নন সেন্স কথামালা (১৪): আমি, পালকির গান আর আমার গাঁয়ের কাদা।।

আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে মামারবাড়ির গ্রাম ছিল মাত্র সাত কিলোমিটার। আমাদের গ্রাম থেকে প্রথমে দুই কি.মি দূরে এক গঞ্জে এসে আবার পাঁচ কি.মি যেতে হতো। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি প্রথম দু কি.মি পার করা ছিল এক দুর্গম পথ পার করা। কারণ আর কিছুই নয়! এই দু কি.মি ছিল মাটির রাস্তা। তার ফলে শীত-গ্রীষ্ম বাদে বাকি সময় মোটামুটি কাদার রাস্তাই ছিল বলা চলে। যারাই শহরে যেত তারা মোটামুটি খালি পায়ে জুতো কাঁধে গঞ্জে এসে পা-ধুয়ে জুতো পরে বাসে উঠতো। কাদার গল্প একটু পরে বলছি। তার আগে বলে নিই যে ওই গঞ্জ থেকে মামার বাড়ি রাস্তা ছিল বাঁধানো পাকা পিচ ঢালা রাস্তা। সেই নিয়ে মামাতো ভাইদের বেশ রাল্যাই ছিল। যাই হোক, আমাদের রাস্তায় কাদা মোটামুটি আশে-পাশের দশ গ্রাম জানত। কি বিভীষিকাময় ছিল সেই দিনগুলো যারা ওই দিনে গ্রামের বাইরে কাজ-কর্মে যেত আর সন্ধ্যায় ফিরত। আমার বাবাও তাদের মধ্যেই একজন। প্রতিদিনই নতুন গল্প শুনতাম আজ কাদায় কাদের মোষের গাড়ি বসে গেছে, কাদের রাখাল এখনো গা-ধুইয়ে যাচ্ছে পুকুর পাড়ে সেসব শুনতে শুনতেই সন্ধ্যার পড়া তুলে দিতাম আমি আর ভাই। এমনিতেই বর্ষা কালে সন্ধ্যা বেলায় কারেন্ট থাকা এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ছিল। তাই হ্যারিকেনের আলোয় গল্প শোনা অবধি চলতে পারে, পড়াশোনা নৈব নৈব চ! এরকম এক অজ গাঁয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আমার ডাক্তার দাদু , যে কিনা সেই সময় দিল্লীর হসপিটালে মেডিকেল অফিসার ছিল, সে কি খুশী হতে পারে! উপায় ছিল না, তাই বিয়ে। যাই হোক, মা-বাবার প্রেমের গল্প লেখার কাজ আমার নয়। তাই আমি ফিরে যাই সেই কাদায়। এই সময়টা মায়ের নিজের বাড়ি যাওয়ার খুবই কষ্ট ছিল। আমায় নিয়ে আমাদের জয়মামা মোষের গাড়ি সাজাতে শুরু করত। প্রথমে বেশ কিছু খড় পেতে তার উপরে শতরঞ্জি পেতে দিত। আর মাথায় থাকত ছই। সেই রাজকীয় গাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে সকালে মুড়ি খেয়ে যাত্রা শুরু করলে মামারবাড়ি পৌঁছাতাম দুপুরে ভাত খাবার আগে। এরকমই কোন এক সময়ে এতো বৃষ্টি হয়েছে যে আমাদের রাস্তায় আর মোষের গাড়িও চলছে না। দু-তিনটে গাড়ি তো রাস্তায় কাদাতেই বসে আছে কয়েকদিন। মোষ গুলো ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু গাড়ি আর তুলে আনা যায় নি। এরকমই এক সময় আমাদের ঠিক হল আমরা মামার বাড়ি যাবো। কিন্তু যাবো কি করে! দু-একদিন ধরেই শুনছি যাবো, যাবো। কিন্তু যাবো কি ভাবে এই চিন্তাতেই আছি আমরা। বাবা রোজই সন্ধ্যায় বাড়ি এসে বলে, 'কালকের দিনটা দেখি, যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে পরের দিন রোদ উঠলে, কাদা একটু কমে গেলে যাবি।' দাদুর কাছে খবর গেছে মা বাড়ি যেতে চায়। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠিয়ে মা বললো, ' নে, তৈরি হয়ে নে। এখুনি মামারবাড়ি যাবো।' আমি ভেবেই পাচ্ছি না যে এখন কি করে যাবো। একে এতো কাদা, তার মধ্যে এই সকাল বেলায়। ছুটে বাইরে দেখতে গেলাম যে জয়মামা কি মোষের গাড়ি জুতে ফেলেছে! না। কেউ নেই। পাশে শিবতলায় দেখি আমার না-চেনা চার-পাঁচ জন লোক বসে আছে। মুড়ি খাচ্ছে। আর ওদের পাশেই দেখি একটা পালকি নামানো। আমি সেই প্রথম পালকি দেখলাম। ছুটে নেমে গেলাম বারান্দা থেকে। ঘুরে-ফিরে, দরজা খুলে, উঠে-বসে অনেক বার দেখলাম। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না, এতে বসে আমি আর মা কি করে যাবো! যাই হোক, উঠে বসলাম। মা একদিকে দেয়ালের ধারে আর আমি উল্টো দিকের দেয়ালে পিঠ করে। সামনে একটু ফাঁকা জায়গা। যেই সেই চারজন আমাদের নিয়ে পালকি কাঁধে তুললো কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি। প্রথমে বেশ মজা লাগলেও গ্রাম পেরুতে না পেরুতে দু-দিকের দরজা আমি খুলে দিলাম। পার হয়ে যাচ্ছে মাঠের পর মাঠ, পুকুর, আমাদের খামার বাড়ি, পাশের রাস্তায় লোকজন। বেশ জোরেই যাচ্ছে। যাচ্ছে না বলে ছুটছে বলা চলে। ততদিনে আমি মায়ের কাছে 'পালকির গান' পড়ে ফেলেছি। একবার মন দিয়ে শুনলাম। না, ওরা পালকির গান গাইছে না। তবে কিছু একটা বলছে এবং তা বেশ জোরে জোরেই বলছে, আর যত জোরে বলছে তত জোরে ছুটছে। তখনও তো বুঝিনি যে ওই পালকির গান সত্যেন্দ্রনাথ আমাদের পড়ার জন্য লিখেছিলেন, পালকি টেনে নিয়ে যেতে লেখেননি। যাই হোক, এর মধ্যেই আমার বায়না, আমি নামবো। ওদের সাথেই হেঁটে যাবো। বেশ কিছুক্ষন ঝামেলা করার পর ওরা আমায় নামলো। দু-পা যাবার পরই আমি বুঝে গেলাম, আমার দ্বারা ওদের সাথে যাওয়া সম্ভব নয় এতো জোরে ওরা যাচ্ছে। তাই আবার পালকির ভিতরে। ঘুমিয়ে গেলাম। প্রথম থামলে ঘুম ভাঙলো সেই গঞ্জে যেখানে বাবার আড়তের সামনে। উঠে দেখি ওই চার জন কাকু আর পাশে পাশে আসছিল যে কাকু তারা আবার দাওয়ায় বসে মুড়ি খাচ্ছে। আমি উঠে বাবার গদি ঘরে কিছুক্ষণ বসলাম। কাকুদের খাওয়া হলে আমরা আবার পালকিতে উঠলাম। থাক আজ এই পর্য্যন্তই। বাকি কাদা আর মোষের গাড়ির গল্প পরে হবে।

*** কি এমন হোল যে এরকম এক লেখা আমি লিখলাম। আসলে আমি আজ সকাল থেকে ওই সেই জায়গা দুটো শুধুই যেন দেখতে পাচ্ছি। ঠিক যে দুটো জায়গায় পালকি দাঁড়িয়েছিল। একটা বাবার আড়তের সামনে আর একটা মামাদের বাড়ির রাস্তায় এক ছোট নদীর ব্রিজ পর করে আমগাছের তলায়। বার বার শুধু ওই জায়গা দুটো মাথায় আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। আজ দাদুও নেই, বাবাও নেই, আমি নিজের মনে ভাবছি আর হাসছি। মাকে বলতে মনে করতে পারলেও কোন বারের কথা বলছি সেটা বলতে পারলো না। আসলে পালকিতে অনেক বার যাওয়া হলেও আমার মাথায় কোন বারের কথা গেঁথে আছে, সেটা মা কি করে মনে করবে!
*** যাই হোক, আমার স্মৃতি, আমার স্মৃতিচারণ, আমারই থাক। আমার 'নন সেন্স কথামালা' না হয় আর একটু লোকের মাথা ব্যথার কারণ হোক।
আমার এই ঘটনা যখন মনে পড়ছে তখন আমি প্রথম শ্রেণী তে পড়ি। তাই আমার বোন যদি এটা পড়ে কিছু বলতে আসে ওকে বলে দিও তো, ও তখনও জন্মায়নি! আমি সেই সময়কার কথা বলছি যখন শুধু আমি মা আর বাবা ছিলাম।
*** ছবিটা আমি গুগল থেকে নিয়ে কিছু ওস্তাদি করলাম রং দিয়ে। সোজা কথায়, চটকে দিলাম আরকি!
03.04.2020



Comments

Popular Posts