খেয়ে-বেড়ানো! (৫): খাদ্যমূল্য না মূল্যবান খাদ্য!

 খেয়ে-বেড়ানো! (৫)
খাদ্যমূল্য না মূল্যবান খাদ্য!

জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি এক বর্ষামুখর দার্জিলিং এর সন্ধ্যা। সন্ধ্যা না বলে রাত বলাই ভাল, ঘড়িতে আটটা বেজে গেছে। ঝড়ো ঠান্ডা হাওয়া আর মাঝে মাঝেই এক পশলা বৃষ্টি বিকেল থেকেই রাস্তা প্রায়
শুন-শান। রাস্তায় স্থানীয় মানুষ জন প্রায় নেই বললেই চলে। আর বেড়াতে আসা দু-এক জন হোটেলেই লেপ-মুড়ি দিয়ে গরম পানীয়ে খোশ গল্পে মেতেছে। শহর জুড়ে একে করোনার ভয় সাথে এই আবহাওয়া-বাইরে বেরুবার খুব প্রয়োজন ও মানুষ প্রায় এড়িয়ে চলছে। রাস্তা জুড়ে ঝলমলে আলো আর যতদূর দেখা যায় সাদা মেঘ খেলা করে চলেছে উদ্দাম শীতল হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে। রুম-হিটারে গরম করে নেওয়া ঘরের বড় কাঁচের জানলা দিয়ে মেঘ-বৃষ্টির এই খেলা দেখে সন্ধ্যা কাটিয়ে দেওয়া তো সেই স্বপ্নের বেড়ানোর দিনগুলোর কয়েকটা দিন। কিন্তু হলে কি হবে! আমার কপালে কি এত সুখ সহ্য হয়! তাই সেই যে বেড়িয়েছিলাম বিকালে হোটেল থেকে সবাই মিলে তারপর সবাই বৃষ্টি দেখে হোটেলে ফিরে গেলেও ম্যালের ওই কাঠের সবুজ ঘরটায় আমি আর ছেলে কতক্ষন কাটিয়েছি তা আর মনে নেই। একবার খেয়াল করেছিলাম প্রশস্ত ম্যাল জুড়ে বড় বড় জলের ফোঁটা ধুইয়ে দিয়ে যাচ্ছে পাথরের উঠান। তবুই ওই বই ঘরের একপ্রান্তে ছেলে অন্যপ্রান্তে সেই বৃদ্ধ জ্যেঠু আর সামনের দরজার পাশেই আমি- যেন মনে হচ্ছিল তিনজন তিন দ্বীপের বাসিন্দা। আমারও খেয়াল হতো না যদি না ঘন্টা খানেক কাটাবার পর আমি একটু ধূমপানের জন্য বারান্দায় না আসতাম! এসে যা দেখলাম, তাতে এখন বেরুলে ভিজবো তো বটেই, সাথে আর কি কি হবে কে জানে! কিছুক্ষণ পরেই এলো সেদিনের মতো দোকান বন্ধের সময়। বৃষ্টি সাথে নিয়েই বেরিয়ে পরলাম দুজনে। ম্যাল বা রাস্তায় একজনেরও দেখা নেই। কেউ কোথাও নেই। বৃষ্টিতে ভিজব জেনেই দুজনে বৃষ্টিকে ফাঁকি দেবার খেলায় একটু ছুটে, একটু হেঁটে একটু নিজেদের সাথে মস্করা আর ছদ্ম ভয় পেতে পেতে এগুতে লাগলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। পেরিয়ে এলাম সেই জমজমাট মোড় জনমানবশুন্য দেখেই। এরপর একটু উপরের দিকে আমাদের গন্তব্য। এবারের থাকার রিসোর্টের অবস্থান বেশ অনেকটাই উপরের দিকে। তাই বৃষ্টিকে লুকিয়ে-চুড়িয়ে এপ্রান্তের গাড়ি বারান্দা তো ও হোটেলের লবি- ছুটে চলেছি দুই বাপ-ব্যাটায়। আমাদের এই কেরদানি দেখার লোক যদিও কেউ নেই। এমন সময় একদিকের বন্ধ গ্যারেজের পাশ থেকে কেউ যেন বললো,
- ভাইয়া! লিজিয়ে না, বহুত আচ্ছা হ্যায়!
একটু চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি দুটো ছেলে, বয়সে আমার ছেলের মতোই সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
- ক্যেয়া?
- দ্যেখিয়ে না! টেস্ট কিজিয়ে! আচ্ছা লাগে তো লিজিয়ে!
সামনে বার-বি-কিউ করার একটা ছোট ওভেন, নিভু নিভু কাঠ-কয়লার আগুন আর সামনে কিছু লম্বা শিক নিয়ে দুই ভাই দাঁড়িয়ে আছে।
- কাঁহা! কুছ তো নেহি হ্যায়!
- হ্যায় না। বহুত আচ্ছা সে বানায়া।
একটা টিফিন বক্সে কিছুটা ম্যারিনেট করা চিকেন, ঠান্ডায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গায়ে একটাও গরম জামা কাপড় না নিয়েই দুজনে দাঁড়িয়ে আছে।
- সাম সে কুছ খরিদারি নাহি হুয়া!
বলে কি? তাহলে এতক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? বাড়ি কোথায়? এত কথা জানার আগেই বললাম,
- আচ্ছা, দো শিক বানা দিজিয়ে!
খিদে পেয়েছে সেটা যেন ওই আগুন আর চিকেন দেখেই বুঝতে পারলাম। ভয়ও লাগছে। এরম সময়ে বাইরে খাওয়া, ছেলেটাও সাথে রয়েছে। যাই হোক, এক-দুটো খেলে কিছু হবে না! আর হোটেলে ফিরে ওর মাকে না বললে তো আর কিছুই হবে না! আমার কথা শুনেই দুজনে লেগে গেল জোগাড় করতে সব। বৃষ্টি ভেজা প্রায় নিভন্ত আঁচকে হাওয়া দিয়ে জাগিয়ে তুলে দুটো শিকে পাঁচ পিস করে ছোট ছোট মাংস দিয়ে বসিয়ে দিল। এরমাঝেই নজর রাখছে আমরা যেন ভিজে না যাই তাই নিজের জায়গাটাও প্রায় ছেড়ে দেয়। খুব তাড়াহুড়ো করেই আমি বললাম, যা হয়েছে এবার দাও। দুজনে দুটো কাগজের প্লেটে নিয়ে গরম গরম মুখে দিয়েই বুঝলাম, আহা! কি বানিয়েছে! বেশ মনের মতন। নরম হয়ে যাওয়া পোড়া মাংস আর উপরে ছড়ানো লেবুর রস আর নুন- আহা! মনটা কেমন হয়ে গেল। মুখ থেকে গলা হয়ে যা নামছে তা যেন অমৃত! শেষ হতে একমিনিটও লেগেছে কিনা সন্দেহ আছে। ওই ঠান্ডায় গরম ধোঁয়া ওঠা প্রতিটি মাংসের টুকরো যেন জিভে পরার সাথে সাথে মিলিয়ে যাচ্ছিল। ওরাও বুঝতে পেরেছে যে আমাদের ভালো লেগেছে।
- অর থোড়া বানাউ?
- কিতনা হ্যায় অর?
- হ্যায় কুছ। আপ কো কিতনা চাইহে?
- জিতনা হ্যায় সব বানা দিজিয়ে!
একটু অবাকই হয়ে গেছে। ভাবে নি। একে তো এরকম সময়ে বিক্রি হবে সেটাই আশা করেনি। আর আমিও দেখেছিলাম ওই টিফিন বাক্সে ম্যারিনেট করা মাংসের পরিমান আমার সাথে থাকা মাংসাশী লোকজনের কাছে কিছুই নয়। তাই, হোক। সবটাই হোক। এমনিতেই আমরা সাড়ে পাঁচজনে দুকেজি বার-বি-কিউ চিকেন সন্ধ্যায় চা বা কফি দিয়েই শেষ করা লোকজন! আধ-ঘন্টার মধ্যে প্রায় আটটা শিক আর ওই ছোট বার-বি-কিউ ওভেন, চারপাশে আমরা চারজন- দুই ভাইয়ের একজন হাওয়া করছে তো অন্যজন ব্রাশে করে সস লাগিয়ে উল্টে পাল্টে পোড়াচ্ছে, অন্যপাশে আমি আর ছেলে ঠান্ডায় হাত দুটো পারলে ওভেনের উপরেই রেখে দি। বৃষ্টি তেজ একটু কমলেও আমার কৌতূহল একটুও কমেনি। শেষ অবধি প্যাকেট করে পলিথিন মুড়ে, সবটুকু স্যালাড আর সস মুড়ে দিয়ে(জানি, ওগুলো বাইরের কাটা, এই সময় ঘরের লোকজন খাবে না। তাতে কি! নিজে থেকে দেওয়ার আনন্দকে আমি নষ্ট করি কি করে!)যখন ফিরে এলাম তখন আমার ওদের দুইভায়ের সাথে পরিচয়টা একটু বেশিই এগিয়ে গেছে।
- নাম? ধাম?
- কি আছে নামে? ধরে নিলাম বাপ্পা আর বাপি দুই ভাইয়ের সংসারে এক ছোট বোন আর মা। থাকে একটু নিচের বস্তিতে। হেঁটে আসতে প্রায় একঘন্টা লাগে। সন্ধ্যায় বসে এই বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানের সামনে। তারজন্য এখানকার অদৃশ্য মালিককে দিতে হয় সপ্তাহে দুশো টাকা। আজ সন্ধ্যা থেকে একটা মুরগির একটুও বিক্রি হয়নি। কাল সকালে দুজনেই হাটে বসবে উলের জামা কাপড় নিয়ে, কলেজ বন্ধ থাকায় একটু বাড়তি উপার্জনের চেষ্টা।
একটু মনখারাপ আর একটু ভালো লাগা নিয়েই হোটেলে ফেরত এলেও ছেলেকে বললাম তুই রুমে যা, আমি পরে যাচ্ছি। কিচেনে গিয়ে ওদের বুঝিয়ে উপরে এলাম কিছুক্ষন বাদে।
আধঘন্টা বাদে আমাদের ডাইনিং এ স্টার হোটেলের দামী বাসনে গরম ধোঁয়া ওঠা সেই শিক কাবাব বাকি নিরামিষ খাবারের পাশে একটা প্লেটে সাজিয়ে যখন এল তখন বাকিরা একটু অবাক হচ্ছিল যে অর্ডারের বাইরে কি করে খাবার সার্ভ করছে!
যাই হোক, এবারও প্লেটটা শেষ হতে দশ মিনিটেরও কম সময় লাগলো। এমনিতেই আমরা মাংসাশী। তাতে এই অপূর্ব স্বাদ।
স্টার হোটেল হোক আর রাস্তার ফুটপাতে কেনা হোক- খাবারের স্বাদই আমাদের টানে আজও! সময়, পরিস্থিতি একটু ভয় পাইয়ে দিলেও লোভ তো ছাড়তে পারি না! কবি কিন্তু বুঝতে পেরেছিল আমি কি করেছি। দাদার একটু দেরী হলেই ও বুঝে নেয় আমি কিসে ব্যস্ত! যদিও বৃষ্টিতে ফেলে যখন চলে এসেছিল তখন একবারও দাদার কথা মনে পড়েনি। বললেই উত্তর আসবে, আমার তো অতো লোভ নেই, আমার পাঁচ-ছ পিস পেলেই হবে!
তাই, দিনের শেষে ঠান্ডায় বৃষ্টি ভিজে একটু গরম ধোঁয়া ওঠা কাবাব আর....!
.
.
.
16.01.2021






Comments

Popular Posts