বন্ধু, আমি গর্বিত তোমাদের জন্য!!
বন্ধু, আমি গর্বিত তোমাদের জন্য!!
প্রতিবার ভোটের ডিউটি শেষ করে লিখে রাখি কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু ঘটনা, কিছু মুহুর্ত- সে শুধু আমার নিজের জন্যই। ফিরে দেখা কোনসময়ে যেন ফিরে যেতে পারি নিজের কাটিয়ে আসা সেই সময়ে- তা সে যতই কষ্টের বা সুখের হোক না কেন! হয়তো যখন আর এই ভোটের ডিউটি করতে সুযোগ পাবো না, তখন না হয় কোন এক ভোটের দিনে সকালে চায়ের কাপ আর বাঘ মারা খবরের কাগজ সামনে নিয়ে আজকের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করবো। আর আমরা তো জানি, স্মৃতি সততই সুখের।
না। প্রথমেই বলে রাখি আমার এবার ভোটে আগের দিন সকালে বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করে ভোটের দিন রাত্রে বাড়ি ফিরে ভাত খেয়ে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত- কোথাও কোন সমস্যা হয়নি। সে আমার কাউন্টারে মাল নেওয়া থেকে জমা দেওয়া ( মাত্র ছটা পার্টিওয়ালা কাউন্টার), বুথে পৌঁছে খাওয়া-দাওয়া থেকে স্নান-বাথরুম ( প্রাইমারি স্কুলের বুথ যার প্রধান শিক্ষক মহাশয় প্যাকজেড জলের বোতল পাঠিয়েছেন), এজেন্ট থেকে ভোটার ( প্রায় একশো ভাগ মুসলিম ভোটার আর সেই স্কুলের একদিকে শত বছরের ঈদগা তো অন্য পাঁচিলে নতুন মসজিদ), সেক্টর অফিসার থেকে সেন্ট্রাল ফোর্স (বন্ধু লোকজন থেকে নানা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কমান্ডার সাহেব) - না, সত্যিই না! কোথাও কোন সমস্যা হয়নি। তাহলে কেন লিখতে বসলাম। এইরকম একটা সময়ে যখন আমরা প্রায় সবাই ভোটের ডিউটিতে যেতে একটা মানসিক চাপ অনুভব করি, সে আমি যত বার ই যত ভোটই করে থাকি কেন! সেই সময় আমি এবারের এই ভোটের ডিউটি কোনসমস্যা ছাড়া শেষ করে তাহলে কেন লিখতে বসলাম! উপরের বলা সমস্যা ছাড়াও আরো একটা বিষয় থাকে ভোট করানোর ক্ষেত্রে, শুধু সেই কথাটুকু না লিখলে আমার এবারের ভোট নিয়ে লেখা বৃথা হয়ে যাবে। তাই লিখতে বসা।
আসলে আমি আপ্লুত, আনন্দিত এবং গর্বিত কারণ এবারের ভোটের ডিউটিতে আমি তিন অসম বয়সী মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি যাদের সাথে পরিচিত হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। জানি, আগামী দিনে আমাদের আর কোথাও দেখা-সাক্ষাত না হলেও যাদের আমি পরিচিত এবং একসাথে একরাত কাটানোর জন্য গর্ব অনুভব করবো। আজ সতের বছরে বারো বার ভোটের ডিউটি করে আজ অবধি এই উপলব্ধি এবারের একেবারে নিজস্ব। প্রায় প্রতিবারই টিমের কোন না কোন একজনের সাথে একটু ভালো যোগাযোগ তৈরী হলেও কাজের তাগিদে, এবারে ছিল সম্পূর্ণভাবে আলাদা। আমরা চারজন এবারে যেন ছিলাম বহুদিনের পরিচিত কোন বন্ধু গ্রুপের মানুষ। গ্রামীন ব্যাংকের ম্যানেজার অরুণাভ আর প্রাথমিক শিক্ষকমহাশয় সূর্যকান্ত দুজনেই ছিল আমার ছাত্রের মতোই, মানে আমি যখন শিক্ষকতা শুরু করি ওরা দুজনেই তখনও প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে আসেনি! আর বিডিও অপিসের কর্মী রবিনদা ছিল আমার সমবয়সী। তৃতীয় ট্রেনিংয়ের দিন অল্প কিছু সময়ের জন্য দেখা যেন বুঝিয়ে দিয়েছিল আমাদের এবারের ভোটের অভিজ্ঞতা অন্যরকম হবে। সকাল এগারোটায় কাউন্টার থেকে প্রথম মাল পত্র বুঝে নিয়ে ফ্যানের তলায় বসে সমস্ত খামে, সমস্ত প্রযোজনীয় ফর্ম প্রায় পূরণ করে স্ট্যাম্প দিয়ে সই করে, সব ভোটার স্লিপে নাম্বারিং করে স্ট্যাম্প দিয়ে সই করে অল্প একটু টিফিন করে, আখের রসে গলা ঠাণ্ডা করে ( সূর্য আর রবিনদা, তোমাদের বাদ দিতে চাইনি, কিন্তু ওই প্লাস্টিকের গ্লাস আনা যাবে না তাই!) যখন বাস ছাড়লো তখন সবে দুটো বাজে। তখন অনেকেই কাউন্টারের ভীড়ে আটকে গেছে। আড়াইটার মধ্যে বুথে পৌঁছে (জীবনে কোনদিন এতো আগে বাস ই ছাড়ে নি!), বুথ সাজিয়ে, চান করে বেশ করে চাদর শতরঞ্জি বিছিয়ে মুড়ি সিঙ্গারা শুকনো মিষ্টি আর শসা নিয়ে বসলাম রবিনদার কয়েক মিনিটের একটু ঘুরে আসাতেই। কাজ শেষ সন্ধের আগেই। প্রত্যেকের বসার জায়গায় কি কি থাকবে তা রেখে, ফ্যানের তলায় বসার ব্যবস্থা করে, শোয়ার বিছানা প্রায় করে নিয়ে আমি আর অরুণাভ বেরোলাম একটু বাজার ঘুরতে। দিল্লি রোড থেকে তারকেশ্বর যাবার রাস্তায় একটু ঢুকে এসে এই মফস্বল এলাকা বেশ সবুজময়। সন্ধ্যার হাওয়া খেয়ে একটু হাঁটা চলা করে ফিরে এলাম। কাজ আর কি কিছু বাকি আছে? বাকি বন্ধুদের বার বার ফোনে জিজ্ঞাসা করছি, ধুর! আর কি কাজ বাকি আছে বলতো! কেন জিজ্ঞাসা করছি এরকম প্রশ্ন? এখনো বুঝতে বাকি আছে? গোটা টিমটার মধ্যে আমিই তো সেই ব্যক্তি যে প্রায় কিছুই করিনি এতক্ষন! বিশ্বাস হচ্ছে না! শুধু এটুকু বলি যে হাতে গোনা কয়েকটা স্বাক্ষর আমায় সম্মান দিয়ে করিয়েছে ওরা। আমি কি করছিলাম তাহলে এতোক্ষন! আমি আসলে মাতব্বরি করছিলাম এতক্ষন! পাশের বুথে সব খোঁজ খবর নেওয়া থেকে সেন্ট্রাল ফোর্সের সাথে আলাপ-গল্প, এইসব আরকি! এগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়! কি বলছেন, নয়! আচ্ছা, ঠিক আছে। বললাম তো, আমি ফাঁকি দিচ্ছিলাম। পরের দিন টেবিলে বসে অন্য বুথের বন্ধুরা যখন ফোন করে খোঁজ নিচ্ছিল যে ওটা করেছি কিনা, বা সেটা খামের মধ্যে ঢুকিয়েছি কিনা, তখনই সেগুলো আমি আমার হাতের কাছে ঠিক সেরকম করেই পাচ্ছিলাম। ভোট মিটলে দুজনে মেশিন সীল আর একজন ফর্ম সীল করলো। আর আমি কি করছিলাম! কেন? আমি আবার তখন মাইক্রো অবজার্ভারের কাজ করছিলাম! শেষ বারের মতো হাত-পা ধুয়ে মুখে চোখে জল দিয়ে দিদিদের কাছে শেষবারের মতো লিকার চা বেশ জমিয়ে খেয়ে বাস ছাড়লো সাড়ে সাতটায়। জমা আটটা কুড়ি, তিনজনে স্টেশনে সাড়ে আটটায়। কে জমা দিল? কেন! অরুণাভ আর সূর্য একের পর এক কাগজ মিলিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে লোক ডেকে এনে ছবি তুলিয়ে জায়গা ছাড়লো। রবিনদা স্টেশনে এসে কিছু খাওয়ার কথা বললেও একটা ভালো দোকান না পেয়ে একটু মনক্ষুণ্ণ হয়েই ট্রেনে উঠলো। আমি আর অরুণাভ দুই ভিন্ন লাইনের ট্রেনে আর সূর্য ওর বন্ধুর জন্য অপেক্ষায়। আমরা চারজন চারদিকে ছড়িয়ে গেলাম। যোগাযোগটুকু রয়ে গেল ফেসবুক এর হোয়াটস আপের দুনিয়ায়। জানিনা, আবার কবে দেখা হবে! তবে এটুকু জানি এরকম একটা টীম পেলে যে কোন ভোটের কাজের মানসিক চাপ অর্ধেক হয়ে যায়।
আমি ভাগ্যবান এরকম তিনজন মানুষের সাথে পরিচিত হতে পেরে।
আমি ভাগ্যবান এরকম তিনজন অসমবয়সী বন্ধু পেয়ে।
ভুলেও জিজ্ঞাসা করবেন না, আমাদের টীমে কে কি কাজের জন্য নিযুক্ত হয়েছিলাম! মানে, ওই আর কি! আমি করেছি সব থেকে কম কাজ, তাই আমি অবজার্ভার। আর ওরা তিনজনে ছিল সবকিছু, মানে ওরাই বাকি সব অফিসার। আমায় মাঝে মাঝে ওদের কাজের জায়গায় একবার করে বসতে দিয়ে ধন্য করেছে। যদিও সূর্য একবারও ওর জায়গায় বসতে দেয় নি, ঠিক তেমনি একটা সময় দেখলাম সূর্য নিজেই তিনটে কাজ একজায়গায় নিয়ে একাই করে চলেছে এবং বাইরে তখনও বেশ কিছু ভোটার!
আমি খুশী বন্ধু, তোমাদের আমার ভোটের ডিউটিতে সঙ্গে পেয়ে।
*** আচ্ছা, এবার বলুন তো, এই পরিচিত হওয়া, এই কাটিয়ে আসা সময়, এই মুহূর্তের কথা লিখবোনা তো কি থাকবে আমার স্মৃতির মণিকোঠায়! প্রথমদিনের আপনি থেকে কখন তুমি/তুই হয়ে গেছে নিজেরাই বুঝতে পারি নি!
*** আমাদের ছবি গুলোর সাথে এজেন্টদের ছবিগুলো রেখে দিলাম। বেশ ভালোই ছিলেন। যদিও প্রথমদিকে একটু এদিক-ওদিক করলেও পরে বুঝে গিয়েছিল, এ বুথে কিছু করা যাবে না!
.
.
.
#4thphaseHooghly #10_4_21
Comments