খেয়ে-বেড়ানো! (৪): মার্গারেট'স ডেক: এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে!!

 খেয়ে-বেড়ানো! (৪)

মার্গারেট'স ডেক: এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে!!

- বাবাই, তুমি কিন্তু আমার সাথে বহুত না-ইনসাফি করলে!
- সে আবার কি রে!
নতুন বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি একদিন সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যখন নামলাম, চারিদিকে কুয়াশা আর মেঘে ঢেকে গেছে। খিদেও পেয়েছে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠেই সোজা চলে এলাম রোহিনীর কাছে এক ছোট্ট পাহাড়ি ধাবায়। খিদে আর ঠান্ডা এমন ছিল যে টেবিলে মোমো আর ম্যাগির প্লেট আসার সাথে সাথেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বেশ কিছু অর্ডার করে এবং গোগ্রাসে গিলে ক্লান্ত আমরা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এসে গাড়িতে বসলাম। গন্তব্য দার্জিলিং। একসাথে চলেছি আমার আর ভাই-বন্ধুর পরিবার, সংখ্যায় পাঁচ আর হাফ-জন, যার দুজন হল শুধুই মাংসে বেঁচে থাকা মানুষ। আমার ছেলে আর ভাইপো দুজনেই পারলে সকালে উঠে থেকে রাত্রি পর্যন্ত রোজ মাংস পেলে আর কিছু লাগে না। যাই হোক, মেঘ আর কুয়াশা কেটে গাড়ি উঠে চলেছে, গাড়িতে প্রায় সবাই আধো ঘুমে। জেগে আছি আমি আর কবি। দার্জিলিং পৌঁছাতে আরো অনেকক্ষন সময় লাগলেও আমরা জানি যে আমাদের এখন গন্তব্য দার্জিলিং নয়। ঘন্টাখানেক বাদেই পৌছালাম সেখানে। ঠান্ডায় কেউই প্রায় নামতে চাইছে না। আর রাস্তার পাশে ঘেরা একটা বিষণ্ণ চেহারার বাড়ি দেখে কেউই বুঝতে চাইছে না, এখানে নেমে কি হবে! বেশ চেষ্টা করে সবাইকে নামিয়ে ভেতরে ঢুকে চায়ের কাউন্টার আর কিছু চায়ের ছবি আর কৌটো দেখে সবাই ভাবছে যে এখানে তাহলে চা কিনে আবার যাত্রা শুরু হবে। তখনও আমাদের উদ্দেশ্য ওরা বুঝতে পারে নি। তারপর পাশের বারান্দা দিয়ে একটু এগিয়ে আসতেই সবাই বুঝে গেল আমরা কোথায় এসেছি আর কেনই বা এসেছি। আমরা এসে পৌঁছেছি মার্গারেট'স ডেক, কার্শিয়াং। এতবার দার্জিলিং এলেও আমরা একবারও এখানে আসিনি। এবারের বেড়ানো ছিল আমাদের যেহেতু শুধুই বসে থাকা আর খাওয়া তাই বাতাসিয়া লুপ বেড়ানো বাদ দিলেও এই জায়গাটা বাদ দেওয়া ঠিক মনে হয় নি। বাইরের ডেকে একমিনিটও দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না এতো ঠান্ডা আর মেঘের আনাগোনা। তাই ভিতরের টি-লাউঞ্জে ঢুকে পড়লাম। চারদিকে কাঁচ দিয়ে ঘেরা এই টি-লাউঞ্জে র ইলেকট্রিক হিটারে শরীর গরম হওয়ার সাথে সাথে চারিদিকে মেঘেদের ঘিরে ধরা আর আসা-যাওয়া দেখতে দেখতেই সময় চলে যায়। আমার আর বন্ধুর উদ্দেশ্য একটু ভালো চা একটু সময় নিয়ে পান করা আর এই শীতকালে বৃষ্টি মাখা দার্জিলিং দেখা। পুরোনো এল পি রেকর্ড এ মেনু কার্ডটা একটু চোখ বুলিয়ে নিয়েই আমার ছেলের প্রথম উক্তি,
- বাবাই, তুমি কিন্তু আমার সাথে বহুত না-ইনসাফি করলে!!
- কেন রে! কি হলো?
- তুমি জানতে আমরা এখানে আসবো?
- জানতাম তো, সেই রকমই প্ল্যান করেছিলাম।
- তাহলে তুমি বলোনি কেন? এবার আমি এখানে কি খাবো?
- কেন? আমরা চা আর কুকিজ নেব। তোর আর ভায়ের যা মন বল।
- ধুর! আর হয়?
- কেন রে? কি হয় না?
- এই তো এতো খেয়ে এলাম। আর কতো খাবো! আচ্ছা, দেখি।
না, না! খাবোনা শুনে খুশি হবার কিছু নেই। আমাদের পছন্দের ক্যাসলটন মাস্কাটেল ডাবল পট চা আর কটা পিনাট বাটার কুকিজ নিয়ে বসলেও ছেলে খুঁটিয়ে মেনু কার্ড দেখতে শুরু করলো। এদের ডাবল পটের বৈশিষ্ট্য যে চেষ্টা করলে চারজনের ভালো ভাবেই খাওয়া যায়। আর এরা কিচেন থেকে চা বানিয়ে টেবিলে আনে না, সময় হলে টেবিলে এসে চা বানিয়ে দেয়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত পর্ক সসেজ আর চকলেট ব্রাউনি ওর এখানে পছন্দসই মনে হল। এতো অল্পে থেমে যাবে ভেবেই তো এখানে দ্বিতীয় স্টপেজ দেওয়া, প্রথম নয়। বাবার এটুকু চালাকি কি আর ও বুঝেছে! অর্ডার শেষ হলেই একবার করে বাইরের ডেকে ঘুরে আসা, চোখে মুখে মেঘ মেখে হাড় কাঁপানো ঠান্ডার সাথে ছদ্ম যুদ্ধ করে, ছবি তুলে আবার ভিতরে এসে নরম গরম সোফায় গা এলিয়ে দেওয়া- সময় কেমন মৃদু ছন্দে বয়ে চলেছে। প্রতিটা খাবারই ছিল গুনগত ভাবে বিশেষ ধরনের। আর চা- শুধু যে জন্যই যাওয়া, যার কথা না বললে চলে না, তা হলো তার সেই হালকা সোনালী রং এর মুখে দেওয়ার সাথে গোটা মুখ আর জিভে ছড়িয়ে যাওয়া এক নতুন স্বাদ, এক অন্য রকমের মানসিক আনন্দ দেয়।
শুধু চা খাবার জন্যই আবার পরের বার এখানে আসতে হবে। আর ছেলেতো বলেছে যে স্টেশনে নেমেই প্রথম থামা যেন এখানেই হয়। অনেক কিছুই বাকি থেকে গেল ট্রাই করার জন্য।
গুডরিক কোম্পানির এই টি এস্টেট আর টি লাউঞ্জের জন্ম ব্রিটিশ আমলের আর মার্গারেট এর গল্প তো সবাই জানে। পুরোনো অতিহ্য আর আধুনিক সুবিধা যুক্ত এই টি লাউঞ্জে ব্রাঞ্চ সহযোগে মেঘেদের কেরামতি দেখতে দেখতে একবেলা কাটিয়ে দেওয়া বেশ আরামের। দেখা যাক, পরের বার আবার কবে আসা যায়! অনেকরকম চায়ের স্বাদ নেওয়া যে বাকি থেকে গেল। সর্বোচ্চ ঠান্ডায় এই ডেকে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে আমার মনে হয়েছে পরের বার মেঘ ভেঙে চরম বৃষ্টির সময় একবেলা কাটানোর কথা।
লোকের ছেলে-মেয়েরা আজ বাবা দিবসে ছবি দিয়ে বাবাকে নিয়ে কত কিছুই না বলছে, আর আমার ছেলে সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠে চা খেতে খেতে আমায় আজ মনে করিয়ে দিল যে আমি ওর সাথে কি ভয়ানক না-ইনসাফি করেছিলাম!
.
.
.
(১৫ই জানুয়ারি,২০২১)







Comments

Popular Posts