তবু আমি ব্রাজিল।(তৃতীয় পর্ব)

তবু আমি ব্রাজিল।(তৃতীয় পর্ব)
ঝড়ের মতো চলে এলো ১৯৯৮, ফ্রান্স। চলে গেল আমার স্কুলবেলা। কলেজ পার করে আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেবছর সব খেলা দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে না। তবুও কিছু খেলা দেখা আর কিছু খবর শুনে আর পড়ে নিয়েই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছিলাম। ব্রাজিল সেবার এসেছিলো একদিকে রোনাল্ডো, রিভাল্ডো, সাম্পাইও, রবার্তো কার্লোস এর মতো এক ঝাঁক তরুণ আর অন্যদিকে সেই বেবেতো, দুঙ্গা, তাফারেল আর কাফু র মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড় এর দিয়ে গড়া মারিও জাগলো র দল নিয়ে। প্রতিটি ম্যাচে রোনাল্ডো র গোল খিদে আর বক্সের ধার কাছে বল পেলে প্রায় একশ ভাগ তা জালে জড়িয়ে দেওয়া- ব্রাজিল আবার তুলে আনলো এক নতুন মহাতারকা। প্রতিটা ম্যাচ এ প্রায়ই কেউ না কেউ গোল করে চলেছিল। রোনাল্ডো র সাথে বেবেতো, সাম্পাইও, রিভাল্ডো- সকলেরই খাতা খুলেছিল। কিন্তু তারপর আবার সেই খেই হারিয়ে যাওয়া। জিদান আর অঁরি ফাইনাল এ ছন্নছাড়া করে দিল। যত কম মনে করি সেদিন, ততই ভালো- না, আমি এরকম করে ভাবি না। আমার মনে হয় ব্রাজিল ও এরকম ভাবে না। সেদিন জিদান ছিল অতিমানব আর অঁরি র প্রতিটা পাস ছিল নিখুঁত। আমি মনে রাখি ব্রাজিল এর প্রতিটা হার - প্রতিটা জেতার থেকেও বেশী করে। না, হলো না বিশ্বকাপ এবার। অনেক নতুন সম্ভাবনা, অনেক নতুন প্রতিভা র খোঁজ দিয়ে ব্রাজিল বিদায় হলো সে বার এর মতো।
কিন্তু, কোথায় তোমার দল? ইন্দ্রপতন তো হয়েই গেছে আগের বার। চার বছর অতিক্রান্ত। এ কাদের পাঠালো তোমার দেশ! ভেরন, ওর্তেগা, বাতিস্তুতা কে দিয়ে বিশ্বকাপ জেতা যায় না, সেটা তুমিও বুঝেছিল তাই তো মিডিয়া তে অনেক খারাপ কথা ও বলেছিলে এই টীম নিয়ে। যদিও মিডিয়া বরাবর ই তোমার উক্তি নিয়ে বাজার মাত করে। কারন এই তুমি পেলে কে গালাগাল করো আবার পরের বছর তোমার দেশের প্রেসিডেন্ট কে। কিন্তু এসবের পরও তুমি যখন ওর্তেগা র কথা আলাদা করে বললে, তখন তাকিয়ে থাকলাম। কোথায় কি, এরা তো সবাই তোমার ছায়ার থেকে শত হাত দূরে। না, সত্যিই তুমি ছাড়া আজও তোমার দেশের ফুটবল অনাথ হয়ে আছে।
তাই, তাই তুমি চাও আর না চাও, আমি ব্রাজিল।।
সাল ২০০২। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া। আমারও পড়াশোনা শেষ হয়েই গেছে, কলেজে এ আংশিক সময় এর শিক্ষকতা আর অফুরন্ত আড্ডা দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। বছরের প্রথম থেকে কোয়ালিফাইং ম্যাচ গুলোর খবর রাখতে শুরু করতাম সাধারণ ভাবে। তোমার টীম নক আউট পর্যায়ে যাবার আগেই বাদ!!! শকড৻ , বললে খুব কম বলা হয়ে যাবে। কি রকম একটা মনে হচ্ছিলো!!! তোমার টীম এতো তাড়াতাড়ি বাদ এ বিশ্বকাপ, জানি আগেও তোমরা বাদ গেছো মূল পর্ব থেকে। কিন্তু তখন তো তুমি খেলতে না। কিন্তু বিশ্ব যখন তোমার খেলা একবার দেখেছে, আর পিছিয়ে তাকায় নি, সেখানে তোমার দেশ এ কি করলো!!! তুমি আবার স্বমহিমায় ফিরে এলে মিডিয়ার কাছে। উগরে দিলে তোমার সব রাগ। গালাগাল টুকু ও বাদ রাখো নি মনে হয়, কাওকে ছাড়ো নি মনে হয় দেশের, কোনো চেয়ার কেও রেয়াত করো নি!!! এর সাথে সাথেই বুঝতে লাগলাম, তুমি আবার ফিরে আসবে, যে কোনো ভাবে, যে কোনো কিছুতে!!!
যাই হোক, এবছর তুমি বাদ। আমরা শুধু আমাদের খেলায় মন দি।
মার্কোস, কাফু, লুসিও, জুনিয়র, এডমিলসন, রোনাল্ডো, দের নিয়ে এসেছে এবার অভিজ্ঞ রবার্তো কার্লোস আর রিভাল্ডো, সাথে তুরুপের তাস এর মতো লুকিয়ে এনেছে দুই নক্ষত্র বাইশ বছরের রোনাল্ডিনহ আর সতেরো বছরের জুনিনহো কে। ঠিক যেমন করে সতেরো বছরের রোনাল্ডো কে আগের বার খেলিয়ে ঠিক করে দিয়েছিল তার তিনকাঠি তে বল পাঠানোর নির্ভুল নিশানা এবার ও কি সেরকম কিছু দেখাবে সবার মাথা বুড়ো স্কোলারি!!
"দুটো গোল"। শুধু মাত্র দুটো গোল, আমার এই ২০০২ এর বিশ্বকাপ দেখা সার্থক করে দিয়েছিল। কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। বিপক্ষে ইংল্যান্ড। প্রথম হাফেই মাইকেল আওয়েন ব্রাজিল কে একটা গোল দিয়ে দিয়েছে। আমি আর তন্ময়, রঘু র ঘরে খেলা দেখতে গেছি, রঘু র চাকরী পেয়ে নতুন কেনা টিভি তে। রঘু তখন ছিল ইংল্যান্ড এর সাপোর্টার। আমরা একটু চুপ চাপ ই বসে আছি। সেদিন আবার ব্রাজিল খেলছিল সেকেন্ড জার্সি, নীল পড়ে। বারবারই মনে হচ্ছে, ধুর, আজই হলুদ জার্সি নেই! কত কিছুই মাথায় যে আসছে! হাফ টাইম হবার কয়েক মিনিট আগে, সেন্টার লাইন এর একটু পিছন থেকে জুনিয়র একটা ট্রাকলে বলটা পাস বাড়ালো, কোনো রকম এ বলটা ধরে নিল কোঁকড়া চুলের দাঁত উঁচু ছেলেটা। সেই সেন্টার লাইন থেকে দুটো পা আর বল পাশাপাশি দৌড়াচ্ছে, টাচ করেছে মাত্র তিন কি চার বার, আর পাশের ইংল্যান্ড এর প্লেয়ার রা ওর ড্রিবলে বল এর গতিপথ বুঝতে না পেরে যখন গোল লাইন এর কাছে প্রায় পাঁচ- ছয় জনা ঘিরে ফেলেছে, ঠিক তখনই উলটো দিকে দৌড়ে আসা রিভাল্ডো কে পাস করে দেয় বল, যা হাসতে হাসতে রিভাল্ডো পাঠায় গোল এ। হাঁফ ছাড়লো, কি হলো, কি ভাবে বলটা এতো দ্রুত সেন্টার লাইন থেকে গোল লাইন এ এলো মাটি কামড়েই, সেই বিশ্লেষণ করার আগেই বুঝলাম, ব্রাজিল এনেছে এবার পৃথিবীর এক অন্যতম বলপ্লেয়ার রোনাল্ডিনহ কে। বল যার পা অনুসরণ করে ছুটে চলে, হাওয়া নয় মাটি কামড়ে, আর আমরা দেখি বল আর পা পাশাপাশি ছুটছে, কখনো পা আগে বল পিছনে আর কখনো বা উল্টো। আমার মতো অনেকেই রোনাল্ডিনহ র বল ড্রিবলের ভিডিও ইউটিউবে বহুবার দেখে থাকবে, আর বারবার অবাস্তব কে বাস্তবে নামিয়ে আনা নিয়ে সন্ধেহ প্রকাশ করবে। গোল করেই রিভাল্ডো সাইড লাইন এ ছুটে গিয়ে নীল জার্সি খুলে ফেললো, ভেতরে পড়ে আছে সেই হলুদ জার্সি। অনেক আগেই তৈরী হয়েই এসেছিল। সময়ের অপেক্ষায় ছিল। গোল টা করেছিল রিভাল্ডো আর বিশ্ব চিনেছিলো 'কোঁকড়া চুলের দাঁত উঁচু' ছেলেটাকে। হাফ টাইম শেষ হবার চার মিনিট হয়েছে, নিরীহ এক ফাউল এ ফ্রিকিক শট। একটু পাস থেকে ছুটে এলো সেই আবার ১১ নং। একহাতে বলটা নিয়ে সামনে ছুড়ে দিয়ে বসালো। সেন্টার লাইন এর ঠিক আসে পাশেই। পাশ আর এট্যাক এ তৈরি ব্রাজিল দল। সামনে ইংল্যান্ড ওয়াল প্রথম বার পোস্ট এর দিক ঘেঁষে, আর গোলকিপার সিম্যান সেকেন্ড বার পোস্ট এর কোনার দিকে। বলটা হাওয়ায় তুলে শুধু টার্ন করলো, সেই সেকেন্ড বার পোস্ট এর ধার দিয়েই সিম্যান এর মাথার উপর দিয়ে জালে জড়িয়ে গেল। আমি বেকহ্যাম এর প্রায় সমস্ত ফ্রিকিক গুলো দেখেও বলছি, অনেক দিন এরকম ফ্রিকিক দেখিনি। রবার্তো কার্লোস এর মারা শট টা মনে রেখেই বলছি। সেটা তো তাও বার পোস্ট ছুঁয়েছিল, আর এবার বল টা যেন ওই ঠিকানা নিয়েই ছুটে গিয়েছিল।
শুধু এই ম্যাচ টাই ওই ১১ নং কে চিনিয়ে দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বকাপ খেলার চাপ আর ক্রমাগত ইংল্যান্ড এর বিরক্তিকর ট্রাকলে অতিষ্ট হয়ে যখন ঘুরে দাঁড়ালো, ঠিক তখনই লাল কার্ড। পরের ম্যাচ এর জন্য বসে যাওয়া। চিন্তা নেই ব্রাজিল এর। সেমিফাইনাল এ তুর্কি। গ্রুপ ম্যাচ এ হারিয়ে আসা তুর্কি র জন্য একা রোনাল্ডো ই যথেষ্ট। একগোল দিয়ে নিজের গোল সংখ্যা বাড়িয়ে ব্রাজিল উঠলো ফাইনাল এ, সামনে জার্মানি। আবার সেই রোনাল্ডো। আবার দুটি গোল। ব্রাজিল পঞ্চম বার এর জন্য বিশ্বকাপ হাতে নিল।
লেখার খুব দরকার না থাকলেও আমার জানি এই বিশ্বকাপ এ রোনাল্ডো ৮ গোল দিয়েছিল, প্রতিটা গোল ই ছিল দশ পার্সেন্ট সুযোগ কে একশ পার্সেন্ট এ বদলে দেওয়া। জানি, এই জন্য ই ও রোনাল্ডো। এবারই কিন্তু ৫ গোল দিয়েছিল রিভাল্ডো, ২ গোল দিয়েছিল রোনাল্ডিনহ আর ১টা করে গোল দিয়েছিল জুনিয়র, রবার্তো কার্লোস আর এডমিলসন। গোটা দল খেলেছিল। এটাই ব্রাজিলিয়ান ফুটবল আর এটাই টোটাল ফুটবল।
আমার আক্ষেপ তো 'ওই লোকটা'র জন্য। তোমার টীম কেন এরকম নয়। তোমার কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে দুটো বিশ্বকাপ পার করেছে, আর আজও তোমার মতোই কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আজ ওর্তেগা, কাল....।।
তাই, তাই আমি ব্রাজিল।।
সেদিন ও আমি ব্রাজিল, আজও ব্রাজিল।।


Comments

Popular Posts