নন-সেন্স কথামালা! (২০): সাধের কাঁচির কচকচানি!

নন-সেন্স কথামালা! (২০)
সাধের কাঁচির কচকচানি!

- আরে! কাঁচিটা কোথায় গেল? আমার একটাও কাজের কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না কেন?
- আছে দেখো, ওখানেই কোন একটা খাপে আছে।
- ধুর! নেই বলছি তো! থাকলে কি জিজ্ঞাসা করতাম!
- তুমি! তুমি তো চোখের সামনে কিছু নামানো থাকলে দেখতে পাও না!
- হুঁ, তুমি তো বেশী জানো, আমি দেখতে পাই না পাইনা!
- জানি তো। আজ বাইশ বছর ধরে ঘর করছি। আমি জানবো না তো কি শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টির লোকটা জানবে!
- ফালতু বকবক না করে কাঁচিটা কোথায় আছে এনে দাও।
- নীচে আছে মনে হয়। কাল পার্সেল কাটা হয়েছিল। সিঁড়িতেই পরে আছে মনে হয়। নিয়ে এসো।
- এই জন্যই মাথা গরম হয়ে যায়। সবেতেই ওই কাঁচিটা লাগে না তোমাদের!
- সকালবেলায় উঠে গাঁক-গাঁক করে না চেঁচিয়ে সব নিয়ে তারপর দাড়ি কাটতে শুরু করতে পারো না!
- মানে! মানে, আমি কি করে জানবো যে আমার ওই গোঁফ কাটার কাঁচিটাই তোমাদের সবার সবসময় কাজে লাগবে!
আর উত্তর নেই। চুপ। সকাল সকাল যুদ্ধটা জিতে বেশ ভালোই লাগছিল। নীচের তলার সিঁড়ি থেকে কাঁচিটা নিয়ে এসে দাড়ি কেটে বেশ যত্ন করে আমার সাধের গোঁফ কাটার আগে ভালো করে কাঁচিটা আর একবার দেখে নিলাম। আসলে এই কাঁচিটা আর আমি- আমরা বেশ অনেক বছর একসাথে আছি। কতবছর? কি মনে হয়? দশ, পনের, কুড়ি না বাইশ? না, না। বাইশ বছর আমি তো ওনার সাথে আছি। কাঁচিটা আছে তারও অনেক আগে থেকে আমার সাথে। কবে থেকে? বিয়ের প্রায় দশ বছর আগে থেকে। কি হল? বিশ্বাস হচ্ছে না! তাহলে শুরু করি না হয় সেই গল্প!
সে বহুদিন আগের কথা! আজ ভাবলে মনে হয় যেন আগের জন্মের গল্প। ১৯৯১ সাল। মাধ্যমিক পরীক্ষা সবে দিয়েছি। রেজাল্ট বেরোনোর আগেই বিজ্ঞান বিভাগের সব বিষয়ের পড়াশোনা একটু হালকা ভাবেই শুরু হয়ে গেছে আমাদের বর্ধমান জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নামী শিক্ষক মহাশয়দের কাছে। স্কুলের বরাবরের পাকা ছেলে আমরা কয়েকজন বায়োলজির স্যারকে ধরলাম আমাদের আগে একটু প্রাকটিক্যাল করিয়ে দিন। ব্যাঙ কাটার গল্প অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি তাই স্কুল খোলার অপেক্ষা আর যেন করা যাচ্ছিল না। উৎসাহ তখন প্রায় আমাদের তুঙ্গে। হাতে-কলমে, মানে ওই আরকি, হাতে-কাঁচিতে নিজেরা ব্যাঙ কাটবো আর তা দেখতে বইতে আঁকা ব্যবচ্ছেদের ছবির মতো হয়ে যাবে-এটা ছিল আমাদের কাছে স্বপ্ন। তাই স্যার কে রাজি করাতে তিনদিনের পড়া একদিনে করে আমরা হাজির হলাম স্কুলের ল্যাবরেটরিতে। স্কুলে আমরা তখনকার মতো বহিরাগত হলেও ছোটবেলার স্কুলে ঢুকতে আমাদের তখন কোন অসুবিধাই হতো না। ল্যাবে ঢোকার পরে প্রথম কিছুক্ষণ স্যার বাইলোজি বক্সের সমস্ত যন্ত্রপাতি চিনিয়ে বললো এরপরের দিন তোরা প্রত্যেকে নিজের বায়োলজি বক্স কিনে আনবি, তারপর প্রাকটিক্যাল করানো শুরু করবো। সেদিন একটা কথা বলেছিল,
- এই বক্সে যে দুটো কাঁচি আছে দেখছিস এর মধ্যে বড় কাঁচিটা( কিছু একটা নাম বলেছিস, মনে নেই আজ আর) খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটু দেখে কিনিস। আর পারলে ওটা আলাদা করে সার্জিক্যাল স্টোর থেকে কিনিস।
কিনেছিলাম। আলাদা করেই ওই কাঁচিটা কিনেছিলাম। প্র্যাকটিক্যাল কেমন করতে পারতাম বা কত নম্বর পেয়েছিলাম সে সব আজ অতীত।
তারপরে অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। বায়োলজি ছেড়ে আমি সাহিত্যে আমার বসতি করে নিয়েছি। ধীরে ধীরে বায়োলজি বক্স ছেড়ে চলে গেলেও জীবন থেকে সেদিনের সেই ব্যাঙ কাটার ভালো কাঁচিটা সময়ের সাথে সাথে আমার পড়ার টেবিলের পেন স্ট্যান্ডে জায়গা করে নেয়। এখানে শেষ হলেই হয়তো ভালো হতো। যে কাঁচিটা হাতে নিয়ে একদিন ব্যাঙ কাটতে কাটতে হটাৎ করেই প্রিয় স্যার বলে উঠেছিলেন, "বাহঃ! বেশ তো কাঁচিটা! কাটতে বেশ সুবিধা হচ্ছে!" সময়ের ফেরে সেই কাঁচি বহুদিন হল আমার দাড়ি কমাবার স্ট্যান্ডে জায়গা করে নিয়েছে। অনেকবার দেখেশুনে অনেক কাঁচি আমি গোঁফ কাটার জন্য কিনেছি এবং অদ্ভুতভাবে সেগুলো একটার পর একটা সময়ের সাথে সাথে কোথায় চলে গেছে, রয়ে গেছে এই কাঁচিটা। বাকি সব কিছু মনে না পরলেও প্রত্যেকবার গোঁফ ছাঁটার সময় যেন মনে হয়, "বাহঃ! বেশ তো কাঁচিটা! কাটতে বেশ সুবিধা হচ্ছে!" আর বাড়ির লোক মনে করে ওরকম এক ফালতু প্রায় হাফ-জং ধরা কাঁচি দিয়ে তো কোন কাজই হয় না, তাই যার যখন যেখানে দরকার সেই ওটা কাজে লাগিয়ে নেয়- ছেলের কাগজ কাটা থেকে মায়ের সেলাইয়ের কাটাকুটি থেকে গিন্নির পার্সেল কাটা।
চলে যাচ্ছে। ওই আরকি! ত্রিশ বছর আমরা একসাথে অনেকটা পথ পার করে দিলাম। আরো কিছুদিন থাকুক না হয় সাথেই।



Comments

Popular Posts