Ka ngai lutuk che, Mizoram!! (2)

প্রায় কুড়ি বছর হতে চললো আমি মিজোরাম ছেড়ে এসেছি। সেই সময়ের দিনগুলো, আমার চাকরী জীবনের শুরুতে আমি ওখানের এক দূর পাহাড়ের কোলে ছোট্ট তিন গ্রাম আর মফস্বলের সংযোগস্থলে নদী-পাহাড়ের মাঝে ছিলাম। কাছাকাছি শহরের দূরত্ব কুড়ি কি.মি হলেও যেতে প্রায় অর্ধেকবেলা চলে যেত। ওখানে দু-বছরের জীবনে আমি এতো নতুন ধরণের, নতুন ভাবনার মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি যা বলে শেষ করা যাবে। সেই মানুষদের কেউ-কেউ আজও আমার পরিবারের মানুষের মতনই হয়ে গেছে আবার কেউবা দূরে সরে গেছে। সম্পর্কের উন্নতি-অবনতি ছাড়াই কখন আমরা একজায়গায় থাকতে থাকতে কাছাকাছি এসে গিয়েছিলাম আজ আর ভেবেই পাই না। এমন অনেক মানুষ ছিল যাদের দু-বেলার রান্নার খবরাখবর আমাদের নিজেদের খবর ছিল, তাদের অনেকেরই সাথে আজ এতো বছর কোন যোগাযোগ নেই। আমি যে সময় ওখানে ছিলাম তখন হয়তো মোবাইল ফোনের কোন ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তু ল্যান্ড-লাইন ফোন নাম্বারও আর আজ আমার কাছে নেই। ক্ষীণ দু-একজন বন্ধু যাদের সাথে যোগাযোগ আজ একটু হলেও আছে তাদের কাছ থেকেই আবার নতূন করে যোগাযোগের সূত্র খুঁজছি। এই সময়টায় আমি যাদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম তাদের একটা বড় অংশের মানুষজন ছিল বাংলাদেশের মানুষ যাদের ভারতে বাড়ি ছিল শিলচর বা তার পাশাপাশি এলাকা। এছাড়া আমি মিজোরামের আদি বাসিন্দা মিজো জনজাতি, চাকমা উপজাতি, মনিপুরী এবং অসমীয়া অনেক মানুষের সাথে মিশেছি। এরা সবাই এখানে ছিল তাদের চাকরী বা ব্যবসার প্রয়োজনে।এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা চাকমা উপজাতির যাদের এখানে আসা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে। এদেরই একটা অংশের মানুষ ত্রিপুরায় থাকে। তাদের সবার কথা মনে না থাকলেও কেউ-কেউ আজও মনের অতলে থেকে গেছে। কোন এক অলস বসে থাকা দুপুরে কেমন করে জানি না চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই ওখানে কাটিয়ে আসা দিনগুলোর ছবি, দু-একজনের কথা মনে হয় শুনতে পাই, যেন এই পাশেই দাঁড়িয়ে বলে গেল এইমাত্র! আমার সেই দিনের ছবি, না-ছবি, দুঃখ-কষ্ট-আনন্দময় জীবনের কিছু কথা, কিছু বন্ধুদের স্মৃতিচারণ শুধু এই লেখায়। সবার সব গল্প এক লেখায় শেষ করা সম্ভব নয় আর সে চেষ্টাও আমি করবো না। তাই আলাদা করে কিছু ঘটনা, কিছু চরিত্ররা যারা আজও হানা দেয় আমার মনে তাদের কথাই লিখি।

দুটো ফুটফুটে ছোট্ট পাহাড়ী মেয়ে, একটা খালি গায়ে আর একটা গেঞ্জি পরে বারান্দায় বসে হাতে চামচ নিয়ে কাঁচের বাটি থেকে কি যেন খাচ্ছে। যত না খাচ্ছে তার থেকে বেশি সামনের রাস্তা দিয়ে কেউ গেলে তার দিকে চামচ বাড়িয়ে খাবার দেবার ভঙ্গিমা করছে। সে কিছু বললেই ছুটে আবার বারান্দার পিছনে চলে আসছে। আমি বাজার থেকে ফিরছিলাম ওই রাস্তা দিয়েই। আমাকে দেখেই ছুটে এলো দুটোই বারান্দার সামনে, তারপর আমার দিকে চামচে করে বাটি থেকে কিছু একটা তুলে দিতে গেল আর মুখে চাকমা ভাষায় কি একটা বললো। আমিও বেশ মজা পেয়ে একটু কাছে যেতেই বড়টা দৌড়ে পিছিয়ে গেলেও ছোটটা পারলো না। আমি কোলে তুলে নিলাম। ঠিক তখনই আমার চোখ পড়লো ওদের বাটির দিকে। দেখি, কালো রঙের বলের মত ছোট ছোট কি এক বস্তু দুজনেরই। সেটাই ওরা চামচে করে তুলে খাচ্ছে আর সবার সাথে এরকম মজা করছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম ওই বস্তুগুলো হল গুগলি। হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। খোলাসমেত কালো কালো গুগলি, যেগুলো আমরা খোলা ছাড়িয়ে, পেঁয়াজ-আদা-রসুন দিয়ে বেশ ঝাল-ঝাল রান্না করি সেই গুগলি। কিন্তু এই বাচ্ছা দুটো ওগুলো কি করে খাচ্ছে! ওদের বারান্দায় উঠে ওদের দরজার কাছে গিয়ে বাড়ির লোকেদের কাউকে ডাকতে যেতেই, সামনে বেরিয়ে এলো একজন। যার কথাই আমি এখানে লিখবো ভেবেই এই লেখা শুরু করেছি। বেরিয়ে এসেই প্রথমে,
-আসুন, আসুন! সাগরদা ভিতরে আসুন!
আমি তো থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছি যে ওরা কি খাচ্ছে, আপনি দেখেছেন!
সেই প্রথম পরিচয় এই ছেলেটির সাথে। ছেলেই বলছি কারণ আমার থেকে বেশ কিছুটা ছোটই। আমার ওকে দেখেই বিস্ময়ের কারণগুলোর একটাই বলি না হয়! ওর দুটো মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়েটা যার বয়স তখন দু-আড়াই বছর সেটা বাজারে গেলে বা টিভিতে কোথাও হৃত্বিক রোশনের ছবি দেখলেই 'পাপ্পা-পাপ্পা' বলে উঠতো। আমিও তাই নিজের চোখে ওরকম এক সুন্দর দর্শনের ছেলে যাকে দেখতে প্রায় হৃত্বিকের মতো, যে কিনা এই সকাল বেলায় এক চাকমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাংলায় আমার সাথে কথা বলছে, দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যাই হোক, পরিচয় -পরিচিতি বাড়লো ধীরে-ধীরে। প্রায় বন্ধুর মতোই হয়ে গেলাম খুব তাড়াতাড়ি। আড্ডা, সকালে বাজার, বিকালে পাহাড়ী রাস্তা ধরে হাঁটতে যাওয়া-সবেতেই একসাথেই ছিলাম। আমার এক পরিচিত দাদা, অসীমদা ওর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল ফলে আমাদের তিনজনের প্রায়শই আড্ডা হতো সে চায়ের দোকানে হোক বা তাসের আসরে। কিন্তু প্রায়ই আমি দেখতাম, ও খুব কম কথা বললেও কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকতো। সেটা সবাই বুঝতে পারতো না শুধু এর ব্যবহারের জন্য। এতো ধীর, স্থির, শান্ত, মার্জিত ভাবে ও থাকতো এবং কোন রকম কোন জড়তা বা লোকাল ডায়ালেক্ট ব্যবহার না করে পরিষ্কার কলকাতার বাংলায় কথা বলতো আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম ওকে দেখে। শুধু ভাবতাম, এটা কি করে সম্ভব! ও কি করে এই চাকমাদের বাড়ির ছেলে! কিছুতেই বিশ্বাস হতো না! সম্পর্ক গভীর হলে ওর কাছ থেকেই জেনেছিলাম ওর সমস্ত কিছু। সব সন্দেহের নিরসন হয়েছিল সেদিন। সম্মান করেছিলাম সেদিনই মনে মনে ওকে। জানাতে পারি নি, বা হয়তো জানবার দরকারও ছিল না, এতটাই বন্ধু হয়ে গিয়েছিল আমাদের সাথে।
ওর কথা বলি এবার কিছুটা।
ওর নাম অরিন্দম। টাইটেল জানতে চাই নি বা শুনলেও মনে নেই। ছ-ফুট উচ্চতার, ধপ-ধপে ফর্সা, অল্প স্টাইলিশ চুল, চোখে রিম-লেশ চশমা, সুন্দর চেহারার ও যখন বাজারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেত ওকে সব সময়ই অড ম্যান আউট মনে হতো ওই জায়গায় যেখানে প্রায় সমস্ত মানুষেরই গড় উচ্চতা পাঁচ ফুট বা তার একটু বেশী। ওরা শিলংয়ের আদি বাসিন্দা। ওর দাদু কলকাতা থেকে শিলংয়ে এসে বাড়ি করে থেকে গিয়েছিল। ওর বাবা শিলং পুলিশের বড় অফিসার। ও বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ও পড়াশোনা করেছে শিলং সেন্ট-পলস কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে। এখানে ও একটা স্কুলের সায়েন্সর শিক্ষক। এই অবধি সবই ঠিক ছিল। কিন্তু যেটা সমস্যার সেটা হোল ও ভালোবাসতো এক চাকমা মেয়েকে যার সাথে ও কলেজে পড়তো। বিয়ে করা- ওর বাড়িতে মেনে না নেওয়া- ওর বড় মেয়ের জন্ম- সবকিছুই এতো তাড়াতাড়ি ওর জীবনে ঘটে গেছে যে এখন থমকে গেছে ওর জীবন। যে জীবন ও এতবছর শিলংয়ে কাটিয়ে এসেছে সেখান থেকে প্রায় বিতাড়িত হয়ে এই দূর জায়গায় ওকে ঘর বাঁধতে হয়েছে যাদের সাথে তাদের কেউই ওর নিজের জাতির বা ওর বেড়ে ওঠার সঙ্গের মানুষরা নয়। শুধুমাত্র মিলিকে ভালোবেসে ও সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছে, যেখানে ও আর কোনদিনই ফিরতে পারবে না। রাগ-দুঃখ যেমন একদিকে আবার ভালোবাসার মানুষের জন্য সব ত্যাগ করে ও এক জীবন শুরু করছে এই তেইশ বছর বয়েসে। ছুটি পড়লে আমরা বাড়ি আসার গোছানো শুরু করলেই ওকে দেখতাম ও আরো চুপচাপ হয়ে যেত। আমাদের প্রায়ই বলতো,
- আপনারা থাকেন তাই আমার মনে হয় যেন খানিকক্ষণ খোলা হাওয়ায় থাকলাম।
- কত দূরে বাড়ি আপনাদের, তাও যেতে পারেন বছরে দুবার। আর আমার কাছে বাড়ি হয়েও যেতে পারি না!
ওর বড় মেয়েটা একদম ওর মতোই দেখতে ঠিক এক মিষ্টি পুতুল আর ছোটটা ছিল ওর মায়ের মত, চাকমাদের মতো দেখতে। যদিও মিলি চাকমাদের মধ্যেই একটু আলাদা দেখতে ছিল। মিলিও জানত যে ও কি মনঃকষ্ট ভুগছে। ওরাও প্রায় বাধ্য হয়েই এই জায়গায় এক চাকরীর ভরসায় জীবন শুরু করেছিল। ওদের ইচ্ছা ছিল কোনরকমে বাইরে একটা চাকরী নিয়ে দিল্লীর দিকে চলে আসবে। অরিন্দমের সে যোগ্যতা ছিল। বাংলা, ইংরেজী সমান ভাবে বলতে পারতো আমাদের অনেকের থেকেই বেশ ভালভাবে। আর ওর উপস্থাপনা, ব্যবহার, পড়ানো সমস্ত কিছুই ছিল সত্যিই দেখে শেখার মতো।
***না। অরিন্দমের সাথে আমার আজ কোন যোগাযোগ নেই। আজই এক পুরোনো ওখানের বন্ধুকে বলেছি ওর কোন যোগাযোগ পেলে যেন আমায় জানায় বা ওখানে গেলে যেন ওর খোঁজ এনে দেয়। দেখা যাক, আর কি যোগাযোগ হয় আমাদের! ওরমতো মানুষকে আমি হারিয়ে কষ্ট পাই।
***ছবিদুটো সকালেই বইয়ের তাক পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখতে খেলাম। সব স্মৃতিরা এক এক করে নাড়া দিয়ে উঠলো। এটা ওখানের বাজারের মাঝে আমি, অরিন্দম আর অসীমদা। আর অন্যটায় ওর দুই মেয়ে আর তাদের বন্ধু।
*** * উপরের মিজো ভাষা যা ইংরাজী বর্ণমালা দিয়েই লেখা হয় সেটাই আমার এই লেখার নাম। তার উচ্চারণ আর মানে না জানলে তো চলে না, তাই:
'কা আজ্ঞাই লুতুক ছে, মিজোরাম!'
'I miss you very much, Mizoram!'
এর আগে মিজোরাম নিয়ে আর এক পর্ব লিখেছিলাম। তার লিঙ্ক কমেন্টস এ দিলাম। পড়ে দেখা যেতে পারে।
05.04.2020



Comments

Popular Posts