নন সেন্স কথামালা (১৫): অথ ধূমপানকথা: সিগারেট ও সুন্দরী (প্রথম পর্ব)

দূরে একটা পাহাড়। কেউ কখনো যায় না অতো দূরে। আশে-পাশে লেকের ধারেই ছোট-ছোট গ্রাম। ইদানিং কালে গজিয়ে ওঠা কয়েকটা হোটেল-লজ বা একটু লোকদেখানো রিসোর্ট। সারা-বছর বাইরের লোক হাতে গোনা। কিন্তু এই সময়টা বেশ জমজমাট। শহরের মানুষের ভীড়। এথনিক ট্যুরিজমের নামে যথেচ্ছার চলে। সকালে হাঁটতে বেড়িয়েই প্রথমেই মনে হল, একেবারে সোজা উঠে যাবো পাহাড়ের মাথায়। ঠিক -ঠিক হাঁটলে আর রাস্তা খুঁজে পেলে দুপুরের আগেই পৌঁছানো যাবে। উপর থেকে চারিদিক দেখে, শেষ বিকালে ফিরব। হোক, একটু সন্ধ্যা, অসুবিধা নেই। ভাবনার জন্য এবার আমার সাথে কেউ আসে নি। আর যারা শুধুই এসেছে তারা কাল রাতের খোঁয়ারি কাটিয়ে উঠে আমার খোঁজ করতে করতে বেলা শেষ হয়ে যাবে। বেড়িয়ে পড়লাম। পাকা রাস্তা ছেড়ে ছোট টিলার ঢাল দিয়ে উঠতে শুরু করলাম। ঝোপ-ঝাড় টপকে, কাঁটা গাছ মাড়িয়ে বেশ কিছুদূর উঠে যাবার পর যখন আর কিছু নিচের বা উপরের দেখা যাচ্ছে না, তখনই একটা সিগারেটের জন্য মনটা ছটফট করে উঠলো। একটা গাছে হেলান দিয়ে জলের বোতল বের করে মুখটা ভিজিয়ে নেবার পরই শরীরটা জুড়িয়ে গেল। একটু সময় দিয়ে নিচ্ছিলাম শরীরটাকে। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরই সিগারেটটা ধরিয়ে বেশ জুত করে টান দেবার পরই শুনতে পেলাম পায়ের শব্দ। বেশ চমকেই উঠেছিলাম। ভয়ও পেয়েছিলাম। হাতে ধরা সিগারেটে টান দিতেই ভুলে গেলাম। ফ্লুরোসেন্ট সবুজ আর কালো রঙের বডি টাইট স্পোর্টস সুট আর পায়ে দামী জগার সু, মেয়েটা উঠে আসছে দ্রুত পায়ে। একঝলক দেখেই চিনতে পারলাম, কাল রাত্রে রিসোর্টে আসা কোন এক নাটকের দলের সাথেই ছিল। সারা সন্ধ্যে সামনের লনে আড্ডা-গান-নাচে মাতিয়ে রেখেছিল ছেলে মেয়েগুলো। আলাদা করে চিনে রাখার মতো কিছু না হলেও এই মেয়েটিকে আমি বেশ কয়েকবার আলাদা করেই দেখেছিলাম। এক অন্য স্টাইলে পানি-টেল করে রাখা চুল ঝাঁকিয়ে প্রায় সবাইকে কথায় কথায় ঝাড় দিচ্ছিল। আবার বিকালে রিসোর্টের বাইরে দেখলাম যত রাজ্যের স্থানীয় ছেলে-পুলে গুলোকে একসাথে বসিয়ে ওদের সাথে কি খিল-খিল হাসি আর সবাইকে শাসন করে কি সব ভাগ করে খাচ্ছে। ওদের দলের ভীড়ের বাইরে আলাদাকরে দেখেছিলাম বলেই ওকে মনে থেকে গেছে। সটান সামনে এসে কোন ভনিতা না করেই আমার দিকে তাকিয়ে আদেশ,

- এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালেন যে! কোন কান্ড জ্ঞান নেই আপনার! সক্কাল সক্কাল এতো উপরে উঠে এসেছেন কি সিগারেট খেতে!
- নাআআ! না। না, মানে! কি!
আমার উত্তর শেষ হবার আগেই দেখলাম আমার থেকে প্রায় দশ পা এগিয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। সেখান থেকে মুখটা একটুও না ঘুরিয়ে একটু জোরেই বলে উঠলো,
-তাড়াতাড়ি উঠে আসুন উপরে, না হলে বিকেলের আগে দেখে নামতে পারবেন না!
আমি নিজেকে এসব ব্যাপারে বেশ সম্মান করি। হুঁন! নামতে পারবে না! কোথাকার ওস্তাদ এলো রে! আমি আমার মতো যাচ্ছি, তোর কি রে! তুই যা না তোর মতো! এমনিতেই বলে আমার বিরক্ত লাগছে এই ভেবে যে এই গোটা আসা-যাওয়ার রাস্তায় কাওকে দেখতে হবে না, ভাবনার এরকম মাঠে মারা যাওয়ায়। যাই হোক, সিগারেট শেষ করে আবার একটু মুখে জল নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটার রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে একটু উপর-নিচ করে হাঁটলে এগিয়ে যাওয়া যাচ্ছে টিলার মাথার দিকে। পৌছালাম প্রায় দেড় ঘন্টা পর। একটু ফাঁকা জায়গা, দু একটা বড় পাথর আর ঝোপ ঝাড় প্রায় নেই। চারিদিকের সমস্ত কিছু দেখা না গেলেও সামনের বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা যেখান থেকে বহুদূরের প্রায় সব কিছুই দৃশ্যমান- লেক, লেকের পাশের ছোট ছোট গ্রামের বাড়ি এমনকি একটু কষ্ট করে দেখলে নীচে চাষের জমি আর রিসোর্টের সারি। সামনের দিকে একটু এগিয়ে ঢালের সামনে থেকে বেশ কয়েকটা ছবি তুলতে ক্যামেরা বার করে এগুতেই,
- ওর থেকে আর এক পা বেশি গেলে কিন্তু নিজেই ছবি হয়ে যাবেন!
ভাগ্যিস ক্যামেরা গলায় ঝোলানো ছিল! এতটাই চমকে উঠেছিলাম যে আর একটু হলেই ক্যামেরা সমেত আমি খাদের অতলে চলে যেতাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মহারাণীর মতো পা তুলে একটা বড় পাথরে গা এলিয়ে তিনি বসে রয়েছেন। আমাকে তাকাতে দেখেই,
-চলে আসুন এখানে! উপরে উঠুন। সামনের পাহাড়ের ভিউটা আরো ভালো পাবেন।
উঠলাম পাথরটায়। বসলাম কিছুক্ষণ। একফুটের মধ্যেই বসে আছি দুজনে দুদিকে তাকিয়ে। নিশ্বাস প্রশ্বাস এর শব্দ ঝিঁঝি আর কান কটকটির ডাক চাপা দিয়ে শোনা যাচ্ছে। কোন কথাই নেই। তিনি চকলেট চিবিয়ে চলেছেন। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল। এক ঝটকায় পাথর টা থেকে নেমে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে একটা চকলেটের টুকরো এগিয়ে,
- এবার এখানে বসে সিগারেট খান যত মন। তবে শেষ হলে চকলেট টা খেয়ে নামতে শুরু করবেন।
হতচকিত আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই দেখলাম আমার সামনে থেকে দশ পা দূরে, পিছন ফিরে পনিটেল দুলিয়ে হেঁটে চলেছে, সামনে ঝুঁকে। ভাবলাম, থাক। নীচে নেমে তো দেখা হবেই। ফিরে এসে রিসোর্টে ওদের গ্রুপের কাওকেই দেখতে পেলাম। ওরা নাকি একটু আগেই ফিরে গেছে। কোথায়? জিজ্ঞাসা করব একবার ম্যানেজারকে! নাম-ঠিকানা তো ওর না হোক ওদের কারোর না কারো তো পাওয়া যাবে! থাক। পরে ভাববো। পরে না হয় আলাদা করে জেনে নেব অফিস থেকে।
আবার অন্য কোথাও!!
তিনদিন হাঁটা হয়ে গেছে। আজ চতুর্থ দিন। আজ হাঁটা একটু কম। কিন্তু প্রথম সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা জুড়েই শুধুই চড়াই। প্রতি দুটো টার্ন ঘোরার সাথে সাথে রাস্তা এক ধাক্কায় প্রায় কুড়ি পঁচিশ ফুট উঠে যাচ্ছে। এরফলে আমার মতো শখের হাঁটতে যাওয়া পাবলিককে বেশ ভুগতেই হচ্ছে। ভারী রুকস্যাক ততোধিক ভারী নিজে সমস্ত সাজ সজ্জা সমেত বেশ কসরত করতে হচ্ছে। এদিনের সমস্ত রাস্তাটাই প্রায় পাহাড়ের মাথায় মাথায় রাস্তা যার ফলে ঠান্ডা হাওয়ার দাপট সকাল থেকেই বেশ ভোগাচ্ছে আমায়। ছোট খাঁজ পা পাহাড়ের কোল অনেক দূরে একটু পেলেও দাঁড়াতে অসুবিধা হচ্ছে তাই খুব আস্তে আস্তেই হেঁটে চলেছি। জানি শুধু আমায় বিকাল অবধি শেষ বেশ ক্যাম্পে পৌঁছাতে হবে। এবার আমার সঙ্গে দুই ভাইজিও ছিল এই ট্রেকে। তারা বেশ একটু আগেই হাঁটছে প্রথম দিন থেকেই। কোন কোন জায়গায় ওরা দাঁড়িয়ে থাকলে মাঝে মাঝে দেখা হচ্ছে। একটু থেমে নাক মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে একটু জল, একটু মধু আবার একটু জল এবং শেষে একে অপরকে উৎসাহ দিয়ে আবার শুরু করছি। এই ক দিনে সিগারেট খাওয়ার সংখ্যা কমে গেলেও একেবারে থামে নি। আগের দিন হাঁটার সময় বুগিয়াল গুলো পেরুবার সময় বেশ কয়েকটা সিগারেট মনের আনন্দে খেলেও আজ এখনো একটাও খাই নি। অনেকক্ষন মনটা কি যেন একটা করিনি করিনি মনে হচ্ছে। এদিকে হেঁটেও চলেছি। একহাত রাস্তার ধারে একদিকে অতল খাদ আর অন্যদিকে বুক ঠেকে যাওয়া খাড়া পাহাড়। এরই মাঝে মাঝে একটা দুটো পাথর আড়াআড়ি ভাবে জায়গাটা একটু প্রশস্ত করেছে যেখানে রাস্তা থেকে আড়াল হয়ে দুজন দাঁড়ানো বা একজনের বসা যায়। বেশ কিছুক্ষণ একদমে উঠে চলার পর এরকম একটা জায়গা দেখে পিঠের রুকস্যাক সমেত পাথরের খাড়া দেওয়ালে হেলান দিয়ে অল্প একটু বেরিয়ে থাকা পাথরে বসলাম। প্রায় একমিনিট লাগে আমার সাধারণত দম ফেলা শেষ করে সুস্থির হতে। হলাম। এবার এক ঢোঁক জল গলায় দেওয়া মাত্র মন-প্রাণ পুরো জুড়িয়ে গেল। ভালো। সানগ্লাস খুলে আর কিছু সময় বসে একটা সিগারেট ধরাবো আর মন ভরে দূরে পাহাড়ে সূর্য ডোবা দেখবো ভেবে রুক স্যাকের সাইড পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করলাম। মুখে সিগারেট নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসেই আছি। সামনে দিয়ে ছোট ভাইজি পেরিয়ে গেল। ও আর একটু উঠে তারপর বসবে। এমন সময় লাইটারটা জ্বালিয়ে সিগারেটটা শুধু ধরিয়েছি,
- লাইটারটা একটু দেবেন, আঙ্কেল!
চমকে উঠে লাইটারটা হাত থেকে পরে যায় আরকি! কোথা থেকে কে বললো দেখতে ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখলাম, আমার প্রায় মাথার উপরের খাঁজে পাথরে গা এলিয়ে তিনি বসে আছেন। খুব বেশী হলে বাইশ-তেইশ বছরের একটি মেয়ে। হাতে জলের বোতল আর পিঠে রুক স্যাকের বদলে ছোট ন্যাপস্যাক।
-সামনে দাদা যাচ্ছে, আর পিছনে বাবা আসছে। একটু তাড়াতাড়ি দিননা লাইটারটা। সকাল থেকে একবারও আলাদা হতে পারিনি।
চুপচাপ কোন কথার উত্তর না দিয়ে লাইটারটা এগিয়ে দেবার সময় শুধু জিজ্ঞাসা করলাম,
-সিগারেট লাগবে?
-না না! সিগারেট আছে। লাইটারটাও ছিল। কাল রাত্রে বাবা টেন্টে দেখতে পেয়ে ফেলে দিয়েছে।
তারপর প্রায় দু মিনিট কোন কথা না বলে, কোন দিকে না তাকিয়ে শুধু সিগারেটের টান দেখলাম। বুঝি। এরকম পাগলের মতো টান দেওয়া জানি। ধোঁয়া বেরুবার আগেই আর একটা টান দেওয়া। কোনরকমে শেষ করেই হাতের বোতলের জল নিয়ে কুলকুচি করতে শুরু করলো। তারপরেই পকেট থেকে অনেকগুলো চকলেট বের করে একটা মুখে পুরে আর দুটো আমার হাতে দিয়ে উপরের পাথর থেকে প্রায় লাফিয়ে নিচে রাস্তায় নেমে,
-শুরু করি আমি আবার। বাবা আসছে। দেখা যাচ্ছে। পরে আবার ক্যাম্পে দেখা হবে। লাইটারটা আমার খুব দরকার! সমস্ত ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো যে আমি নিজের সিগারেটটা টান দিতেই ভুলে গিয়েছিলাম। প্রায় শেষ দিকে দুটো টান দিয়ে ফেলে আবার জল খেয়ে হাঁটা শুরু করতে যাবো এমন সময়ই একজন ভদ্রলোক সামনে দিয়ে বেশ ধীর পদক্ষেপে পেরিয়ে গেলেন। আমিও উঠলাম। বিকালে আমাদের টেন্টের ধারে আরো পাঁচ-ছটা টেন্টের সবাইকে দেখলেও ওদের বা ওই মেয়েটিকে দেখতে পেলাম না। এটাই শেষ ক্যাম্প সাইট। কাল সকালে শেষ পিক ঘুরে নীচে নামার দিন। তাহলে কোথায় গেল, কোথায় টেন্ট ফেললো? না, পরের দিনও দেখা পাইনি। হওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি! একটা জলজ্যান্ত মেয়ে আর তার বলা কথায় তার দাদা আর বাবা, কোথায় গেল! একটাই রাস্তা, একটাই ক্যাম্প সাইট, একটাই গন্তব্য- কিরকম অদ্ভুত ব্যাপার! ছোট ভাইজিটা মাঝে মাঝে আমার সাথে মজা করে অনেক কিছু নিয়ে। ওকে বললাম নামার দিন। ও তো রীতিমত অবাক হয়ে গেল আমার কথা শুনে। ও তো সেদিন কাউকে ওকে টপকে এগিয়ে যেতে দেখেনি। এমনকি এও বললো যে সেদিন ওর পরে পরেই আমি ই পৌঁছেছি। আর বেশি কথা বাড়ালাম না। চুপ থাকাই ভালো।
*** আসলে লক ডাউনে বসে আছি প্রায় দশ দিন পেরিয়ে যেতে চলেছে। বাড়িতে আনা সিগারেটের সংখ্যা ক্রমশ নিম্নগামী। এসবই ভাবতে ভাবতে আজ দুপুর থেকেই জীবনে সিগারেট নিয়ে কি কি কান্ড ঘটেছে সেসব ভাবছিলাম। এরকম অনেক ঘটনাই ঘটেছে আমার সাথে। আরো বেশ কিছু মজার ঘটনাও ঘটেছে। দেখা যাক, কতগুলো বলা যায়, কতগুলো ভাগ করে নেওয়া যায়! তাই এই লেখা শেষ নয়। পর্ব ভাগেই থাকুক। বাকি মন হলে পরে লেখা যাবে না হয়!
*** ছবিটা বিধিসম্মত সতর্কীকরণ মেনেই দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট করে ব্যস্ত করবেন না। গালাগাল নিয়ম মেনেই দেবেন।
03.04.2020



Comments

Popular Posts