নন সেন্স কথামালা (১৩): ফুচকা! আরে, সে এক মহা ইয়ে!

ফুচকা নিয়ে আমায় বেশী কিছু শেখাতে এসো না! সে কবে তিরাশি সালে ক্লাস থ্রিতে পড়বার সময় পুরী বেড়াতে গিয়ে বাবা কে বলেছিলাম, 'আমি কিন্তু এক প্লেট ফুচকা খাবো!' বাকি লোকজন এমন হেসে উঠেছিল, ভাবছি আজ তাদের দেখতে পেলে বলতাম, 'কি হে! স্পেশ্যাল ফুচকা তো আজকাল প্লেটেই বিক্রি হয়!' তোমরাই আমাকে ঠিক বুঝতে পারো নি! সেই কবে আমি আজকের ফুচকার এই রূপান্তর দেখতে পেয়েছিলাম।

গ্রামের ছেলে শহরে এসে প্রথম ভালো করে ফুচকা আর ফুচকাওয়ালা দেখলাম পঁচাশি সালে শহরের স্কুলে পড়তে এসে। বছর দুয়েক আগে পুরী গিয়ে খেলেও জিনিসটাকে ঠিক বুঝতে পারি নি। তখন বাড়ি থেকে পাওয়া একটাকায় মাঝে মাঝেই নিজেকে রাজা মনে করতাম। এরম একদিনে দুই বন্ধু মিলে মনের সুখে বি. সি. রোডে সি. এম. এস স্কুলের সামনে ফুচকা খেলাম। সেবারেও কিন্তু সবটা উদ্ধার করতে পারি নি। মানে কিছুতেই বুঝতে পারি নি যে আলু-মাখা টা কি করে এতো তাড়াতাড়ি ওর ভিতরে ঢোকাচ্ছে না আলু-মাখা সমেতই ফুচকা তৈরি হয়! আসলে ফুচকার ঝুড়ি আর ডালা একটু উঁচুতে থাকতো সেই সময় আমার থেকে। যাই হোক পরে আর একটু বড় হয়ে, মানে আর একটু লম্বা হয়ে ডালার উপরে সবকিছু দেখে বুঝেছিলাম, ও!এই ব্যাপার!
যাক, স্কুলের দিনগুলো খুব বেশি ফুচকা না খেলেও মাঝে মাঝে বন্ধুদের পাল্লায় খেতাম। তখন কিন্তু খুব একটা ভালোবাসতাম, এরম নয় কিন্তু! পরের দিকে মানে ওই কলেজের সময় একটু একটু মন লাগলো ওই ফুচকার দিকে। বলা চলে, এই সময়েই আমি ফুচকা খোর হয়ে উঠলাম আমার এক বান্ধবীর দৌলতে। শিখলাম অনেক কিছুই। জানলাম ফুচকার জগত। কি শৈল্পিক ভাবনায় এবং শ্রমে এই ফুচকা তৈরি করে আমাদের মুখ অবধি আসে। যেটা বলছিলাম, কেন আমিও আবার নতুন করে ফুচকায় আকৃষ্ট হলাম! ক্লাসের মাঝেই ওর সাথে আমাকে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াতে হতো ও ফুচকা খাবে বলে আর আমি ফুচকাওয়ালার সাথে দাঁড়িয়ে খোস-গল্প জমাতাম। আর ও তাকে দিয়ে এই কর, ওই কর এসব বলে এক জামবাটি আলু মাখিয়ে শেষে মোট দশটা ফুচকা খেত। দুটো খেয়েই আবার বলতো, আর একটু ঝাল আর গুঁড়ো মশলা মেশাও। তাতেও শেষ নয়। আবার চারটে খেয়ে বলতো, আর একটু ধনে পাতা মেশাও। শেষের দশ নম্বরটা খেয়ে বলতো, আহা! পারফেক্ট! গোটা প্রক্রিয়াটা আমি রোজ দেখতে দেখতেই একদিন বাবলুকে বললাম, 'দে তো, আমায় একটা পাতা দে!' পঁচিশটা খেয়ে থামলাম। তারপর থেকে রোজ না হলেও মাঝে মাঝেই খেতাম। ততদিনে আমার জানা হয়ে গেছে যে কলেজে যে কজন মেয়ে আমায় পাত্তা দেয় তার থেকে বাবলুকে পাত্তা দেয় ঢের বেশি মেয়েরা! আর একবার উমেন্স কলেজের সামনে আমরা দুই বন্ধু ফুচকা খাচ্ছিলাম। দুটো মেয়ে এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে খেতে শুরু করলো। আমরাও বার খেয়ে
দিলুদা! খেয়েই চলেছি, যেন বেশি খেলেই এবার আমার সাথে পরিচয় করতে আসবে! ছেলেটা যত বার আমাদের বলছে, 'আর খাবেন?' ততবারই আমার বন্ধু বলে চলেছে, 'আরে, দাও তো! এই তো শুরু!' শেষে ওরা চলে যাবার পর আমরাও থামলাম। সব ঠিক আছে। কিন্তু দাম মিটিয়ে সাইকেলে চেপে দু-পা আসতেই আর দেখে কে! কোনরকমে রাজবাড়ী পেরিয়ে পুকুর পাড় অবধি! সাইকেল ফেলে কোনরকমে পুকুরের ধারে! যা গিলেছিলাম।সব গলা দিয়ে উঠে গেল! বাপরে! গলা জ্বলছে!
এর পরপরই শুরু হলো বিয়ে বাড়িতে আগে ফুচকার স্টল। ততদিনে আমি মোটামুটি স্পেশ্যাল দই ফুচকা, জল ফুচকা, শুকনো ফুচকা সবই আলাদা করে খেতে শিখে গেছি। দই ফুচকা হোক আর যাই হোক ওই তেঁতুল জলের ফুচকার মতো মনটা ভরিয়ে দিতে পারে না। কিরকম এক অনাস্বাদিত! আহা! গলা দিয়ে নামে যখন, একটু টক, একটু ঝাল, অল্প নুন আর কি সব গুঁড়ো মশলা যেটা ঢোঁক গেলার পরই দম আটকে যাওয়া ভালো লাগা, সাথে চিবিয়ে দেওয়া পাঁপড়ের মতো ফুচকা! আহা, স্বর্গ! বুঝি, কেন যে মেয়েরা ওই সঞ্জয় দত্তের জন্য পাগল ছিল! (এটা শুধু বর্ধমানের জন্য! সঞ্জয় দত্ত নাকি এখানকার সেরা ফুচকা বানাতো! ভাবা যায়! আমিও খেয়েছি ওদের পাল্লায় দু-একবার! ছেলেটার সত্যিই এলেম ছিল, সঞ্জয় দত্তের সাজন কাটিং চুল, পরিষ্কার-পরিছন্ন জামা কাপড় আর সত্যিই যত্ন করে বানাতো ফুচকা!) যাই হোক, আমি আর আমার এক ভাই একবার তো বিয়েবাড়িতে এতো ফুচকা খেয়েছিলাম যে পরে আর খেতেই বসি নি। আর আজকাল তো ওই দিকে তাকাইই না।
আমার উনি অবশ্য কোনদিনই খুব একটা ফুচকা ভক্ত ছিল না। তাও মাঝে-সাজে খেলেও সেই ব্যাপারটা ছিল না। চাকরীতে ঢুকে প্রথমদিকে একদিন সমীরদার কথায় আমি আর ষষ্ঠী স্কুলের সামনে ফুচকা খেলাম। কেউই জানে না, কে কটা খায়! কিছুক্ষন বাদে সমীরদাই বললো, 'থাম এবার তোরা।' থামলাম আমরা দুজনেই। ততক্ষনে পঞ্চাশ টাকা হয়ে গেছে। দিনটা পনের বছর আগেকার। কতগুলো করে খেয়েছিলাম বুঝতেই পারছো!
ইদানিং ছেলে আর ছেলের মা মাঝে মাঝে ফুচকা খেতে যায়। আমায় বাদ দিয়েই যায়। জানে, আমার খুব একটা পছন্দ নয়। কি আর বলি, ছেলেকে! আবার নতুন করে ওকে আর কি আমার ভালোবাসার কথা বলবো! ছেলের মা যদিও জানে। যাই হোক, আজকাল তো বাড়িতেই ফুচকা। ছেলের আবদারে কালই হল বাড়িতে। বোন দু-প্যাকেট দিয়েছিল অনেক দিন আগে। ওটাও পুরো ফুচকা-পাগল। কোথায় কে কত দামে কত ভালো ফুচকা দেয় বর্ধমানে সে আজও তুমি ওর কাছে জানতে পারবে। এখনো বেরুলেই ওর ফুচকা প্রথম খাবার, পরে রেস্টুরেন্টে যাবে। ও দিয়েছিল এই প্যাকেট দুয়েক যা ছেলের পরীক্ষার ঝামেলায় আর হচ্ছিল না। কাল খুঁজে পেয়ে লেগে গেলাম আমি আবার নতুন উদ্যমে কিছু একটা করে দেখাবার নেশায়। ঝামেলা প্রায় নেই বললেই চলে! এর থেকে তো বাড়িতে ফুচকাওয়ালার ঠেলা থেকে কিনে আনলে বেশি খাটতে হয়। যাই হোক, বাড়িতেই বানানো হল। দই, সস, জল- সব ফুচকাই বানানো হল! খেলাম। পেট ভরলো কিন্তু মন ভরলো কি! অনেক বড় প্রশ্ন!
***ছবিগুলো বোনকে পাঠানো মাত্রই বলে উঠলো, 'আমায় একবার ডাকলি না!' ভাবুন, এই লক-ডাউনে যখন কেউ বেরুচ্ছে না, ও নাকি ওপাড়া থেকে এপাড়া আসবে ফুচকা খেতে! আসলে এটা যেন কিছুতেই ও ভাবতে পারে না যে এবাড়ীতে ফুচকা খাওয়া হচ্ছে আর ও নেই! আগেতো ওই বাবার সাথে বেরিয়ে ফুচকা খেয়ে আসতো আর বাড়ীর জন্য অল্প কয়েকটা কিনে আনতো যাতে নাকি ওর ও ভাগ থাকতো! ও নাকি বাইরে খায় ই নি!
*** ছবিগুলো আমার 'ভাই-বন্ধু'কেও পাঠালাম। পাত্তাই দিল না! কে জানে বাবা, 'ম্যাডামজী' এসব জিনিষ হয়তো বাড়িতে এলাও করেন না!!
আর একটা দিন পার করলাম #করোনামুক্তভারতবর্ষের দিকে
01.04.2020


Comments

Popular Posts