঙ্গিন।। (৮): চুল দিয়ে যায় চেনা।

কিছুদিন আগে ছিল মাথাময় পাখির বাসা। আর এখন পাখির বাসায় পাখিরা ডিম পেড়েছে, বাচ্ছা হয়েছে, বাসার সংখ্যাও বেড়েছে। আজকাল বাড়িতে কিছু হারিয়ে গেলেই বলা হয় দেখ তোর মাথায় আছে কিনা! আসলে সেই এবছরের প্রথমে চুল কাটিয়েছিল। তারপর আজ এতো দিন হয়ে গেছে ওর এখনো সেলুনে যাওয়ার সময় হয়নি। কিছুটা আমাদের করোনাজনিত ভয়, কিছুটা কুঁড়েমো সব কিছু মিলিয়েই ওর মাথার চুল বেড়ে চলেছে নিজের মতো করেই। প্রথমদিকে আমি এক-দুবার বলেছিলাম, 'চল কাটিয়ে আসি, কিছু হবেনা'। মুখে বললেও ভয় আমিও পাচ্ছিলাম। তারপর তো অনেক জল বয়ে গেল দামোদর দিয়ে। আমি আমার মতো করেই এই কমাসে বার চারেক সেলুন ঘুরে এলেও ওকে নিয়ে যাওয়া হয়নি বা সাহস হয়নি। তাই ওর মাথার চুল আজকাল কপাল ছাড়িয়ে চোখ ঢাকা পড়ে যায়। এরমাঝে যুক্ত হয়েছে কাজ করতে গেলে এক বিরক্তিকর পরিস্থিতি। একতো সারাদিনে বার তিনেক চান আর মাঝে মাঝে স্কুলের অনলাইন ক্লাস আর পরীক্ষার ঝামেলা। চুল আর নিজের বাগে থাকেনা কিছুতেই। তাই ওর মা সেদিন থেকে ওর ঝামেলা মেটাবার জন্য চুল বেঁধে দিয়েছে।

এখন চুল কাটানোর কথা বললেই
- যাবো একদিন। ভালো সেলুনে চুল কাটিয়ে আসবো।
- ভালো সেলুন আবার কি রে? ছোটবেলা থেকে তো বাপি কাকুর কাছে চুল কাটিয়ে আসছিস!
- ধুর! এতো বকবক করে না! তার উপর শুধুই জ্ঞান দেবে, এরকম নয় ওরকম কাটলে ভালো হয়! ওখানে যাবো না!
- আর তুই যে সেলুনে যাবি তারা বুঝি কথা না বলে চুপ করে থাকে?
- হ্যাঁ। চুপ করে থাকে। চুপ মানে চুপ করেই থাকে। আমি জিজ্ঞাসা না করলে একটা কথাও বলে না। বাপি কাকুর মতো চুল নিয়ে পিএচডি করে নি তো ওরা যে চুল নিয়ে জ্ঞান দিয়েই যাবে সারাক্ষন! আরে বাবা, দোকানে যে গানটা চালিয়ে রেখেছিস সেটুকুও শুনতে দে! তা নয়, বকে বকে কানের মাথা খেয়ে দেবে!
- বলিস কি রে? কথা না বলে চুল কাটে! চুল কাটতে কাটতে জিজ্ঞাসা করবে না কোনখানে কতটা কাটবে?
- না। ওসব কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই। প্রথমে গিয়েই যে স্টাইল দেখিয়ে দেবো সেটাই কাটবে।
- ওহ! স্টাইল! তাই বল! স্টাইল মানে কি টিক-টকের ছেলেগুলোর মতো?
- তুমি না সত্যিই! তুমি এবার একটু চুপ করো এই চুল কাটানো নিয়ে।
কিরকম ভ্যাবলা হয়ে গেলাম। সেলুনে যে চুল কাটে সে নাকি কথা বলে না। আর সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি চুল কাটতে কাটতে তরুন কাকার ধমকানো আর বড়ো হয়ে বাপির কাছে কাটাতে বসে সব সুখ দুঃখের আলোচনা চলতে চলতে কখন শেষ হয়ে যেত, বুঝতেই পারতাম না। বাপির সাথে তো আমার পরীক্ষার আলোচনা, চাকরী পাবার আগে কিরকম খাটবো সেই আলোচনা থেকে ওর বিয়ে, ওর মেয়ে কোথায় পড়বে সেই আলোচনাও হয় আজও! এখন কি তাহলে ওরা সেলুনে গিয়ে আড্ডা দেয় না! মানে, আসলে জানতে ইচ্ছা করছে যদি সত্যিই কথা না বলে তাহলে সারাজীবন একটা লোকের কাছে চুল কাটাবে কি করে! কথা বলে বুঝলাম, কার কাছে ও কাটায় তার নামও জানে না। আর প্রতিবার লোক আলাদা থাকে। তার নাম-ধাম জানার কি দরকার! উল্টে ও অবাক হয়ে যাচ্ছে, আমি এসব জিজ্ঞাসা করছি কেন! কাটাবো তো মাথার চুল, আর তাও টাকা দিয়ে- এতে অতো গল্পের কি আছে! যাই হোক, আর একটু কথা চালিয়ে গেলাম। দেখি কি বলে শেষ পর্যন্ত:
- তাহলে কোথায় যাবি রে! বর্ধমানে তো সব সেলুনই সমান। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি!
- না গো! তুমি না কিছুই জানো না। আছে, আছে! সিটি টাওয়ারে আছে। মা জানে। আমি এর আগে ওখানেই কেটেছি। ওখানেই যাবো।
- ওরে বাপরে! ওখানে কেউ যায় নাকি? ওখানে তো শুনেছি অনেক পয়সা নেয়। ওই পয়সায় একদিন মাংস খাওয়া হয়ে যাবে রে! (ভাবলাম মাংস র লোভ দেখালে চুপ হবে। এই একটা খাবারের জন্যই তো বেঁচে আছে!)
- কি পয়সা-পয়সা বলছো বলো তো! পয়সা নয়, টাকা নেয়। আর নিলেই বা কি হবে?
- না, মানে! এতো টাকা দিয়ে চুল কাটাবি! শুনতে কেমন লাগে না!
- শুনতে কিছুই লাগে না। আচ্ছা, তোমার বাপি কাকুর কাছে কত টাকা লাগে?
- আমার? আমার তো মাত্র পঞ্চাশ টাকা নেয়। তাও সেই মাসে একবার যাই। গেলে কি খাতির করে বল বাপি কাকু! চুল, দাড়ি কেটে চা খাইয়ে তারপর ছাড়ে। (বেশ গদ গদ হয়েই বললাম)
শুনে কিছুক্ষন চুপ করে তারপরের প্রশ্ন:
- আমি কত দিন মানে কত মাস সেলুনে যাই নি বলতো?
- সে তুই অনেক দিন যাসনি। তা প্রায় দশ মাস হতে চলেছে।
- আচ্ছা।
বুঝলাম। টাকা নিয়ে কিছু বলা চলে না আর যাই হোক। কিছুদিন আগেও ভাবছিল যে চুল কাটাতে যাবে। আজকাল দেখি আর সেসব কিছুই বলে না। সকালে ঘুম থেকে উঠলে ক্লাস শুরুর আগে ওরমা চুল বেঁধে দেয় আর বাকি সময় সারাদিন মাথায় পাখির বাসা নিয়েই ঘুরে বেড়ায়। আমিও বাবা এই ফাঁকে চুপ হয়ে গেছি। কি দরকার কথা বাড়িয়ে! আবার নতুন কি এক তথ্য পাবো নতুন প্রজন্মের! আমার যদিও বেশ ভালো লাগে ওর কাছে পাওয়া খবর জানতে বা ওর চোখ দিয়ে আজকের দিন দেখতে। প্রতিটা বিষয়ে নিজেদের কেমন নির্দিষ্ট মত আছে।
আর আমাদের সময়!
সকাল বেলায় রবিবার ঘুম থেকে ওঠার পরই জ্যাঠাবাবার চিৎকার:
- এই সব লাইন দিয়ে বসে যা। তরুন এসেছে। সব চুল কেটে দেবে। আমি ভাই দুজনে খালি গায়ে কম্বলের আসনের উপর বারান্দায় বসে গেলাম। আমাদের হয়ে যাবার পর দুই দিদি, তারপর বাবা জ্যাঠার চুল-দাড়ি কেটে তরুন কাকা উঠতো দুপুরে। এরই মাঝে একবার ভাই বলেছিল,
- একটু মিঠুনের মতো কেটে দাও তো তরুন কাকা!
চিরুনি দিয়েই তরুন কাকা এমন দিয়েছিল দুজনকেই যে আজও মনে আছে! ভাগ্যিস! জ্যাঠাবাবা কে বলে দেয়নি! নাহলে আর একবার হতো সন্ধ্যায়!
দেখা যাক, বাবু কবে চুল কাটাতে যান!
*** ওর ছবি নিয়ে যে এসব লিখছি ফেসবুকে যদি জানে তাহলে আমায় ছেড়ে দেবে! একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্তে থাকি আমি যে আমি যে ফেসবুক একাউন্টে ওকে ট্যাগ করি সেটা ও ন-মাসেও একবার দেখে না। আর ওর নিজের একাউন্টে তো নিশ্চিত ভাবেই আমি ব্লক! বেশ মজার। এবার যদি ওর মা ওকে গিয়ে পড়ায় তাহলে জানতে পারবে, না হলে নয়।
05102020



Comments

Popular Posts