নন সেন্স কথামালা (১৬): অথ ধূমপানকথা: সিগারেট ও দাদা! (দ্বিতীয় পর্ব)

২০০৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত, এই সাতবছরে আমি প্রতিবছরই বিদেশ গেছি। তারমধ্যে একই দেশে দুবারও গেছি। প্রতিবারেই সিগারেট নিয়ে এমন কিছু ঘটনা হয়েছে যা আজ মনে পড়লে বেশ হাসি পায় আবার কখনো মনে হয়, সত্যিই কি করে উদ্ধার পেলাম সেই সমস্ত পরিস্থিতি থেকে। যেহেতু আমি আমার এই সিরিজে কোন ভ্রমণ কাহিনী লিখছি না, তাই বেশ কিছু কথা উহ্য থেকেই যাবে। প্রতিবারেরই এই বিদেশ যাওয়া ছিল হয় সেমিনার না হয় স্কলারশিপ পাওয়া বা কোন শর্ট কোর্স যা কিনা ছিল বিদেশী গভর্নমেন্ট অনূদিত তাই প্রায় প্রতিবারই আমায় একাই যেতে হয়েছে। যদিও কোন জায়গাতেই আমায় খুব একা থাকতে হয় নি কারণ আমি ঘুরে-ফিরে ঠিকই আমার মতো আড্ডাবাজ লোকজন জড়ো করে ফেলি। সারাদিন যাই হোক, যতই ইউনিভার্সিটির চাপ থাকুক বিকালের পর পৃথিবীর কোথাও কেউ খুব একটা কাজ করে না, সেটা আমি প্রথমবারের পরই বুঝে গিয়েছিলাম। তাই আমার আড্ডা ঠিকই জুটে যেত। তা, সেই আড্ডার গল্প না হয় পরে হবে অন্য কোথাও, আপাতত সিগারেট পর্বে ফিরে আসি।

২০০৯ সালের শেষের দিকে এক ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে কুয়ালালামপুর গেছি। সঙ্গে আমার এক সিনিয়র দাদা-স্যার-বন্ধুও গেছে অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে। মাত্র তিন দিনের ছিল ওই কনফারেন্স। তাই আমরা ঠিক করেছিলাম শেষ হবার পরেও আমরা আরো তিনদিন থাকবো যাতে শহরটা একটু ভালো করে ঘোরা হয় বা পারলে একটু দূরে জেন্টিংও ঘুরে আসবো। শেষ তিনদিন আমাদের আরো দুই বন্ধু আমাদের সাথে থাকবে। সেই মতোই সব প্ল্যান ঠিক করাই আছে। প্রতিবারের মতো এবারও আমি বিদেশ যাবার আগে আর কিছু প্যাক করি বা না করি প্রয়োজনমতো সিগারেট আগে ব্যাগের প্রথমেই প্যাক করে নি। এবার ওই সময়টা এতো ব্যস্ত ছিলাম যে আসার আগের দিন পর্যন্ত সিগারেট কেনা হয়ে ওঠেনি। যার ফলে যাবার দিন বাসস্ট্যান্ডের একটা ছোট দোকান থেকে মাত্র কয়েক প্যাকেট নিয়েই উঠলাম। বুঝলাম, এবার কপালে দুর্গতির সীমা থাকবে না। খুব বাঁচিয়ে খেতে হবে না হলে শেষ দিন পর্যন্ত চলবে না। যাই হোক, প্রথম কয়েকটা দিন বেশ ভালো ভাবেই কাটলো। এরপর যেদিন থেকে ঘুরতে শুরু করলাম সেদিন সিগারেট প্রায় শেষের দিকে। আমরা চারজন এই সময়ে ঘুরছিলাম যার একজন আমার ছোটবেলার বন্ধু আর অন্য আরেকজন ওই দাদার বন্ধু। আমি আর আমার বন্ধু হচ্ছি যাকে বলে সিগারেটখোর আর দাদা আর দাদার বন্ধু সিগারেট খায়না। আমার বন্ধু আর আমি যখন স্টকের প্রায় সব সিগারেট শেষ করে মনমরা হয়ে বসে আছি তখন সেই দাদার বন্ধু আমাদের সমস্যার কথা জিজ্ঞাসা করলো। শুনে-টুনে বেশ বিজ্ঞর মত বললো, -'শেষ হয়ে গেছে তো কিনে নে! এখানে কি কেউ সিগারেট খায় না! সব জায়গাতেই পাওয়া যাচ্ছে!'
- না, মানে! ওই যে ব্র্যান্ড....!
- নিজেদের ব্র্যান্ড না পেলেই বা যা পাচ্ছিস তাই খা!
বোঝাই কি করে ওনাকে যে ব্র্যান্ড- ট্র্যান্ড কোন কিছুই নয় রে বাবা! আসলে খাই তো আমরা পঞ্চাশ টাকার ছোট গোল্ড-ফ্লেক, কি করে বারো ডলারের নাম না জানা ভুল-ভাল সিগারেট কিনি। এক প্যাকেট সিগারেট কেনার আগে তো তখন শুধুই বারো ইনটু পঞ্চান্ন টাকা করছি! সকাল থেকে বার পাঁচেক হিসাব করেও কিছুতেই ছশো টাকার কমে হবে না বুঝে গেছি। এসব দেখে ও আমাদের ঘরে বসতে বলে বেরিয়ে গেল। আমরা ভাবছি, যা বাবা! এতো বললাম, তাহলে হয়তো কিনেই এনে দেবে! সত্যি সত্যিই কিছুক্ষন বাদে ফিরে এলো, এক প্যাকেট মার্লবোরো সিগারেট আর সাথে একটা লাইটার। আমরা তো হতবাক হয়ে গেছি। আবার মনে মনে খারাপও লাগছে। ধুর! এটা ঠিক নয়! নিজেরা যতই হোক চাকরী করি, এরকম ভাবে একজনের কাছে নিজের নেশার জিনিষ নেওয়া ঠিক হল না। দাদা কিন্তু ওসব কিছু না ভেবেই বললো,
- এরপর ফুরিয়ে গেলেই বলবি। আর বাকি দুদিন সিগারেট নিয়ে ভাবিস না। ভালো করে ঘুরে নে।
এই দাদটির সাথে আমাদের কিন্তু এবারেই প্রথম পরিচয়। তার আগে কোনদিন দেখিও নি। একসাথে বেড়াতে এসে আমাদের ভাইয়ের মতো ব্যবহার করছে। যার মাধ্যমে পরিচয় তার কাছে শুনলাম ওর নাকি প্রচুর টাকা, বিরাট ব্যবসা আমাদের শহরেই। উপরি পাওনা, উনি বিয়ে করবেন না। একাই থাকবেন জীবনে। বিন্দাস থাকেন সবসময়। আর টাকা-পয়সা সবই বাড়ির লোকজন আর বাইরে কয়েকজন বন্ধুদের জন্যই খরচ করে। আমার সেই দাদার খুব কাছের বন্ধু। সেই বললো,
- তোরা ওতো ভাবিস না। ওকে বলবি যখন যা লাগবে, এনে দেবে।
এরকম অফার পেয়ে আমি আর আমার বন্ধু তো বেশ খুশী মনেই আছি। সিগারেট শেষ হবার আগেই ওকে বলছি, আর ও কিছুক্ষন পরেই এনে দিচ্ছে। এমনও হয়েছে বাইরে ঘুরতে বেরিয়ে কোথাও চা-কফি খেয়ে উঠবার আগেই আমাদের ও জিজ্ঞাসা করছে,
- কি রে! তোরা সিগারেট খাবি না! দাঁড়া, এনে দিচ্ছি। আমাদের হয়তো তখনো প্যাকেটে দু-একটা আছে, তারমধ্যেই আবার নতুন প্যাকেট সঙ্গে লাইটার হাজির। বেশ কয়েকবার এরকম হবার পর আমরা ওই দাদাকে বললাম,
- ধুর, তুমি আর কিনো না এতো সিগারেট। আর প্রত্যেকবার একটা করে লাইটার কেন কিনছো!
- কিনি না তো, আমায় এমনিই দেয়!
- মানে! এমনি দেয় কি!
- দেয় তো! দাম নেয়না তো!
- কি যা তা বলছো! দাম নেবে না কেন? তুমি কি ওদের জামাই নাকি!
- দ্যাখ, তাহলে দাম নেয় কিনা!
এই কথা যখন চলছে তখন আমরা একটা বাংলাদেশি খাবার দোকানে বসে আছি। দোকানটার সাথেই একটি ছোট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ও উঠে গেল এবং যথারীতি সেখান থেমে এক প্যাকেট সিগারেট আর একটা লাইটার নিয়ে এল। খাওয়ার পর আমাদের বললো, 'বাইরে গিয়ে সিগারেট খা'।
এবং একটু বাদে ও এলো শুধু খাবারের দামটুকুই দিয়ে। আমরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। এটা হতে পারে নাকি! রাস্তার মোড় ঘুরেই একটা ছোট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। এবার ও বললো, তোরা আলাদা আয়! রাস্তার উপরেই ছোট খেলনা, চকলেট আরো অনেক কিছু সাজানো আছে। ও সোজা ভিতরে গিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট আর লাইটার নিয়ে এসে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই দোকানের মেয়েটার কাছে বেশ কয়েক প্যাকেট চকলেট, দুটো খেলনা কিনলো আর শুধু এগুলোর দাম দিল। আমরা পাশেই দাঁড়িয়ে শুধু অবাক হয়ে দেখলাম যে ওকে কেউই সিগারেটের দাম চাইল না। সম্মান দিতেই হয়। শিল্পী মানুষ!
যাক, আর কিছু লেখার নেই। শুধু এটুকু বলতেই হবে আমাদের সেবারে সিগারেটের কোন অভাব হয় নি।
*** আমার সেই সাক্ষীথাকা বন্ধু, দাদা সবাই এখানেই আছে। ওই দাদার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। চাইলেই দেখা করা যায়। তাও! থাক। পরে দেখা যাবে। শুধু একটাই কথা, শিল্পী সম্পর্কে কোন খারাপকথা বলার আগে কিন্তু দু-বার ভাববে!
***কুয়ালালামপুর যাবো আর পেট্রোনাস টাওয়ারে উঠবো না বা তার সামনে ছবি তুলব না, সেটা তো হয় না। তাই ছবি তোলার জন্যই যে ছবি সেই ছবিগুলো দিলাম। সামনে থেকে সকালে আর সন্ধ্যায়।
05042020



Comments

Popular Posts