খেয়ে বেড়ানো (৬): পিঁড়ি পেতে সামান্য ব্যঞ্জন!

 খেয়ে বেড়ানো (৬)

পিঁড়ি পেতে সামান্য ব্যঞ্জন!

"ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।"
না, না! আমি কিন্তু মোটেই এরকম বলছি না। এসব কবিরা বলে।
আমি ঠিক উল্টো বলছি। পিঁড়ি পেতে সামান্য ব্যঞ্জন বেড়ে দিলে আমি ভালোবেসে খেয়ে নেব, কে বললো তোমায়? রাজভোগ, কালিয়া, পায়েস না পেলেও চলবে কিন্তু একমুঠো ভাত আর ডাল সাথে পুঁটি মাছের ঝাল একটু সাজিয়ে একটু গুছিয়ে পাশে বসে না খাওয়ালে খাই কি করে! একটু ভালো খাওয়া- শুধু এইজন্যই তো বেঁচে আছি!
কতবার বলেছি যে একটু ভালো খেতে পেলেই আমার মন ভরে যায়। আর সেই বার বার আমার বলার সুযোগ নেয় কবি। জানে, দাদাকে দিয়ে যা খুশি করানো যায় শুধু মন ভরে খাওয়াব বললেই। সেরকমই একদিন সন্ধ্যায় এসে বললো
- কাল সকালে রেডি হয়ে থেকো। একজায়গায় যাবো।
- যাবো। আমার তো এমনিতেই কোথাও যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু জায়গাটা কোথায়?
- সে তোমায় না ভাবলেও চলবে।
- আচ্ছা, তাই।
পরেরদিন সকাল সকাল উঠে বেরিয়ে পড়লাম ওনাদের সাথে। আমার তো কোথাও যেতে আপত্তি নেই। ওনারা গাড়িতে গেলেও আমি আমার বুলেটে বেশ ফুরফুরে মেজাজে চলেছি। ভরা বর্ষায় একফোঁটা বৃষ্টি না হওয়া সকালের চিড়চিড়ে রোদ প্রথম ঘন্টায় ভালো লাগলেও আসতে আসতে মেজাজ গরম হতে শুরু করেছে শুধু রাস্তার অযাচিত হাম্প আর ধুলো আর ক্রমশ অচেনা গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে। এক জায়গায় এসে বাবু থেমে গেলেন। উনি নাকি এদিকে যাবার রাস্তাটা ঠিক জানেন না। কে একজন আসবে সে নিয়ে যাবে! মেজাজ আর তখন আমার নিজের আয়ত্তে নেই। ক্ষিদে, রাস্তার ধুলো, গরম সব মিলিয়ে আমি পারলে বাইক থেকে নেমে ওকে দু-ঘা লাগিয়ে দিই আরকি! অনেক কষ্টে চুপ করেই থাকলাম। যাইহোক, তার দশ মিনিটের মধ্যেই পৌছালাম যেখানে কবি আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছিল। প্রথম দর্শনেই ভালো লাগলেও আমার মন খুঁত খুঁত করে অন্য বিষয় নিয়ে। সেটা যতক্ষণ না দেখি বা পাই ততক্ষণ শান্তি পাই না। বাইরের বারান্দায় জলের সামনে বসতে বসতেই হাজির হয়ে গেল বড় কাঁচের গ্লাসে ঠান্ডা নুন লেবুর শরবত! প্রথম প্রলেপ বেশ ঠান্ডা-শীতল। একটু ভালো লাগা। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই সুন্দর কাঁচের কাপে সুগন্ধি লিকার চা! এযেন কোন কিছু চাওয়ার আগেই এসে হাজির হয়ে যাচ্ছে! বাড়িতেও ঢুকে শরবতের পর না চাইলে চা পাওয়া যায় না! শুরুটা বেশ ভালোই লাগছে। কিন্তু যতই হোক রাগ এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া যায় না! তাই বেশ গম্ভীর মুখেই চান করতে ঢুকলাম। ওহ! ও! বাথরুমের অর্ধেক ছাদই নেই! আর মাঝখান থেকে উঠে গেছে বিরাট এক পিয়াল গাছ। তার একদিকে শাওয়ার আর অন্য দিকে বাকি সব কিছু। চারিদিক ঘেরা আর মাথায় পিয়াল ছায়ায় শাওয়ারে চান করে ঠান্ডা হয়ে যখন খাবার জায়গায় এলাম তখন সবাই আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। বেশ রাক্ষুসে ক্ষিদে নিয়েই পুকুর পাড়ে প্রায় জঙ্গলের মাঝে ডাইনিং টেবিলে বসলাম দুপুরের খাবার খেতে। একপাশে যত রাজ্যের ফল-ফুলের গাছ যারা বর্ষায় সবুজ হয়ে দুহাত বাড়িয়ে আছে আর অন্যদিকে জল টল টল পুকুর শালুকময়। সত্যিই এক মনোরম পরিবেশ। এসবে আমার কিছু এসে যায় না এইসময়। এরপর অজয় আর এর তার সহকারী একটা একটা করে প্লেট এনে রাখতে শুরু করল আমাদের সামনে। দেওয়া শেষ হওয়ার আগেই আমি নরম হতে শুরু করেছি মনে মনে শুধু পরিবেশন আর দেওয়ার ভালোবাসায়। একটু মনে রাখার জন্যই নিজেকে বলে রাখি। এরপরের বাকি সব খাবার সব সময়ই একই ভাবে ওরা দিয়ে যেত আমাদের সামনে।
কাঁসার থালা, বাটি, গেলাস যতগুলো দরকার তার থেকে একটা করে বেশি, কাঁচের জারে ঠান্ডা জল আর কাঁচের/কালো ম্যালামাইনের বড় পাত্রে বাকি সব কিছু। শেষ পাতের পায়েস আর মিষ্টি আলাদা করে কাঁসার বাটিতে। সাজানো এর আনার পর তার সুগন্ধ মন ভরিয়ে দেয়। আজকের দুপুরের খাবার নিয়ে এর পর থেকে মোট দুদিনে যে আটবার আমরা খেতে বসেছিলাম, প্রতিবারই ছিল এই একই ভাবনায় খাবার পরিবেশন। আর খাবারের স্বাদ কেমন ছিল তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না! তা না হলে আমি লিখতে বসলাম কেন! এবারের খেয়ে-বেড়ানোর পর্ব আমার গল্প দিয়ে নয় শুধু খাবারের রকম আর তার স্বাদে আমায় মোহিত করে রেখেছিল। কিছু তথ্য যা শুধু মনকে শান্তি দেয়, যা না জানলে আপনি আমার মতই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন কি করে- তাই বলে রাখা!
দুপুরের লাঞ্চে ছিল- ভাত, সরু করে আলুভাজা, সবজির ডাল, পোস্ত আর লাল লঙ্কার ফোড়ন দেওয়া লাল শাক, পটল-চিংড়ি(আলুর পরিমান কম), লোকাল পুকুরের মাছের ঝাল, আমড়ার চাটনি, ঘন হয়ে যাওয়া দুধ আর খেজুর গুড়ের পায়েস। ওহ! স্যালাড ছিল, বেশ সুন্দর করে সাজানো। খাওয়া শেষ করেই মনে হল এবার নিজের রাগটা একটু কম দেখিয়ে কবির সাথে কথা বলাই যায়। খেয়ে আমি বেশ খুশিই হয়েছি। যদিও এই ভাবটা ওকে এত তাড়াতাড়ি না বোঝানোই ভালো। খেতে বসে থেকেই যদিও ভাই আমায় বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছে! আসলে জানে তো, দাদার কিসে সন্তুষ্টি! যাই হোক, খাওয়া শেষ হতে না হতেই নামলো আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। বারান্দায় বসেই কেটে গেল গল্পে আর আড্ডায় সারা দুপুর। বিকালে এক কাপ লিকার চা বলার আগেই এসে হাজির এই বৃষ্টিতেই। দুপুরের খাবার হজম করতে বাইরে বেরুতে না পারলেও গিন্নিদের ছবি তুলে দিতে আর নিজে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে একটু বৃষ্টি ভিজে আর একটু হাঁটা-চলা করেই সন্ধ্যার আড্ডায় বসলাম। হাজির আবার অজয়। এবার ঘরের সামনের বারান্দায় বিরাট দুটো ট্রে নিয়ে হাজির। - আবার কি আছে! আর কিছু খাবো না। একেবারে রাত্রে খাবো।
- তেমন কিছু নেই। আড্ডা দিচ্ছেন তো, তাই! শুরু করুন, আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
না, না! সত্যিই আহামরি কিছু নেই। আছে একটু শুকনো মুড়ি একটা বড় কাঁচের পাত্রে। আর তার সাথে দুটো বড় পাত্রে কিছু ভাজা-ভুজি। জোয়ান পাতা বেসনে ভাজা আর পিঁয়াজ পকোড়া। কিন্তু শুধু এইটুকু বললে যে অজয়ের খাবার পরিবেশনের শৈল্পিক স্বত্বাকে অস্বীকার করা হয়। অন্য আর একটা ট্রে যেটা এতক্ষন দেখিনি তাতে রয়েছে আটটা কাঁসার বাটি, আর তাতে আলাদা করে সরু করে বেশ ঝিরি ঝিরি করে কুচনো গাজর, পেঁয়াজ, শসা, লঙ্কা, টম্যাটো, নারকেল আর বাকি গুলোয় একটায় তেল আর চানাচুর। কোনটার সাথে কোনটা যাতে মিশে না যায়! শুধু মুড়ি খাওয়াটা এই ভাবে সাজিয়ে পরিবেশন করলে বলুন তো আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন কিনা!
একটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি। সব খাবারই কিন্তু যতবার খুশি ততবার নেওয়া যায়। আপনি নিতে না চাইলেও অজয় এসে আপনাকে ভালোবেসে আরো বেশি খাওয়াবে।
রাত্রে খেতে যাওয়া ছিল এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। জঙ্গলের পাশ দিয়ে বৃষ্টিতে যাবার জন্য পায়ে চলা রাস্তার পাশে রেখে যাওয়া ছোট ছোট ব্যাটারি লাইট যা শুধু এই সময়টুকুও জ্বালা হয়। বসা মাত্রই হাজির রাত্রের খাবার। এবেলায় প্রত্যেকে তার পছন্দ জানিয়ে দিয়েছে আগেই। তাই ছিল- ভাত, রুটি, মিক্সড ভেজ ভাজি, ডাল, খাসির মাংস, মুরগির মাংস, আমের চাটনি, নরম পাকের কালাকঁদ মিষ্টি আর সেই ওবেলার মতন সাজানো স্যালাড। খাসির মাংস নিয়ে আলাদা করে কিছু না বললেও শুধু মুরগির মাংসের কষা আর ঝোলের মাঝামাঝি যেটা পাতে দিয়েছিল তা দিয়ে আমি তো এমনি এমনি এক থালা ভাত খেয়ে নিতেই পারি।
না, এবার অন্তত রাতে শুতে যাবার আগে কবিকে বলাই যায় যে নিয়ে এসে ভালোই করেছ। থাক! আজকের দিনটা। কাল তো থাকবো। দেখি কি হয়! পরশু না হয় দেখা যাবে।
সকাল হল চারিদিকে নানা পাখির নানা ডাক আর পরিস্কার মেঘমুক্ত সূর্যের আলো, লিকার চা আর বারান্দার সামনের জলে ফুটে থাকা শালুকের হাসি মুখ দেখে। সামনের জঙ্গল ঘুরে খাবার টেবিলে বসতেই হাজির দিনের প্রথম খাবার। দেখেই মন ভরে গেল।
ফোলা ফোলা লুচি, কালোজিরা ফোড়ন দিয়ে সাদা আলুর তরকারি (অল্প ভাজা অল্প সেদ্ধ), কলা, ডিম সেদ্ধ, খেজুর গুড়, ছোলা ভেজা, আর আনারস।
অল্প করে একটু খেয়েই অজয়ের সাথে নৌকায় চেপে শিবাই নদীতে। দুপাশে জঙ্গল আর জল আর চারপাশে জানা-অজানা নানান পাখির আওয়াজে মন ভেসে গেল বহুদূরে। ফিরে এসে একটু জঙ্গলের খোলা বাথটাবে চান আর তারপরেই সেই সাজানো খাবার। আজ একটু অন্যরকম রান্না। একটু পুরাতন গ্রামীন স্বাদে বদলে গেল আমাদের রসস্বাদন।
ভাত, স্যালাড, সবজির দিয়ে মুগ ডাল, পোস্ত ফোড়ন দিয়ে থোড় ভাজা, রসুন ফোড়ন দিয়ে লাল শাক, আলুপোস্ত, অল্প একটু ঘি দিয়ে নিরামিষ মোচা, পিয়াঁজ দিয়ে পুঁটি মাছ ভাজা, দেশি কাতলা মাছের ঝাল, আমড়ার চাটনি আর শেষ পাতে রসগোল্লা। যা পরিমান দিয়ে যায় সেটাই আমরা শেষ করতে পারি না তো আর আলাদা করে দিতে বলবো! আলাদা করে অন্য কোন পদ রান্না করার কথা বলারই দরকার নেই। আজকের খাওয়াটা সত্যি একটু বেশি হয়ে গেল। এরপর একেবারে রাত্রে খাবো মনে করে দুপুরে একটু পাশাপাশি ঘুরে এলাম জঙ্গলে। ফিরে এসেই দেখলাম আবার হাজির সন্ধ্যার মুড়ি। সেই একই ভাবে সাজিয়ে। খাবো না বললেও অজয় ছাড়বে কেন! আজ তো খেতেই হবে একটু হলেও! আজ মুড়ি দিয়েছে মোচার চপ দিয়ে! অগত্যা, দু-এক পিস আরকি! আসলে রাত্রের খাবারের জন্য যতটা পেট খালি রাখা যায়! সন্ধ্যার বৃষ্টি আর আড্ডায় কখন যে রাত দশটা বেজে গেছে খেয়ালই নেই। বসে গেলাম রাত্রের আহারে। আজ খুবই অল্প খাবো বলেই রেখেছিলাম। তাতে কি! সামনে সাজানো ভাত, রুটি, ধোঁকার ডালনা, খাসির মাংসের ঝোল, মুরগি কষা, নরম পাকের সন্দেশ আর অবশ্যই স্যালাড। না, আজ আমি সব খাইনি। এতো খাওয়া যায় না! রুটি আর দু-এক পিস মাংস খাবো ঠিক করেও দেখলাম শেষ অবধি সবই খেয়েছি।
আহা! দুদিনের এই খাওয়া আর থাকা আমার মন ভরিয়ে দিয়েছে। এবার ভাইকে বলাই যায়, তোর জন্যই হল। ভালোই করেছিস, জোর করে এখানে নিয়ে এসে! আসার সময়ের সব কষ্ট ভুলে গেছি। এখানে আসার পর থেকে খাওয়া আর আতিথেয়তা সব ভুলিয়ে দিয়েছে। তিনি এর আগে দুবার এখানে এসেছিলেন, তাই এবার আমায় নিয়ে আসার এতো ইচ্ছা। যাইহোক, ভালোই। বেশ ভালো।
জায়গাটা কাটোয়ার পাশে। বেলুন ইকো রিসোর্ট। একপাশে শিবাই নদী আর অন্যদিকে জঙ্গলের মাঝে খুব ছোট প্ৰাকৃতিক জল জঙ্গলের মাঝে চারটি বাতানুকল ঘর আর জল উপচে বারান্দায় আসা এই জলবাড়ি। সব দেখাশোনা থেকে খাওয়া, নদীতে নৌকায় নিয়ে পাখি দেখিয়ে আনা- সব দায়িত্ব নিয়ে করে অজয়। বুকিং ওর কাছেই করা যায়। পাখি চেনাতে অজয়ের জুড়ি মেলা ভার। চারিদিকে নানা ফল আর ফুলের গাছ(সাজানো নয়, যেমন ভাবে পরিবেশগত ভাবেই হয়েছে), অজস্র পাখি, ছোট নদী, জঙ্গল তৈরির চেষ্টা, অনেক জঙ্গলের ছোট খাটো প্রাণী (বনবিড়াল)- সব মিলিয়ে দু-দিনের জন্য হারিয়ে যাওয়াই যায়। আর যদি আমার ভাইয়ের মতো ভাগ্যবান কাউকে পান তাহলে ঠিক আপনাকে নিয়ে যাবে বৃষ্টির দিনে।















Comments

Popular Posts