আমার না-চেনা সহনাগরিককে খোলা চিঠি!!

আমার না-চেনা সহনাগরিককে খোলা চিঠি!!

মাছমাস্টার: চলে গেলেন স্রষ্ঠা! ফেলে গেলেন সময়ের দলিল।
শ্রদ্ধেয়,
সহ-নাগরিক, শিশুরোগ চিকিৎসক, পৌরপিতা-প্রশাসক!
না। আপনার সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত পরিচয় নেই।
না। আমার পরিচয় ছিল না কোনদিনই আমার বন্ধুর বাবার সাথে।
না। ব্যক্তি পরিচিতি না থাকা আমায় এতটুকু ভাবায় না কারণ আপনাকে চিনেছি আপনার নামে ছড়িয়ে থাকা গল্পে আর আপনার উপন্যাসের চরিত্রায়নের মাঝে। সেই সাহসের ভরে আপনাকে চিঠি লিখতে বসেছি।
আমরা যারা আশির দশকের শেষের দিকে সমাজ আর রাজনৈতিক জীবন-যাপনে একটু করে পা বাড়িয়ে নিজেকে সচেতন করে তুলেছিলাম, তাদের অনেকের কাছেই ষাটের দশকের শেষ থেকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ছিল গল্পে শোনা এক চির রোমান্টিকতায় ভরা কোন সে সূদুর এক দেশের গল্প- শেষ হয়েও যেন শেষ না হতে চাওয়ার গল্প। স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখার সাহস আর তাকেই জীবন মেনে শতাব্দী প্রাচীন সংস্কারের মাথায় পা দিয়ে শিবের নাচ দেখাবার সাহস দেখিয়েছিল যে একটা গোটা প্রজন্ম, যাদের সাথে নিয়েই আপনি বলেছিলেন,
"লেনিনের যুক্তিতে এমন একটা শীলমােহর মারা থাকে
যে সেটাকে কাটা যায় না। আর একটা কথা, আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয়, আমাদের সকলেরই আরাে পড়াশুনা করা দরকার।"
বড়োই অভাব আজও আমাদের সামাজিক জীবনে এই পড়াশোনার। সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনৈতিক জীবনেও ছিল এই অভাব। না। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যুক্তি-মত যে গ্রামের সরল পড়াশোনা না জানা মানুষের মনের ভাষা হতে পারে না সেটুক বোঝার অবস্থায় ছিল না পরিচালন সমিতি। ছিল না সেই ক্ষিদে, যা তাকে দাঁড় করায় এই প্রান্তিক মানুষের সাথে। সুখী গৃহকোন, উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম দশে থাকা রেজাল্ট, বিখ্যাত মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির চাকরির চিঠি ছিঁড়ে ফেলে ঘর ছেড়েছিল যারা, তাদের আবেগের ধর্ষণ হয়েছে প্রতিনিয়ত।
আপনার নীল তো প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলে নিজের সাথে। যে জোতদার-জমিদারদের হাত থেকে গ্রাম বাঁচাতে ছুটে এসেছিল, তারা তো তখনও জানতো না, ক্ষমতার হস্তান্তরের পরের অবস্থা। ক্ষুদে বাবুর হাত থেকে হামিদ মাস্টারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর কি এই প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষদের বাঁচাতে পারবে!
পড়াশোনা না জানা মাছমাস্টারের প্রশ্নের উত্তর তো নীলের কাছেও নেই। সেদিনও ছিল না আর আজও নেই।
"একুন আবার অন্য লোতুন দেশের কতা। চিনা দেশ। সেকানে গাঁয়ের গরিবরা বিপ্-লব করে ফেলাইচে। একুন সেকানে সত্যিকেরের গরিবের আজত্ব। আর সেই চিনা দেশের এক লম্বর লেতা নিকি সাঁ গিন নোক। তেনাকেই একানকার লেতা মানতে হবেক। ক্যানে?"
এই 'ক্যানে' র উত্তর তো কলেজ শিক্ষিত সুজাতার কাছেও নেই।
"আপনাদের কাগজপত্রেও সর্বত্র লেখা, শ্রদ্ধেয় নেতা। ওটা না লিখলে, না বললে কি শ্রদ্ধা কমে যায় ? এটা তাে প্রায় গুরুবাদ।"
প্রতিটা প্রশ্ন ভাবায় নীলকে। স্তব্ধ করে দেয় তাকে। সমাজের দুই পৃথক মেরুর দুই বাসিন্দার দুই প্রশ্নই যে তাকেও তাড়িয়ে বেড়ায়।
"আপনার মতাে মধ্যবিত্ত, শহুরে চেহারার ছেলেরা কৃষক-ক্ষেতমজুরদের সাথে একাত্ম না হয় হল, কিন্তু মিশে যাবে কি করে? গ্রামে কুকুরগুলােও রাত্রে বাইরের তােক দেখলে ঘেউঘেউ করে।"
সেদিনের কুকুর বশ করার অনেক গল্পই আমরা শুনেছি। পুলিশ আসার আগে কুকুরের চিৎকার আপনাকে ধরিয়ে দেবার আগেই কিন্তু শাঁখ বাজাতো যে বিধবা পিসি সে কিন্তু হেলায় পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে যেত। কেন? এর উত্তর কখনো আপনারা খোঁজেন নি।
ওরা জানতো যে আপনি জানেন না বিপদে পড়লে আত্মরক্ষা করবেন
কি দিয়ে! আপনি জানেন, দা আর রামদা’র তফাৎ!আপনি তেঁটা দিয়ে সাপ মারেন নি কোনদিন!
অস্ত্র ব্যবহারের প্রশ্নে, একবার রাইফেল ছিনতাইয়ের আহ্বান, আবার পরক্ষণেই নির্দেশ, গ্রামে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার নিষেধ।
"আপনি নিজেকে কি কলম দিয়ে বাঁচাবেন?"
ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে নীল। যে দেশের গল্প শুনিয়ে বিপ্লবের ডাক দেয় তার উপরতলার নেতারা, সেই দেশের 'জামা-প্যান্ট পরা চাষীর' গল্প আর তার মোহ 'এক টাকা মুজুরি থেকে সাড়ে চার টাকার মজুরির স্বপ্নে শেষ হয়ে যায় উত্তম বাউরিদের। কত টাকা মজুরি হলে তাদের সবার ক্ষিদে মিটবে! আর তারপরের জিজ্ঞাসা সেই শ্রমজীবী মানুষের সারাজীবনের:
-হ্যাঁ রা পল্টুনে, চিনাদেশে পুলিস নাই!
যে পুলিশ জমিদারবাবুর কথায় তার বাবাকে মেরে ফেলে দিয়ে যায় সেই পুলিশে সুবলবাবুর আস্থার কথা শুনে মাছমাস্টার অবাক হয়ে যায়। গ্রাম দখলের এই রাজনীতিতে লাল আর অতি-লালের কথায় সব কেমন গুলিয়ে যায় এই মানুষগুলোর। এক বিষন্নতার টানাজাল ঘিরে ধরে।
ফিরে যাই রাঢ় বাংলার টিয়াগাঁয়ে যেখানে নেউল সারা গাঁয়ের সব পুকুরের মাছ চিনেছে সেই ছোটবেলা থেকে। সুষনি, কলমি, বনফুল চেনার মতোই সে মাছ চেনে আর এই মাছ ধরে বেড়ানোই তার একমাত্র পেশা। একটাও বড় মাছ কোনদিন সে না ধরে শুধু পেট চালানোর মাছ ধরে বেঁচে থাকা মেছো-নেউল যখন বড় মাছ ধরতে চায় তখন বিশ্বাস বাড়ির বুড়ো কত্তা শুধু অবাক হয়ে যায় উত্তর শুনে।
- আজ্ঞে বিটিটোকে নেকাপড়া শেকাব।
বাউরি পাড়ার নেউল, যার চোদ্দ পুরুষ কোনদিন লেখাপড়া শেখে নি, যে নিজেও 'নেকাপড়া' শব্দটুকুই শুধু জানে, সে যখন তার মেয়েকে স্কুলে পড়াতে চায় তখন কি আর আলাদা করে বিপ্লবের ডাক দেবার দরকার থাকে! শুধু এইটুকু বুঝে ছিল নীল, তাই তো সে গ্রামের রিটায়ার করা প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারমশায়ের কথায় নিজেকে খুঁজে পায়,
"পুরনাে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির ছাদের তলাতেই ধনতান্ত্রিক সংস্কৃতির শিক্ষানবিশী। অ, আ থেকে এরিথমেটিক, সবই তাে পুরনাে সংস্কৃতিরই অঙ্গ। ক্ষমতা পাওয়ার পরেও, সার্বজনীন সাক্ষরতার অর্থাৎ সংস্কৃতির
A B C শুরু করতে বলশেভিক সরকারের ছ’বছর লেগেছিল। ইসকুল, কলেজগুলাে পুড়িয়ে ফেললে তাে বারাে বছর লেগে যেত। ধনতান্ত্রিক সংস্কৃতির Fundamental element গুলিকে আত্মস্থ করেই Pro-letarian Culture গড়ে তােলা সম্ভব। মতটা আমার নয়, লেনিনের।
কোটি কোটি মানুষ চোদ্দ পুরুষে প্রথম লিখতে-পড়তে শিখবে, অঙ্ক শিখবে এটাই তাে বিরাট ব্যাপার। কিন্তু এই বিশাল Quantity এমনি-এমনি Quality তে রূপান্তরিতহয় না। তারজন্য একটা ভিত দরকার। ইসকুল, কলেজগুলাে সেই ভিত।"
নীল জানে তার পথ চলায় অনেক প্রশ্ন। এই গ্রামীণ মানুষের সব প্রশ্ন আজ তার প্রশ্ন,
- সত্তরের দশক কি মুক্তির দশক হবে?
- না। মুক্তি অত সস্তা নয়।
- কেন, আমাদের প্রধান ভুলটা কি?
- নীলভাই প্রবল সদিচ্ছা ও ষোলআনা আন্তরিকতা নিয়ে যদি দখিনমুখো দৌড়াই, হিমালয় পৌঁছাতে পারব কি? অবশ্য কেউ যদি বলে পৃথিবীটা গোল বলে একদিন না একদিন...
মুক্তি কোথায়? কোন মুক্তির লড়াই সে চালিয়ে যাচ্ছে? শুধু শ্রেণীশত্রু খতম নতুন দেশের সন্ধান দেয়না। মুক্তির স্বাদ তো ওই মাছমাস্টারের কাছে, যেখানে বাড়ির দাওয়ায় সকালে সনকা পড়তে বসেছে আর নেউল তার পাশেই,
"ঐ-ক্য, বা-ক্য, মা-ণি-ক্য ... টেনে টেনে বলতে বলতে লেখে
সন্ কা। অল্প অল্প দোলে। পাশটিতে সটান বসে থাকা নেউল দ্বিগুণ দোলে। তার হৃদয় দোলে দশগুণ।"
চোদ্দপুরুষে অনাস্বাদিত এই আকাঙক্ষার স্বাদই আলাদা। এই বাউরি পাড়ার মেয়ে সনকার স্কুলে ভর্তির জন্যই তো নীল হেডমাস্টারের মুখোমুখি হয়েছিল, হাতে অস্ত্র তুলে ভয়ও দেখিয়েছিল। সমাজে মুক্তির পথ যে ক্ষুদে বাবুকে খুন নয় তা সে মর্মে মর্মে জেনেছিল তার জীবনদিয়ে।
"ধান কাটতে, গাছ কাটতে অভ্যস্ত মানুষগুলি মিটিঙে যাই বলুক, গলা কাটার সময় তাদের হাত উঠতেই চায় না। শহরের শিক্ষিত ছেলেগুলিই হাতিয়ার চালায় আর গ্রামীণ শ্রমজীবীর হাত কোনমতে রক্তের দাগ লাগিয়ে নেয়।"
এই অস্থির সময়ের মাঝেই আপনি নিয়ে গেছেন আমাদের সেই মাছমাস্টারের জীবনে, যার কিছুই ভালো লাগে না। মাছ মারলেও ভালো লাগে না আবার কেউ প্রশংসা করলেও ভালো লাগে না। যে এক অদ্ভুত সময় তার কাছে। কঠিন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রান্তিক মানুষের বোধ যতবার আমাদের ধাক্কা দেয়, ততবারই আপনাকে ক্ষত বিক্ষত করেছিল সেই সময়,
"ই উকে খাচ্চে, সি তাকে খাচ্চে। চান্দিকে, সব সুময় খালি খুন আর খুনের তােড়জুড়। আর নােলা।
তেবু বােজা যায়। যার যতটুন খিদে, ততটুন নােলা। কিন্তুক মানুষের নােলা অন্যরকুম। সব কিচুন অন্যরকুম। মানুষ এমুন পারা ক্যানে? আর সেই ক্যানেগুনােই বা তেমুন ক্যানে ?"
মাছমাস্টার পুকুর পাড়ে মৃত্যুর সাথে কোলাকুলি করে তার আজানু ভালোবাসা দিয়ে,
"জমানাে বেদনার উথলে ওঠা বিষাদ, ঠাণ্ডা হাওয়ার দমক আর হুহু করে বাড়তে থাকা জ্বরের ফাদিজালে তার শরীর কুঁকড়ে যায়, শ্বাস রােধ হয়ে আসে। হাতের বেড় দিয়ে গুটিয়ে আনা হাড্ডিসার দু’হাঁটুর হাড়িকাঠে মাথা গুঁজে দেয় মাছমাস্টার।
ঝড়ের ঝাপটানি বেড়ে যায়। বেড়ে বেড়ে যায়। বৃষ্টির মতাে পাতা ঝরে। নিম, আমড়া, বাঁশ, বেল, শিরিষ, অশথের ঝরা-মরা পাতায় ঢেকে যেতে থাকে মাছমাস্টারের খিন্ন, নিথর শরীর—যেন মানুষ নয়, শুকনাে এক পর্ণনর।"
আর নীল? নীল হারিয়ে যায়?
আজ যে নীলদের খুব দরকার। আগামী প্রজন্মকে এই অস্থির সময়টা পার করে দিতে নীলকে যে খুঁজে বের করা দরকার। একজনও যদি এই প্রথাগত শিক্ষাঙ্গনের বাইরে থাকে, একজনও প্রান্তিক, শ্রমজীবী মানুষ যদি আজও শিক্ষার আলোর বাইরে থাকে তাহলে যে নীলদের আবার ফিরে আসতেই হবে।
আর আপনি কি করবেন?
মৃত্যু তো মানুষকে আকাশের তারা করে দেয়। কোন আকাশ? কোথায় থাকে সেই তারা? এ এক অন্য আকাশ অন্য তারার গল্প শুনিয়েছিলেন আপনি। যে আকাশে মানুষ যুগ পেরিয়েও থেকে যায়।
- এতটুকু ছেলে পগাও বলেছিল, অজু ডাক্তার থাকলে, তার বাবাও নাকি ভালো হয়ে যেত।
- অজু ডাক্তার থাকলে হয়তো তুর মা-টো..
সেই আকাশ থেকে মহাকাশ জুড়েই না হয় থাকুন আপনি। কিন্তু বারে বারে নীলদের ফিরিয়ে দেবেন যেন আমাদের এই ধুলো-মাটি-কাদার গ্রামে যেখানে ধম্মবটের তলায় সন্ধ্যা নামলে ভোলাকাকা, নেউল, ছকু দোকানী, বিমলে, পল্টন, পবনা-কালো, পঞ্চুকালো, নেড়া, ছোট বাউরি আরো অনেক খালি-গা এসে জড়ো হয়, ধানতোলা আর চাষের গল্প হয়, স্কুলের নতুন মাস্টারের গল্প হয়, মাছমারার গল্প হয়, মনসা পুজোর শুয়োর মারার গল্প হয়, গাজনে-চড়কে শিক গাঁথার গল্প হয়- গল্প হয় বেঁচে থাকার, জীবনের, জীবন বোধের। কথা দিন, ওই 'কলকাতার লেতা'দের নয়, শুধু নীলদের ফিরিয়ে দেবেন।
ভালো থাকবেন ডাক্তারবাবু, মানুষের আকাশে তারাদের মাঝে!
ইতি,
না-চেনা সহ-নাগরিক!
বর্ধমান ১২ই জুন,২০২১



Comments

Popular Posts