#নোটবুক: এক মাস্টারমশাই হয়ে ওঠার কথা।।

#Notebook
#নোটবুক: এক মাস্টারমশাই হয়ে ওঠার কথা।।


ইসস!! কাশ্মীরে যদি আর কয়েকজন কবীর-ফেরদৌসের মতো মাস্টারমশাই থাকতেন!


কাশ্মীর আমার মতো অনেকেরই প্রিয় জায়গা বা স্বপ্নের জায়গা। ছোটবেলা থেকেই যেখানে যত কাশ্মীর নিয়ে ছবি বা ফিল্ম দেখেছি তাতে সব সময়ই মনে হয়েছে, এ এক অন্য জায়গা, অন্য কোন জগত যা আমাদের কাছে-পিঠে তো নয়ই আবার আমাদেরই খুব মনের কাছাকাছি, মনের গোপনে লুকনো কোন এক অধরা জীবন।
না, কাশ্মীর নিয়ে তৈরী কোন ছবির রিভিউ লিখতে বসিনি। শুধু একটা ছবি দেখলাম কয়েকদিন আগে, আর সেটার অভিজ্ঞতা বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিতেই এই লেখা। চাইবো, আমার বন্ধুরা যদি সময় পায় কখনো তাহলে যেন দ্যাখে।
যে কাশ্মীর আমি আগে দেখিনি বা পড়িনি শুধু যার গল্প শুনে এসেছি এতদিন তেমনই এক কাশ্মীরের দেখা পেলাম এই ছবি দেখতে বসে। না, সদ্য সদ্য আমি কাশ্মীর বেড়িয়ে আসিনি বা খুব তাড়াতাড়ি যাবো তারও কোনো সম্ভাবনা নেই। গিয়েছিলাম আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগে। যদিও আজ আমি সেদিনের সেই কাশ্মীর বেড়ানোর গল্প লিখতে বসিনি। বসেছি শুধু পর্দায় ছবি এঁকে চলা এক রূপকথার কাশ্মীরের গল্প বলতে। পরিচালক নীতিন কক্কর আর সিনেমাটোগ্রাফার মনোজ কুমার খাটোই দুই নতুন ছেলে-মেয়ে জাহির ইকবাল আর প্রানুতুন বহেল কে নিয়ে গোটা কাশ্মীর উপত্যকায় আর তার উলার লেকে যে এক নৈসর্গিক প্রেমের ছবি এঁকেছেন তার গল্প করতেই এই লেখা। বিশ্বাস করে দেখা যায় এমন এক ছবি যা নব্বইয়ের প্রেমের গল্প বলে চলে পর্দা জুড়ে এক কাব্যিক উপস্থাপনায়।
ছোট করে গল্পটা একটু বলে রাখি যা জানলেও ছবি দেখতে কোনো সমস্যা হবে না। শুধু দেখতে বসে পারলে কিছুক্ষনের জন্য হলেও ভুলে যেতে হয় মিলিটারি-মিলিট্যান্ট, মিশন কাশ্মীর, ৩৭০, পি.ও.কে, অনান্তনাগ আর বারামুলা ঘাঁটি তে ছোটবেলা থেকে শুনে আসা জঙ্গী আক্রমণ, পুলওমার বিস্ফোরণ, পাকিস্তানি হামলা, আই.এস.আই, লালচকে বিধ্বংসী হামলা, ঝিলমে সন্তানের লাশ, আরো, আরো অনেক কিছু শোনা বা না-শোনা হিংসার চাদরে মোড়া গল্প। অহেতুক দেশভক্তির কম্বলে নিজেকে জড়িয়ে না নিয়েই শুধু মাত্র দেশ তৈরীর কারিগরদের গল্প শুনি না হয় এই ছবিতে।
২০০৪ সালে থাই ছবি 'দা টিচার্স ডাইরি' র ভারতীয় উপস্থাপনা এই ছবি 'নোটবুক'। থাই ছবিটা 'বেস্ট ফরেন ফিল্ম' হিসাবে একাডেমি এওয়ার্ড এ এন্ট্রি পেলেও আজ অবধি 'নোটবুক' নিয়ে ভারতবর্ষে কোন প্রশংসা শোনা যায়নি। দেশের প্রচলিত সংবাদ মাধ্যম এই ছবিকে মধ্যমানের ছবির আখ্যা দিলেও আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, একবার দেখুন সময় পেলে। দুটো ছবিই আমি দেখেই বলছি, সমস্ত চিন্তা-ভাবনা, উপস্থাপনা সবেতেই 'নোটবুক' এক ভালো লাগার অনুভূতি দেবে।
প্রায় বন্ধ হতে চলা এক স্কুলে আর্মি থেকে নিজে ছেড়ে এসে কবীর পড়াতে চায় যেখানে তার বাবা একসময় পড়িয়েছিলো। স্কুলের নাম, 'উলার পাবলিক স্কুল'। ডাল লেকের জীবন যারা দেখেছেন তারাই জানেন এই লেকের জীবনের রোমান্টিকতার সাথেই লুকিয়ে আছে কি ভয়ঙ্কর বাস্তব জীবন সংগ্রাম। ঠিক তেমনই উলার লেক বলার সাথে সাথেই আমার মতো যাদের মন নেচে ওঠে তাদের বলি একটু অপেক্ষা করে যেতে। সেই দুর্গম অথচ মন জুড়ানো সুন্দর উলার লেকে এসে কবীর তার 'উলার পাবলিক স্কুলে' এসে যখন দেখে ছবির মতো এই স্কুল জলে ভাসমান এক অন্য জগত তখনও সে বোঝে না আগামী কি দিন তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। মাস্টারমশাই এখানে ভাসমান স্কুল আর একটা ছোট শিকারা নিয়ে অপেক্ষা করে আছে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। দিন পেরিয়ে গেলে যখন কেউ আসে না তখন সবজি বিক্রেতার শিকারায় মাস্টারমশাই বেরিয়ে পড়েন উলার লেকে বসতি থেকে ছেলে-মেয়ে ডেকে আনতে। পরের দিন থেকে তারা এলেও তারা আগের দিদিমণি ফিরদৌস কে ভুলতে পারে না আর সবেতেই তারা মনে করে যে এই কবীর স্যার ভালো পড়াতে পারেন না, ঠিক মতো করে বুঝিয়ে দিতে পারেন না। তাই তারা গোলযোগ করে, পড়ায় মন দেয় না। কবীর যখন ভাবতে থাকে তার বাবার স্কুলে সে কিছুতেই ভালো মাস্টারমশাই হয়ে উঠতে পারছে না, ঠিক তখন ডেস্কের ড্রয়ারে সে পায় আগের দিদিমনির এক ডায়েরি। এই ডায়েরিই কবীর কে দেয় এক আত্মবিশ্বাস, যা তাকে আবার নতুন করে শিক্ষক হতে সাহায্য করে। ডায়েরিই তাকে ফেরদৌসের সাথে এক অজানা অচেনা যোগাযোগ তৈরী করে দেয়। ইমরান নামের এক ছাত্রকে আবার স্কুলে ফিরিয়ে আনে কবীর। জন্ম নেয় এক অজানা অর্থ-সামাজিক টানাপোড়েন, যেখানে কবীরের
শিক্ষায় ইমরান তার বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হয় বন্দুক নয়, স্কুলই তার জীবন।
কবীর আর ফিরদৌস যারা এই উলার পাবলিক স্কুলের পর পর দু-বছরে আলাদা আলাদা ভাবে শিক্ষকতা করেছে, যাদের কেউ কাউকে দেখেনি, যোগাযোগ শুধু এক ডাইয়েরী মাধ্যমে - এক নতুন ভালোবাসার গল্পের জন্ম নেয়। এর পর আমি আর গল্প নিয়ে কিছুই বলবো না। এ গল্প শুধু হয়ে ওঠা এক প্রেম কাহিনী নয়, এ গল্প সারা ভারতবর্ষের যে যেখানে সমাজ গড়ার কারিগর, তাদের গল্প। এ গল্প মাস্টারমশাইদের মাস্টারমশাই হয়ে ওঠার গল্প।
গল্পের কলা-কুশলীদের নিয়ে কাটাছেঁড়া করার জন্য আমি লিখতে বসিনি। কিছু দুর্বল অভিনয়, কিছু অগোছালো এক্সপ্রেশন ছাড়া আর কোন খুঁত আমি খুঁজে পাই নি। প্রতিটি স্কুলের বাচ্ছার ব্যবহার, কাজকর্ম, হাভ-ভাব, চাল-চলন তো আমরা প্রতিদিন আমাদের স্কুলে দেখি, তাই সে নিয়ে বলতে গেলে একটাই কথা মনে হয়, এ যেন কাশ্মীর নয়, এ যেন উলার পাবলিক স্কুলের গল্প নয়, আমার পাড়ার বা আমার স্কুলের গল্প। শুধু আলাদা করে যে ভালো লাগার কথা বলতে এই লেখা শুরু করেছিলাম তা হলো এই ছবির প্রতিটা দৃশ্য। প্রতিটা শট, লং এঙ্গেল হোক বা প্যান শট হোক সবেতেই তুমি তোমার স্বপ্নে দেখা কাশ্মীরের এক ভালোলাগার, ভালোবাসার ছবি দেখবে, যেখানে নেই কোন গুলির শব্দ, নেই রক্তের দাগ, নেই আবছা অন্ধকারে মুখোশ ডাকা বন্দুকবাজের খুনী চোখ, নেই কোন সন্তান-হারা জননীর বুক ফাটা চিৎকার। হোক না ১১২ মিনিটের রূপকথার গল্প, হোক না আমার-তোমার চাওয়া সেই সাদা বরফে ঢাকা উপত্যকায় লাল-নীল-হলুদ ফুলের স্বপ্ন, তবুও তো পথ দেখায় এই গল্প। বাকি সব ফেলে যদি শুধু এই উপত্যকায় আর কিছু স্কুল আর অনেক কবীর আর ফিরদৌসদের মতো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে হাজির করা যেত!
কিছুদিন আগে কাশ্মীরে ৩৭০ উঠে যাওয়ায় ফেসবুকে মজা করেই লিখেছিলাম আমার এক মাস্টারমশাই বন্ধুকে,
"এবার সোজা শ্রীনগর। না, না, ডাল লেক নয়, উলার লেক। একটা হাউস-বোট আর সারাদিন সামনের ছোট ডেক-বারান্দায় হেলানো চেয়ারে কম্বল গায়ে রোদ মেখে 'কাবা' হাতে আধো-ঘুমে গল্পের বই!! আছিস নাকি 'মাস্টার'? তুই আর আমিই তো কাশ্মীরে দিন-রাত এক করেছিলাম।"
এর উত্তরে বন্ধু বলেছিল:
"আমি ইসবে নাই। একটো ইস্কুল খুললে ভাবতে পারি।"
আমার আজও মনে হয়, সত্যিই যদি একটা স্কুল খুলতে পারতাম কাশ্মীরে আর তোদের মতো আমার প্রিয় মাস্টারমশাইদের যদি ওখানে নিয়ে রাখতে পারতাম, তাহলে মনে হয় বরফে রক্তের দাগ আর দেখা যেত না!
** আমার সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধু-বান্ধবী, আমার সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী যারা আজ আমাদের মতোই মাস্টারমশাই হয়ে উঠতে চায় শুধু তাদের জন্যই এই গল্প।
**ছবি দেখার পর যদি ভালো লাগে তাহলে যেমন ছবি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে মন চায়, ঠিক তেমন ভাবেই আমিও খোঁজ করলাম এই ছবির বাকি সব কিছু নিয়ে। মাত্র পনের কোটি টাকায় বলিউডের 'ভাইজান' তার নিজের প্রোডাকশন হাউস 'সালমান খান ফিল্মস' এই ছবিটিতে খরচ করেছে আর তার মাত্র চার কোটি টাকা মার্চ, ১৯ থেকে আজ অবধি তুলতে পেরেছে। ছবি বিক্রি করে 'ভাইজান' কি লাভ করলো বা কেন এই ছবিতে নিজের পয়সা ঢাললো, সেটা আমার কৌতূহলের নয়। আমার ভালোলাগার হলো যে তিনি এই ছবি করতে এগিয়ে এসেছেন। ধন্যবাদ 'ভাইজান' আপনাকে শুধু এই ছবিটা করার জন্য। একশো কোটির বাইরে গিয়েও, রকেট লঞ্চার এক কাঁধে না চালিয়েও আপনার কোম্পানি এরকম এক ছবিতে পয়সা ঢেলেছে জেনে আমি খুশী।
** ছবিটা আমি হলে গিয়ে দেখতে পারলে খুশী হতাম। অগত্যা আমাজান প্রাইম ভিডিও তে দেখলাম। ছবিগুলো আমি স্ক্রিনশট নিয়েছি ছবি দেখার পর। তাই আমি কৃতজ্ঞ আমাজনের কাছে।

16.08.2019
https://www.facebook.com/sagar.dan/posts/10214729327883023
 

Comments

Popular Posts