তবুও আমি ব্রাজিল।। (দ্বিতীয় পর্ব)

তবুও আমি ব্রাজিল।। (দ্বিতীয় পর্ব)
এরপর এলো ইতালিয়া ৯০'। দশম শ্রেণী। 'শিয়ালমারা' আর 'লালচিংড়ি' (আমাদের শহর এর দুই বিখ্যাত স্কুল, সি এম এস আর মিউনিসিপ্যাল বয়েজ) করে করে গলা ফাটিয়ে, সাদা কালো ছবির 'খেলা' পত্রিকা ছেড়ে বাবা র ই এনে দেওয়া রঙ্গিন ছবিওয়ালা 'স্পোর্টসষ্টার' আর 'স্পোর্টসওয়ার্ল্ড' এর দৌলতে আমি এখন বেশ জানি বিশ্বকাপ আর তার খেলাগুলোর হালহকিকত। এই চার বছর আমি কাঙাল এর মতো এই বই গুলো থেকে শুষে নিয়েছি ইউরোপিয়ান ক্লাব ম্যাচ এর গল্প, গুলিট, বাস্তেন, ম্যাথুজ, বাজ্জিও, স্কিলাচি, লিনেকার, ক্লিন্স ম্যান আরো আরো অনেক কিছুই। পাগলের মতো চ্যানেল বদলে বদলে খুঁজে গেছি কোথায় দেখা যায় এই খেলা গুলো। কি ভাবে দেখা যায়। বিনা পয়সায় দূরদর্শন এর স্টেফি গ্রাফ আর বুম বুম বেকার (যদিও আমার প্রিয় ছিল সাবাতিনি আর আন্দ্রে আগাসি) দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমি তখন। কেবল চ্যানেল এসে গেছে যদিও, তবুও খুঁজে পাই না। আর যদিও বা একটা দুটো ফাইনাল দেখতে পাই, তাও সেই মাঝরাতে। সামনে মাধ্যমিক এগিয়ে আসছে। সবাই বেশ ব্যস্ত পড়া আর পড়তে যাওয়ায়। না, সবাই নয়। আমাদের ক্লাস টেন বি সেকশন এর একটা গোটা পাগল দল ছিলো, যাদের সারাদিন যেত এই গুলো আলোচনা করে আর স্কুল এর টাইম এ নতুন পাওয়া 'স্পোর্টসষ্টার' আর 'স্পোর্টসওয়ার্ল্ড' এর পাতা জোড়া ছবি আর মাঠ দেখে, আর লেখা গুলো মনে হয় খুব কম ই পড়তাম। শুধু কিছু সংখ্যা আর রেকর্ডস গুলো মাথায় নিয়ে নিতাম। স্কুলে র বন্ধুরা বেশ ভাগ হয়েই গিয়েছিলাম এই বিশ্বকাপ নিয়ে। টীম ও প্রত্যেকই ঠিক করে ফেলেছি। সবাই প্রায় তাদের স্বপ্নের প্লেয়ার এর নাম ও জানে, সে এবার বিশ্বকাপ এ কি করবে সেই দিকেই তাকিয়ে আছে। আবার "সেই লোকটা"!! চারিদিক জুড়ে একটাই আলোচনা। ইতালী তো 'ওর' দ্বিতীয় বাড়ী, 'ও' কি করবে। আমাদের ক্লাস এ সব থেকে 'পাকা ছেলে' (যার একটা সিজন করা নিজের ডিউজের ব্যাট ছিল) খবর দিলো, এবার ও এখানে ভালো খেলবে না, ইতালিয়ান মাফিয়ারা, যারা ওর ক্লাবটা চালায়, তারা বলে দিয়েছে, এবার এ কোনো ম্যাচ এ ইতালী কে হারালে 'ওকে' নাকি আর ঢুকতেও দেবে না আর এখান থেকে যা টাকা পয়সা কামিয়েছে সব কেড়ে নেবে। কি মন খারাপ হয়ে গেল!! এরকম হয় নাকি! বাবা র দেখানো 'ফুটবল এর ভগবান' এর সাথে এরকম কিছু হয় নাকি!!! জিজ্ঞাসা করার মতোই বাবা কে বললাম। বাবা র কি হাসি তাই শুনে। তারপর তো ইতিহাস। সেমি-ফাইনাল এ নিজের ক্লাব এর মাঠ, নেপলস এ ইতালী কে ১-১ ড্র করার পর পেনাল্টি শুট এ 'ওই লোকটা' বলটা এমন হতছেদ্দার মতো গোল এ পাঠালো, যেন মনে হলো, অনেক হয়েছে খেলা তোদের, এবার বাইরে গিয়ে ম্যাচ দেখ!! সাথে জেঙ্গা র দীর্ঘ সময় গোল না খাবার রেকর্ড আর ক্যারিয়ার সঙ্গে বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা সব ফিস-ফাস- সব এক নিমেষে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো। আমার মতো অনেকের ই হয়তো মনে আছে বুরুচাগা র পর চার নম্বর শট নিতে এসে 'ওই লোকটা' বলটা মাটিতে বসিয়ে কোনদিক এ না তাকিয়ে শুধু হাল্কা করে ঠেলে দিল, আমার বাবা প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল, এ কি করলো!! বলা শেষ হবার আগে দেখি জেঙ্গা অন্য দিকে পড়ে আছে আর বলটা তখনও আস্তে আস্তে মাটি ছুঁয়েই গোল লাইন পার করে যাচ্ছে।। আমি যেন ফিরে পেলাম বাবা র মুখে সেই শিশু র মতো হাসি, কত কিছু বুঝিয়ে চলেছে আমায় তখনও।।
তার আগে কোয়ার্টার ফাইনাল এ যাবার ম্যাচে 'ওই লোকটা' ই শেষ করে দিয়েছে 'আমার স্বপ্নে'র টিমের এবছরের মতো বিশ্বকাপ হাতে তোলার ইচ্ছা। সারা মাঠ জুড়ে ব্রাজিল যখন কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে, আর তাফারেল যেন উড়ন্ত বাজপাখি, আর 'ওই লোকটা'র সব শট দেয়াল তুলে দিয়ে আটকাচ্ছে, ঠিক তখনই গোলশুন্য খেলা শেষ হবার ঠিক দশ মিনিট আগে, ঠিক ৮১ মিনিট এর মাথায় মাঝমাঠ এর ঠিক একটু আগে থেকে বল নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো আবার 'ওই লোকটা'। আমি খুবই নিশ্চিন্ত যে আজ আর তোমার শট তাফারেল কে ভেদ করতে পারবে না। আমার মতোই মনে হয় 'ওই লোকটা' ও ভেবেছিল। তাই তো শেষ মুহূর্তে বাঁ পা দিয়ে বলটা বাড়িয়ে দিল ক্যানইজিয়া কে। তাফারেল এর সাথে সাথে আমরাও শুধু হাঁ-করা হয়ে দেখলাম তোমার ফুটবল বুদ্ধি। পরাজিত ব্রাজিল শেষ মুহূর্তে। প্রচন্ড দুঃখ হয়েছিল। রাগে গা জ্বলে উঠেছিল। স্টেডিয়াম এর আওয়াজ টিভি দিয়ে যেটুকু আছড়ে পড়েছিল, তাকে শতগুন করে দিয়েছিল বাবা র প্রতিটা কথা। সব কথা গুলো আর উচ্ছ্বাস ছিল বাবার তোমাকে নিয়ে। ফুটবল মস্তিস্ক আর ব্যাক্তিগত স্কিল কিভাবে একটা গোটা দল কে ছিটকে দিতে পারে, দেখেছিলাম সেদিন, বুঝতে সময় লেগেছিল আরো অনেকদিন। তখন শুধু ছিল রাগ তোমার উপর। তাই তো যখন রোম এ ফাইনাল খেলতে নামলে পশ্চিম জার্মানি র বিরুদ্ধে, বিশ্বাস করো, চেয়েছিলাম যাতে তোমার দল হেরে যায়। বিশ্বাস করো, লোথার ম্যাথুজ, ক্লিন্সম্যান, রুডি ভয়লার, একটা কেও আমি কখনো কোনোদিন পছন্দ করতাম না। তাও তোমার দল হেরে যাক- সেটাই চেয়েছিলাম। ব্রেহমে, ৮৫ মিনিট এর মাথায় ফালতু একটা পেনাল্টি শট এ তোমার স্বপ্ন শেষ করে দেয়। আমি খুশী হয়েও হতে পারিনি। ম্যান মার্কিং আর অজস্র তোমার উপর ফাউল করে জার্মানি সেদিন তোমায় খেলতেই দেয় নি। জানি আমি, কিন্তু তুমি তো আর কেউ যে সে নও, তুমি যে 'ওই লোকটা'। সেদিনের সেই ফাইনাল ম্যাচ এ দেখেছিলাম আবেগহীন ১১জন রোবট দৌড়ে বেড়াচ্ছে, যার ৫ জনের অন্তত কাজ ছিল তোমায় আটকানো। সফল হলো ওরা। আমার দেখা ফুটবল মাঠে আবেগের মৃত্যু বাস্তবের কাছে।
তোমায় ভুলে যাওয়া যাবে না, এটা বুঝলাম।
তবু, তবুও আমি তোমার জন্য ব্রাজিল।।
দেখতে দেখতে এসে গেল আমার স্বপ্নের ১৯৯৪। স্কুল পেরিয়ে তখন কলেজ। চারিদিকে অনেক ব্যস্ততা আর অনেক কিছুর আনাগোনায় যখন ভুলতে বসেছি ফুটবল আর তাকে ঘিরে আমার ছোটবেলার আবেগ, ঠিক তখনই মনে পড়ে যায় 'আমার স্বপ্নে'র দল আর 'ওই লোকটা' কে। ব্রাজিল সেবার চাম্পিয়ন হবার জন্যই খেলতে নেমেছিল প্রথম ম্যাচ থেকেই। দুঙ্গা, রোমারিও, বেবেতো, কাফু, মারিও সিলভা, সের্জিও, মুলার, জেট্টি, ব্রঙ্কো, লিওনার্দো আর চমক দিতে সতেরো বছর এর রোনাল্ডো কে নিয়ে তাফারেল হাজির বিশ্বের দরবারে, সঙ্গে কার্লওস পেরেইরা, এই শতাব্দীর প্রথম আধুনিক বিশ্বকাপ এর মঞ্চ আমেরিকা তে। নেদারল্যান্ড কে কোয়ার্টার ফাইনাল এ আর সুইডেন কে সেমি ফাইনাল এ হারিয়ে যখন 'আমার স্বপ্নের' দল এগিয়ে চলেছে, তখন কোথায় তুমি!! অন্ধকার, কানা গলির চোরা স্রোত এ তুমি হারিয়ে যেতে যেতে কোনো রকম এ খেলতে এসেছো। এ কাকে দেখছি আমি। আমার বাবা র 'ভগবান' না কি তার ছায়া!!! ড্রাগ সেবন, ড্রাগ পাচার !!!! আর কি কি শুনেছিলাম। না, এবার আর আমার ক্লাস এর সেই সব থেকে 'পাকা ছেলেটার' রটানো কোনো গুজব নয়, সারা পৃথিবীর সবাই তোমার নাম এ বলছে, তোমার ভক্ত রাও তো মানতে পারছে না। তোমার রক্তের পাওয়া 'এপিড্রিন' কত শত শত মানুষের রক্ত আর কান্না কে জল করে দিল। আর আমার মতো তোমায় 'ওই লোকটা' বলা মানুষ গুলোও তো মানতে পারছিলাম না। তোমার পা থেকে ফুটবল কেড়ে নেওয়া হলো, তোমায় নির্বাসন জানানো হলো। আমি আজও ভুলি নি নাইজেরিয়ান প্লেয়ার দের তোমায় সাইড লাইন এর ধার দিয়ে বল নিয়ে যেতে যেতে বল ছেড়ে তোমার পা এ মারা, যন্ত্রনায় কাতর হয়ে পড়ে গেছ, আবার উঠে বল নিয়ে দৌড়ে যাওয়া। প্রতি পাঁচ মিনিটে তোমাকে একবার করে বল ছেড়ে ফাউল করা আর সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবার সেই চিৎকার: "এরা তো খেলতেই দেবে না!! বের করে দেওয়া উচিত এই রাস্কেল গুলোকে"!!! খারাপ লেগেছিল আমারও। তখনও তোমার নির্বাসন এর খবর শুনি নি। বিশ্বকাপ চলাকালীন বিশ্বকাপ এর সেরা বল-প্লেয়ার কে মাঠ থেকে নির্বাসন দেওয়া মনে হয় তোমাকেই প্রথম। তুমি যে সবেতেই ইতিহাস সৃষ্টি কর। তুমি ই ইতিহাস। না, এতো কিছুর পরও সেদিন বলতে পারিনি তোমায়, যাও এবার মাঠের বাইরে বসে আমাদের কাপ জেতা দেখো। তুমি না থাকলে আমাদের জেতা যে জেতা নয়।
তবু, তবুও আমি ব্রাজিল।।
ইতালি কে ফাইনাল এ হারিয়ে সেবার ব্রাজিল চতুর্থ বার এর মতো বিশ্বসেরা হলো। আমার দেখা ব্রাজিল এর প্রথম বিশ্বকাপ জয়। তার আগে তো জুলে রীমে কাপ তিনবার জিতে বাড়িতে রেখে এসেছে। নতুন করে আবার তিন এর দিকে এগুনো শুরু হলো এক ধাপ। নেদারল্যান্ড এর বিরুদ্ধে গোল করে বেবেতো র বাচ্ছা কোলে নেবার ভঙ্গিমার নাচ, (বেবেতো তো সেবার প্রথম চার টে ম্যাচ এ তিন টে গোল করেছিল), সুইডেন এর সাথে গোল করে রোমারিও র সাইড লাইন বরাবর ছুটে যাওয়া, দুঙ্গার এক ম্যাচ এ প্রথম রোনাল্ডো কে শেষ আধ ঘন্টা খেলানো- সব মিলিয়ে ব্রাজিল এক অন্য ছন্দে তখন।
(খারাপ লেগেছিল বাজ্জিও র জন্য। ফাইনাল ম্যাচ এ ব্রাজিল এর বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করার জন্য।)
এসব, এসব সবই হয় ব্রাজিল তোমার জন্য।।

Comments

Popular Posts