নোলান কাকু, আমি উচ্চ-মাধ্যমিকে ফিজিক্সে একত্রিশ পেয়েছিলাম!!

একটা মতবাদ বা একটা বিশ্বাস যার ভরসায় আমরা জীবনের পথ চলি বা জীবনের কিছু সময় মেনে চলি তা যখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সময়ের অদ্ভুত মার-প্যাঁচে তখন সামনে থেকে মোকাবিলার অনেক ক্ষমতাই লোপ পায় আমাদের জীবনে। ধরা যাক, আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় চা নিয়ে আধো-ঘুমে বসে আছি। এমন সময় পিছন থেকে কেউ একজন আমার পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ভয়ে চোখ বুজে নিলাম। কিছু বোঝার আগেই কিরকম একটা ঝাপটা-ঝাপটির মতো হলো আর সেই লোকটা কোথায় পালিয়ে গেল! মাঝে এক ঝলকের জন্য চোখ খুলে দেখেছি লোকটা আসলে আমি নিজেই। মানে! মানে হচ্ছে, আমি নিজেই নিজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি! ব্যাপারটা হচ্ছে কি! এটা কি করে সম্ভব? আরো একটু ভেবে দেখলাম কাল ঘুম থেকে উঠে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে বিছানায় লেপে শীত ঘুম যাতে না কেটে যায় তাই ঝাঁপিয়ে ঢাকা দিয়েছিলাম। তো, তাতে কি হয়েছে! তা কালকের সেই আমি কি করে আজকের আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম! সকাল থেকে এসব ভেবে মাথাটা ঝিম-ঝিম করছে। যতবার ভাবছি ততবারই মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে! মানে, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, আমি ঠিক কোন সময়ে এখন রয়েছি! কালকে না আজকে! আমি কি অতীতে ফিরে গেছি না ভবিষ্যতের ছবি দেখছি! তাহলে আমার বর্তমান কি?

বিশ্বাস করুন সকাল বেলায় একটুও মদ বা গাঁজা খাইনি। তাহলে কি হচ্ছে আমার এরকম সকাল থেকে! আসলে প্রশ্নটা সেই একটাই। বার বার ফিরে আসতেই হবে সেই প্রশ্নের কাছে!
Can the future speak back?
আবার গোলমাল হয়ে গেল কেমন করে যেন! এতদিন তো শুনে এসেছি বা দেখে এসেছি এক না-আবিষ্কার হওয়া তত্ত্ব (আদৌ হবে কিনা কে জানে! আর হলে পৃথিবীর চেহারা কি হবে সেসবই ধোঁয়াশা) অনুসারে অতীতে ফিরে যাওয়া বা ভবিষ্যতে যাওয়ার মত দূরুহ কল্পনাতীত এক না-বাস্তবের টাইম-মেশিনের গল্প। কিন্তু তাতে 'গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স' (grandfather paradox) যে এক বড় বাধা। কল্পনা যেখানে শেষ হয়ে এক অন্য 'প্যারালাল রিয়েলিটি'র সন্ধান দেয়। কিন্তু আজ যা ঘটেছে তা তো আর টাইম-মেশিন এর গল্প নয়। সেখানে আর যাই হোক আজকের আমি অন্তত কালকের আমার সাথে ঝাপটা-ঝাপটি করব না। তাহলে হলো টা কি?
আচ্ছা, এতোক্ষণে একটু একটু করে মনে পড়ছে কি হচ্ছে এটা আমার সাথে। কাল আসলে অনেক রাত পর্যন্ত নোলান এর 'টেনেট' দেখেছি। সত্যি নোলান, আপনাকে বলছি,
- আপনি কি ঠিক করেছেন বলুন তো?
- আমরা এই বয়সে এসে আবার ফিজিক্স নতুন করে পড়বো?
- যেগুলো পড়েছিলাম সেগুলো সব গুলে-খেয়ে আবার আপনার কাছে নতুন করে নতুন ফিজিক্স জানবো?
না, আপনি সেরকম কখনই বলেন নি জানি। কিন্তু আমাদের যাদের ফিজিক্সের দৌড় স্কুল অবধি আর কল্পনার সর্বোচ্চ দৌড় 'যদি বাকি সব ডি.এ দিয়ে দেয়' অবধি তারা কি করব বলুন তো? আপনার ফিল্ম দেখার সময় কি ফিজিক্সের স্যার কে সাথে নিয়ে যাবো না ফিরে এসে বুঝতে যাবো? কিছুদিন আগে পর্যন্ত তো শুনছিলাম যে আপনার 'ইনসেপশন' আর 'ইন্টারর্স্টেলার' দেখতে নাকি ক্লাস টুয়েলভ অবধি ফিজিক্স পড়তে হবে(ফেসবুকীয় খিল্লি!), আর এখানে তো আপনার চরিত্র তো নিজেই বলছে সে নাকি ফিজিক্সের মাস্টার্স করেও ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছে না কি হচ্ছে! যাই হোক, যা চলছে পর্দা জুড়ে তা বুঝতে আপনি যে থিওরির কথা শুনিয়েছেন তা হল,
'Time travel? No. A technology that inverts objects.'
ইনভার্সন বা রিভার্সাল ইনভার্সন পজিশন (Inversion or Reversal Inversion position) এর গল্প না হয় কিছুটা হলেই বুঝলাম, কিন্তু ইনভার্টেড ওয়েপেন (inverted weapon)!
সত্যিই! মানলাম কল্পবিজ্ঞান। কিন্তু কিছুতেই এটা মেনে নেওয়া যায় না বুলেটটা হাতে টেনে নিতে কেন আমায় আগে থেকে বুলেটটা ফেলতে হবে! বা হয়তো ঠিকই বলেছেন, বুলেটটা আমায় ফেলতেই হবে! সত্যিই এক নতুন পোর্টালে রিয়েলিটি আর হাইপার-রিয়েলিটির সম্পর্ক এক হয়ে যায়। কি সহজে বলে দেওয়া যায়,
'We all can talk to future. But....?'
আসলে ভাবনার স্তর এমন জায়গায় যে মানুষ তার ভবিষ্যতের সাথে কথা বলছে যদিও সেটা নতুন কিছু নয়। যেটা নিয়ে এই পোর্টালে কাজ করে চলেছে তা হলো সেই ভবিষ্যত কি আবার তার অতীতে ফিরে এসে তার বর্তমানে মিশে যাবে!
ছোট বেলা থেকেই পৃথিবীর আকাশে চাঁদ আর না দেখা কয়েকটা গ্রহের নাম জেনে বড় হওয়া আমরা এই ইউনিভার্সের বাইরে কি আছে বা যা আছে তা কোথায় আছে আর তার বাইরে কি আছে- শুধু এইটুকু ভাবতে গিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলা আমরা তো কোনরকমে যখন আপনার এই 'ইনভার্সন রিয়ালিটি' তে একটু ধাতস্থ হচ্ছি তখন আপনি হাজির করলেন 'প্লুটোনিয়াম 241' এর গল্প। এতদিন যে প্লুটোনিয়াম 239 বা ইউরেনিয়াম 235 এর কথা জেনে এসেছি যা নিউক্লিয়ার ফিউশন বোম তৈরীতে কাজে লাগে তাকে ছেড়ে প্লুটোনিয়াম 241 এর এক নতুন রিয়েলিটির 'inverted weapon' কথা শোনালেন। ওপেনহাইমারের চেন রিয়াকশন (chain reaction) এর তত্ত্বর বাইরে গিয়ে প্লুটোনিয়াম 241 এর অবস্থান যা আপনার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করে। প্লুটোনিয়াম 240 যখন একটা নিউট্রন গ্রহণ করে তখন প্লুটোনিয়াম 241 আইসোটপ তৈরী করে। এমনিতে প্লুটোনিয়াম বেশ মজার যা হাত দিলে বা ছুঁলে কিছু হয় না (শুনেছিলাম হাত ভালো করে ধুয়ে নিলেই কিছু হয় না) কিন্তু যদি নিশ্বাসে মিশে যায় তাহলে এর তেজস্ক্রিয়তা আমাদের ফুসফুসে আক্রমণ করে ক্ষতি করে এবং মৃত্যু হয়। তাই কি প্রতিবার জ্ঞানত বা অজ্ঞানত আপনার চরিত্ররা ইনভার্স রিয়েলিটি ও রিভার্স ইনভার্স রিয়েলিটিতে অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করে!
থাক এসব কথা। সবাই নিজের মতো করে বুঝে নিক নোলান এর টেনেট, যেমন করে আগে বুঝেছে 'ইনসেপশন' বা 'ইন্টারস্টেলার' বা 'মেমেন্টো'। আমি আজ শুধু এই ছবি নিয়েই থাকবো। সারাদিন কেটে যাবে কালকের দেখা গল্পের জাবর কাটতে কাটতে।
সত্যিই এক জটিল তত্ত্বের ভিতে দাঁড় করানো চরিত্ররা কেমন একটু একটু করে ছবির সাথে সাথে মানসিক ভাবে আমাদের সাথেই পাড়ি দেয় এক অনন্ত যুদ্ধের পথে, তা সত্যিই ভাবায় আমায়। সত্যিই কি আজ আমাদের পৃথিবী আবার নতুন কোন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিলাসিতা করতে পারে! সেই হাত থেকে বাঁচাতেই তো নোলানের চরিত্ররা! হোক না কল্প-বিজ্ঞান! হোক না আমাদের এখনো না-জানা অন্য এক রিয়েলিটির কথা যেখানে না হয় সত্যিই শেষ পর্যন্ত দুই অতিমানব ভিলেনের হাত থেকে পৃথিবী বাঁচায়। গল্পের প্রতিটা স্তর আলাদা আলাদা করে বন্ধুত্বের বা না-হওয়া মানসিক টানাপোড়েন বা অন্য বন্ধনের গল্প শোনায়। চরিত্ররা শুধুই একমাত্রিক নয়, প্রত্যেকের প্রতিবারের উপস্থিতি আলাদা করে ভাবায়। অনেক ছোট ছোট মুহূর্ত তৈরী হয় যারা এরকম এক একশন-প্যাকড, স্পাই-থ্রিলার, সায়েন্স-ফিকশনে নোলানের 'সিগনেচার' হিসাবেই আমরা জানি। প্রতিটা চরিত্র নিখুঁতভাবেই নোলান তুলে এনেছেন- সে এক নগণ্য দু-বার পর্দায় উপস্থিত প্রিয়া (আমাদের চিরপরিচিত ডিম্পল কপাডিয়া) থেকে দ্য প্রটাগনিষ্ট (জন ডেভিড ওয়াশিংটন) প্রত্যেকেই এক নতুন সৃষ্টির কথা বলে। যে অ্যলগরিদম এর খোঁজে নেইল আর দ্য প্রটাগনিষ্ট হাজির হয় সোভিয়েত শহরে যার খবর প্রিয়া জানিয়েছিল সেখানে যে ক্যাট কে বাঁচায় তার কি এটা দ্বিতীয় উপস্থিতি না অন্য কোন লুপে সে আবার ফিরে এসেছে! এরকম অনেক প্রশ্ন নোলান যেন ইচ্ছা করেই ছেড়ে রেখেছে। তথাকথিত ভিলেন অর্থে রাশিয়ান অভিনেতা আন্দ্রেই সাত্তর এর কথা মনে রাখার মতোই। কি অবলীলায় অভিনয় করে চলে এই অস্ত্রবিক্রেতা যে নাকি পৃথিবীর নতুন বিশ্বযুদ্ধের পথপ্রদর্শক সেই বিছানায় বেল্ট খুলে বউকে অত্যাচার করে, ছেলের থেকে দূরে রাখে- দুটো মানসিক স্তরের দুটো মানুষ যা নোলান তুলে ধরেছে পর্দায়। আন্দ্রেই এর একটা ডায়লগ আমায় বেশ ভাবায় যদিও তার ব্যবহার অন্যভাবে নোলান করেছে।
'You don't negotiate with a tiger.
You admire a tiger until it turns on you, and it's it fu***ng nature!'
সত্যিই তো বাঘের সাথে কি আলোচনায় বসা চলে। খাঁচায় আটকে না রাখতে পারলে সে তো আমাদের প্রথম আক্রমণ করবে। আগামী দিনের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের যতই সমস্ত অস্ত্র আর পরিকল্পনা তোমার হাতেই বা তোমার কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কেই থাকুক তোমাকেই ঠিক করতে হবে সেই অস্ত্র কি তুমি নতুন কোন যুদ্ধে কাজে লাগাবে না তাকে ঘটতে দেয় এমন কোন ঘটনাকেই তুমি মুছে দেবে চিরতরে।
আমি নোলানের ছবি দেখি এবং পছন্দ করি। এক্ষেত্রেও আমার সেই মত। প্রতিবারের মতোই আমার ভালোলাগা তৈরী হয় নোলানের কাজে। আমি অনেকজনকে দেখতে বলি। প্রতিবারের মতো আমার নোলানের কাছে একটাই প্রশ্ন থাকে, এবার না হয় করেই ফেলি:
- আপনি এই শুটিংয়ের আগে আপনার সমস্ত চরিত্রদের আপনি কি করতে চাইছেন সেই গল্পটা জানান? বা আপনার জানানো গল্প তারা সব বুঝতে পেরে তবে শুটিং করে?
( না! সত্যিই না! নোলান দেখতে বা বুঝতে ফিজিক্সের দিকগজ হতে হয় না। আমার দেওয়া নাম পছন্দের না হলে বাদ দিন। সবাই যে যার মতোই, তাই নিজে বুঝে নেওয়াই ভালো।)
*** ছবিটা আমি কাল রাতে দেখেছি। না, কোন হল-প্রিন্ট বাজে কোয়ালিটি আমি দেখি না কখনোই, আর তা যদি নোলান হয় তার তো কোন প্রশ্নই নেই! আমি চল্লিশ ইঞ্চিতে ফুল এইচ.ডি ভার্শনেই দেখেছি। এই নিয়ে কোন প্রশ্ন-উত্তর বা কথা বলা যাবে না। কারণ সবাই সবকিছুই জানে। কয়েকদিন আগেই দেখার সুযোগ হয়েছিল, কিন্তু না দেখে কালকের অপেক্ষায় ছিলাম।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নোলান দেখুন।

Comments

Popular Posts