একবার ঈশ্বর হলে কেউ আর আদরে ফেরে না...

 



মে মাসের শেষ দিকে গরমের ছুটির সময় গ্রামের বাড়ী গেলে সারাদিনই বাইরেই কেটে যেত। সেই সময়ে খেলায় মত্ত আমি যদিও প্রকৃতির দিকে ফিরেও তাকাইনি, কিন্তু প্রকৃতি সেদিনও আমার সাথে সাথেই পথ চলেছে আর আজও ফিরিয়ে দেয় সেই দিনের স্মৃতি। আজ যখন ফিরে যাবার কথা ভাবি তখন শুধু সেই দিনের কথা মনে পড়ে যায়। সারা দুপুর জুড়ে আমবাগানের পাশে আমপুকুরে আমি একবারের জন্যও মাছেদের খেলা না দেখলেও আজ মনের অতলে হাতড়ে পাই সেই ফিঙে, চড়াই, শালিক আরো কত নাম না জানা পাখিদের কিচির মিচির। কখনোই একবারও কিটসের মতো মনে হয় নি গ্রীষ্মের প্রখর তাপে বাংলার সব পাখিরা গান গাইতে ভুলে গেছে!
ফিরে যেতেই হয় আমাদের। ফিরে যাবো একদিন জেনেও আমরা সামনের দিকে দৌড়ে যাই। আমরা সবাই যে চাইলেই ফিরতে পারি তেমন নয়! কেউ কেউ তো আমরা ফিরে যাবার রাস্তা আর সময় দুটোই হারিয়ে ফেলি। তবে আমাদের মধ্যেই থেকেই তুমি যখন এই ফিরে যাবার রাস্তা মনে রাখতে পারো, শুধু নিজে মনে রাখ তা নয়, আমাদের অনেকের কাছে পৌঁছে দাও সেই ফিরে যাবার রাস্তার দিকনির্দেশনা, তখনই মনে হয় তোমার লেখার সার্থকতা।
'মহাশয়, আমি চাক্ষিক! রূপকারমাত্র'। মনে পড়ে বীরভূমের সেই আধ-পাগল, প্রকৃতি প্রেমে মগ্ন রামকিঙ্করকে! শুধু দু চোখে প্রকৃতিকে শুষে নিতে চেয়েছিল। আর সেই দেশেরই কবি হয়ে কি তার বাইরে যেতে পারে! নিজে দেখার সাথে সাথেই আমাদের দেখিয়েছে কবি তার সেই ফেলে আসা প্রকৃতি, যার প্রতিটি রূপ, গন্ধ, অনুভূতি যা সে বয়ে এনেছে তার গ্রাম থেকে আমাদের এই ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলের শহরে যেখানে কবি বাধ্য হয় দিনযাপনে। প্রায় এক নিষ্ঠ ধার্মিক আচরণ শুধুমাত্র প্রকৃতির প্রতি কবির রোমান্টিসিজমের কথা বলে না, বলে চলে এক চরম বাস্তবের গল্প যা আমার-তোমার, অনেকেরই। রামকিঙ্কর নিজেকে বলেছিলেন, 'শাব্দিক নই'। ' ট্রামের শব্দ, মোটর, ট্রাক, ট্রেনের শব্দ, কারখানার শব্দ, মানুষের কোলাহল- এসব শুনেও আপনারা আরও শব্দের জন্য পত্রিকা ছাপেন? আপনাদের ধৈর্যের কী বলিহারি!' বার বার ফিরে যেতে চেয়েছেন 'সাইলেন্সরের' যুগে। আর এই কবি নিজে 'চাক্ষিক' হয়ে আমাদের শাব্দিক অনুধাবনে বাধ্য করেছে। তার নিজের তৈরি শব্দমালারা কখন আমার শব্দে রূপান্তর ঘটেছে আর সেই প্রতিটি শব্দে কেমন করে আলাদা আলাদা ছবির রূপকথারা জন্ম নিয়েছে তা পাঠকও বুঝতে পারে না।
উৎপল দত্ত 'শেক্সপিয়ার ও ব্রেখট' নাটকে খুব জোরের সাথেই আমাদের শিখিয়েছিল, "অতএব শুধু চেয়ে থাকা নয়, শেখো কেমন করে দেখে।" সত্যিই আমাদের 'দেখা' শিখতে হয়, তাকিয়ে থাকা যে দেখা নয় তা বুঝতেই অনেক সময় চলে যায়। কবি আমাদের তার কাব্যে আমাদের দেখতেও শিখিয়েছে হাতে ধরে, নিজের মত করেই। 'বিকালের ট্রেন' 'মোরাম বিছানো পথ' ধরেই চলে আসতে হয়েছিল যখন, ফেলে আসতে হয়েছিল পথের পাশে 'শ্যাওলার দল', 'শালুক', 'মগ্ন প্রজাপতি', 'বসন্তবৌরি', 'শিউলি', 'জারুলের ফুল', 'কদম্বের বন'। গ্রাম আর শহরের শেষ সংযোগ রেখে যাওয়া সেই 'বৃদ্ধ চাওলা' সেদিনও ছিল, আর আজও আছে। কবি-অস্তিত্ব, কবি-জীবন নিপাট কাব্যের কথা বলে না, মনে করিয়ে দেয় 'মানুষের অস্তিত্বের কথা যা পৃথিবীর সমস্ত সমস্যা আর ভাবান্তরের চরিত্র'। ব্যক্তি অস্তিত্বের কথা সীমা ছাড়িয়ে যখন জীবনের অর্থ খুঁজে চলে, তখন কবি-মানুষ পাঠকের নিজের হয়ে যায়। পাঠক তখনই চায় কবির গল্পে নিজেকে দেখতে বা কবির চোখেই নিজের জগতের ব্যাখ্যা। অস্তিত্ববাদের এক প্রাথমিক শর্ত হল 'একাকিত্বের সততা', যা কবি আমাদের অনুভব করায় তার কাব্যগ্রন্থের প্রতি পাতায়। 'শামুকের চলাফেরা', 'ফড়িংয়ের উড়ে যাওয়া', 'আল পথে সাপিনী' তোমায় একলাই অনুভব করতে হয়। কোথায় আমার সেই ক্ষমতা যে এই দৃশ্যপট যা গ্রামবাংলার প্রতি মাঠে-ঘাটে প্রতিনিয়ত জন্মায় তাকে ভেঙে বেরিয়ে আসবো! কিটস যখন কবির সাথে প্রকৃতির 'কল্পিত পরিচয়' বলতে পরিচিত গাছ ফল পাখিদের সাথে তীব্র 'স্বতঃস্ফূর্ত শারীরিক সম্পর্কে'র কথা বার বার বলে চলে তখন বুঝি কবির বাধ্যবাধকতা। কবির কাছে প্রকৃতি তো আমার মতো দু-টাকার টিকিট কেটে পাহাড় দেখতে যাওয়া নয়। প্রচন্ড ভাবে এক শারীরিক আর মানসিক সেই বন্ধন যে রাজ্যে আমরা কবিদের হাত ধরেই পৌঁছে যাই।।
বিশ্ব সংসার যখন এক বিপরীত ডিকটাম এর দ্বন্দ্বে নিয়ত জীবনের গল্প বলে চলে তখন কবি কিভাবে তার বাইরে থাকতে পারে। 'হরিণীর সুনিশ্চিত চোখ' আর 'উদাসীন হরিণ শাবক' একদিকে যেমন মা-ছেলের সম্পর্কের কথা বলে অন্যদিকে সময়ের সাথে বদলে যাওয়া জীবন অস্তিত্বের কথা বলে। 'ছাতিমের ঘ্রান' রূপকথার গল্প শোনালেও 'মাংস রন্ধনের গন্ধ' বাস্তবের রবিবারে নামিয়ে আনে পাঠকের উড়ে চলা মনকে।
'যুক্তিসঙ্গত বিচার এই অযৌক্তিক মহাবিশ্বে'র ভাবনা আসলে কাব্যগ্রন্থের পাতা জুড়ে। শুধু বিষয়বস্তু নয়, অভিনয় করে যাওয়া জীবন, অনুভব করা জীবন, এককথায় বেঁচে থাকা জীবনের গল্প বলে চলে কবি অক্লান্ত ভাবে। 'অস্তিত্বের নিহিলিজম' ভাবায় না কবিকে। কবির কাছে 'এক মানুষ বা সমগ্র মানব জাতি সবই খুব তুচ্ছ যদি না তার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য সময়ের সাথে বদলে যায় তার অস্তিত্বের সংগ্রামে'। তাই বার বার কবি 'অস্তিত্বের সংগ্রাম' তুলে এনেছে তার প্রতিটা শব্দে।
কাব্যগ্রন্থের পাতা জুড়ে আছে গাছেরা। গাছ আর পাখিদের উৎসর্গীকৃত কাব্যগ্রন্থ হতেই পারত। প্রকৃতির এই রূপ যা গাছের শ্রেণীবিভাগ করে পাঠককে শিখিয়ে দেয় আমি আর আমার মানসিক গঠন কেমন করে গাছেদের পৃথিবীতে এক হয়ে গেছে। 'গাছের বিষাদ' এর কথা ভাবায় আমাদের। 'পাতা ঝরানো' গাছ কেমন করে বাকি দিনগুলো কাটায় খোঁজ রাখি না আমরা! এই গাছই হয় একদিন 'বজ্রাহত' আর একদিন 'স্বজনহীন'। তার কষ্টের দিন চেনায় কবি আমাকে। তাই কখনো সে,'পাতার বৈভব খসিয়ে আসবাব হয়ে যাওয়া গাছ', কখনো কষ্টে 'আনত' আবার কখনোবা 'অসুখে জেগে ওঠা গাছ'। গাছেরা যেন কবির সেই ছোটবেলার বন্ধুরা। সেই গাছকে কবি যেমন আষ্টে- পিষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বাঁচে, তেমনি 'মাটির সংসার তছনছ করে জল তুলে আনা গাছ' কে মনে করিয়ে দেয় যে 'মাটির অন্তরে শুধু শিকড়ের অধিকার'। এই 'মাটি'ও যে কবির সেদিনের বন্ধু, আপনার জন। গাছের কষ্ট, পাতার নিঃসঙ্গতা কেমন এক বাক্যে সমাধানের পথ খোঁজে, 'যদি কোনদিন একটি প্রাণবন্ত পাতা মাঝরাতে চুপিচুপি ফিরে আসে গাছে...' উত্তর খুঁজে পায় না।
কবির আদি মনস্তত্ব আর চরমতম মানসিক অবস্থানের ধারক 'পিতামহ কাক' যার কাজ কবিকে মুক্তি দেওয়া এই নশ্বর পৃথিবীর জাগতিক বন্ধন থেকে। 'প্রস্ফুটিত কলমি ফুলে মাথা রেখে তৃপ্ত জল ঢোঁড়া শুয়ে আছে রোদে'। শুধু এই একটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ছবি কবিতাজুড়ে কত ছবির জন্ম দেয়। চিরাচরিত ছবি হয়ে ওঠার সব ধারণাকে বার বার আঘাত করে কবি যে টুকরো টুকরো ছবির জন্ম দেয় তা সবই ভিন্ন আবেগের প্রকাশ ঘটায়।
টি.এস এলিয়ট 'অবজেক্টিভ কোরিলেটিভিটি' র ব্যাখ্যায় কবিতায় আবেগের আনাগোনা এক অন্য মাত্রায় তুলে ধরেছে। একটা নিয়মের ছবি, কাজ, সময়, বা এক মালায় গাঁথা ছবির সারি যা নির্দিষ্ট কোন আবেগের জন্ম দেয় পাঠকের মনে কিন্তু তা কখনোই পাঠকের আবেগের নামকরণ করে না বা বলে দেয় না নির্দিষ্ট কোন আবেগের নাম।
'শিয়াকুলের ঝোপ', 'জল থৈ থৈ পদ্ম পাতা', 'ক্ষুধা গ্রাস করা আদিগন্ত খেত', 'শিশিরের আহ্বান' তাই কবির তৈরি অনেক ছবির জন্ম দিলেও 'মেঠো ইঁদুর', 'আল কেউটে', 'ক্ষুধার্ত বক আর মাছ', 'সুবর্ণ গোধিকা' আমায় অনেক নাম-নাজানা আবেগের সামনে হাজির করায়। এলিয়ট যখন বলে 'আবেগের পরিবর্তন শুধু অভিব্যক্তির প্রকাশে নয়, অন্তরের অনুভূতি আর বাইরের সমন্বয়ে' তখন পাঠক কবি সৃষ্ঠ এক ছবির ব্যাখ্যা নিজেই করে, নিজের সাথে অনেক দ্বন্দ্বের পরে। নিজেকে মনে করতে পারে,'তৃপ্ত বাঘের মতো শান্ত সমাহিত'। পাঠকের মনে ধাক্কা দেয় কবির দর্শন, কবির জীবনবোধ,
'মানুষ বড় হলে, বিস্ময় ছোট হয়ে আসে...'

কেট রিগবি 'রোমান্টিক ইকোক্রিটিসিজম' বর্ণনা করতে গিয়ে 'মোর-দ্যান-হিউমান ওয়ার্ল্ড' এর কথা বার বার বলেছে, যা ছাড়িয়ে মানুষ সাড়া দেয়। প্রকৃতির বিভিন্ন মাত্রার কথা মানুষকে বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে। এই পৃথিবীকে সাস্টিনেবল করতে আমাদের আগামী অভিমুখ হবে 'না-মানুষের পৃথিবী'। 'পিঁপড়ের দল', 'তৃপ্ত সাপ', 'ঝিঁঝি পোকা' শুধু এই পৃথিবীর কথাই বলে না, যোগাযোগ ঘটায় আমাদের এই দুই পৃথিবীর।
'লবঙ্গের অরণ্য' জুড়ে যে 'নির্জন কুয়াশা', তাতে 'শোকাতুর মেঘ' পায়চারী করে বেড়ালেও 'দুগ্ধবতী ধান' আর 'খেজুর রসের সুগন্ধ' আজও গ্রাম বাংলার সুখ-শান্তি-স্বস্তি উপচে পরার ছবি আঁকে আমাদের মনে। গ্রামীন সংস্কৃতি যা আজও আমরা বয়ে চলেছি আমাদের শিরায়-উপশিরায়, কবি সেই ছবিই এঁকেছে তার কাব্যগ্রন্থের পাতায়। 'প্রকৃতি সর্বদা সাংস্কৃতিক ভাবে নির্মিত' আর এই নির্মাণের ধারা বয়ে নিয়ে যায় যে কথক তার সৃষ্টিতে, সেই তো যুগ অতিক্রান্ত সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
বেটি 'রোমান্টিক ইকোলজি'র বিশ্লেষণে বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, 'প্রকৃতি একটি মাত্রা যার প্রয়োজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর প্রত্যাখ্যাত'। এই 'প্রত্যাখ্যাত' চলে কবির জীবনভর। 'আমাকেও কতজন যে আধখাওয়া ফেলে রেখে গেছে কতবার', কবির আক্ষেপ নয়, জীবন সংগ্রামের গল্প। আর কবির 'প্রতিদ্বন্দ্বী' তো কবির দুই জীবনের বেঁচে থাকা- নাগরিক কবি কেমন করে ফিরে যাবে তার গ্রামীন বন্যতায়! আবেগের বহিঃপ্রকাশ না হয় বন্ধই থাক। আগে তো প্রকৃতি বাঁচুক। তার পর না হয় রোমান্টিসিজম এর গল্প করা যাবে।

গ্রেগ জেরার্ড এর আদিকথা 'ক্লাসিক প্যাসটোরাল' যার মূল বৈশিষ্ট্য হল নস্টালজিয়া। কাব্যগ্রন্থের অর্ধেকের বেশি জায়গা জুড়ে থাকা কবির ফেলে আসা সেই দিনের প্রতি হাহাকার। যা চলে গেছে একবার জীবন থেকে তার স্মৃতি রোমন্থন যা অতি আদরের বা ভালোবাসার। জোর দিয়েছে সেই পুরোনো ছবি জুড়ে থাকা 'মা', বহুদিন দূরে থাকা একাকিত্বের যন্ত্রনা যা ফিরিয়ে দেয় সেই পুরোনো ছবি যেখানে কবি আর পাঠক দুজনে দেখতে পায়,
'মায়ের আঁচল নিয়ে পায়ে পায়ে ঘুরছি সবখানে'।
এই ছবি তো সবার, সবাই চেনে 'মা'কে, শুধু শব্দে ধরে রাখে কবি। মা মানে যেখানে 'সদ্য স্নান সেরে মা পেতলের রেকাবে একে একে গুছিয়ে তুলছেন উপাচার', সেখানে বাবা তো 'বিষণ্ন মেঘের মতো একটি ছাদ অবিরল ভিজতে থাকে...' যাকে লোকে 'বাবা বলে ডাকে'। আর রবিবার এলে ছেলের মাংস খাওয়ার সাথে নিজের সময়ে ফিরে যাওয়া যখন আমরা প্রায় সবাই মাংস খাওয়া আর হাতে চাঁদ পাওয়া একই মনে করতাম। কবিতার ছত্রে ছত্রে দেখা দেয় সম্পর্কের নানা টানা-পোড়েন। গটফেলট্রি এই 'ক্লাসিক নস্টালজিয়া'র ধারাকে এক 'হেটেরোজেনাস মুভমেন্ট' বলে মনে করেছে, কবি তখন তার 'প্রকৃতি' নির্বিঘ্নে চলা এক সাদৃশ্যপূর্ণ অস্তিত্বের কথা বলে। 'প্রাচীন বট', 'মাটির ঘোড়া', 'কুমোর গৃহিণী' শুধুই নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত কবির শব্দ রচনা নয়, প্রতিটা শব্দ আলাদা আলাদা ভাবে কবির 'আইডেন্টিটি' তৈরি করে, যার কোন 'ক্রাইসিস' কবির কখনোই হয় নি। কাব্যগ্রন্থের পাতায় কবি তার শক্ত পা ওই মাটির নিচে চালনা করা শেকড়ের মতোই ছড়িয়ে দিয়েছে।

কবির প্রকৃতিমগ্নতা যেন প্রেমিকের রূপ নিয়েছে কাব্যগ্রন্থ পাতায় পাতায়। এ প্রেম আবেগে শারীরিক না মানসিক তার দ্বন্দ্ব চিরকালীন। তবুও কোথাও যেন এক সীমা টানা আছে। 'ধানের শরীর', 'ভাতের সুগন্ধ', 'যৌবনবতী লাউ', 'ক্ষুধার্ত ঘাস' শরীরের কথা বললেও কবির 'গৃহস্থ চড়ুই' আর 'নিরীহ পুরুষ' বার বার সোচ্চারে ঘোষণা করে, 'আমাকে জাগাও প্রিয় কামগন্ধহীন...' ভালোবাসার উদযাপন নয়, ভালোবাসায় থাকা কবি বড়ই অবলম্বনহীন। কঠিনতর বক্তব্যে ভালোবাসার শীতলতার কথা,
'দুজনের মাঝখানে সাপের মতো দীর্ঘ শীতকাল ঢুকে পড়ছে নিঃশব্দে...'
শোক জর্জরিত এই পৃথিবীর শেষ আশ্রয়স্থল তো ছেড়ে যাওয়া মানবজমিনের পরের স্তর, যেখানে থাকে না আর দুঃখ, কষ্ট, গঞ্জনা, রাগ, রোষ, ঘৃণা, বিদ্বেষ। কবিরা মনে হয় মানসিক স্থিতি উপলব্ধি করতে পারে। তাই তো সোচ্চার ঘোষণা,
'সকল শোকের মাঝে আমি যে অশোক'।
ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। সব কাজ ফেলেই ফিরে যেতে হবে। অনেক, অনেক দিন পেরিয়ে গেছে এই না-কাজের অভিনয়ে। এই বিশ্বের নতুন প্রজন্মের বাঁচার রসদ জোগাড়ের নিমিত্তে কবিকে ফিরতেই হয়। সেই 'বিজন স্টেশনে বিকেলের শেষ ট্রেন' থেকে নেমে 'গোধূলি আলোয়' 'দারুচিনি অরণ্য' একপাশে ফেলে রেখে 'অমলতাসের ছায়াঘেরা' রাস্তা ধরে কবি হেঁটে চলেছে যে পথে একটু আগেই 'দুপুর বালক', 'গ্রামীণ ভিখিরি' 'বাউলানি ধুলো' উড়িয়ে ফিরে গেছে।
কবি ফিরে চলেছে মায়ের কাছে।

লকা কে মনে আছে? চরাচর এর লকাই! বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চরাচর! শেষ দৃশ্য আর তার আগের দৃশ্যের লকাই আর তার বউয়ের শেষ কথোপকথন:
- তুমার দিন ক্যাটবে ক্যামন করে?
- এই বাদা আছে, বিল আছে, আকাশ আছে, পাখি আছে, তারা আমারে ঠিক বাঁচায়ে রাখবে। একটাই তো জ্যেবন, ঠিক কেইটে যাবে!
এর পরেই শেষ দৃশ্য। লকাই ঘুম থেকে উঠছে। তক্তপোষ জুড়ে শুধু পাখি আর পাখি, গোটা ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে সব পাখিরা, কেউ ওর কাঁধে বসেছে, কেউ গায়ে বসেছে। খালি গায়ে, লুঙ্গিটা মালকোচা বেঁধে লকাই একটু উঠে বসে দেখে তার সারা ঘর জুড়ে পাখিরা। লকাইয়ের পাখিরা লকাইয়ের সাথে থাকতে এসেছে। ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র আর তার পাড় জুড়ে পাখিদের বিচরণভূমি। দুহাত বাড়িয়ে লকাই ছুটে যায় ওদের দিকে। লকাই জানে এখন ও কি ভাবে জীবন কাটাবে। বাঁচতে লকাইয়ের কি লাগবে, তা লকাই ই ভালো জানে, বাকিরা তো পার্থিব চারণভূমির মাপকাঠিতে লকাইকে মাপতে যায়!

কেন এরকম এক ছবির শেষ দৃশ্যের কথা আমি ভেবে চলেছি। আসলে ছবি দেখা আর কবিতা পড়া আমার কাছে এক অন্য অনুভূতির স্বাদ দেয়। মন ছুঁয়ে যাওয়া কিছু ছবি আসলে এক নতুন কবিতার জন্ম দেয়। আর ঠিক তেমনই কিছু কবিতা নতুন করে মনে ছবির জন্ম দেয়। নির্দিষ্ট কোন ছবি নয়, এ যেন এক ছবির সিরিজ। দূরে রেল ভ্রমনে যে একটার পর একটা দৃশ্যপট সৃষ্টি হয় আর পরক্ষনেই তা মিলিয়ে যায়, কিন্তু যাত্রা শেষে এক অনুভূতির রেশ থেকে যায় যা কখনোই মিলিয়ে যায় না। এমনই এক কবিতার বইয়ের কথা আমি লিখছি। একটা কবিতার বই বিশেষ করে তা যদি কবির প্রথম বই হয়, তাতে অনেক কিছু চাওয়া বা না-চাওয়ার গল্প তৈরি হয়ে যায়। কবির ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কবির সংবেদনশীল মন, ব্যক্তি-কবি আর দূরের পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-মানুষ, কবির সৃষ্ট গল্প আর পাঠকের মনস্তত্ব বিজারিত কবি সব এক হয়ে যায় যে কলম এই কাব্যগ্রন্থের জন্ম দেয়। তাই এই শাব্দিক মানুষকে পাঠক শুধু কবি মানুষ বলেই জানে। ঈশ্বর নয়, কবি, শুধু কবি মানুষ হয়ে থেকে যাও আমাদের ঘরে। ভালোবাসায় থাকো, আদরে থাকো।


এরপরে আর না লিখলেও চলে যে কথা:
**এরকম এক লেখার সাথে এরকম এক ছবি কেন? এই কাব্যগ্রন্থটি আমি সেদিন দুপুরে একটানা যখন পড়ে চলেছি, ঠিক তখনই আমাদের জানালায় ওনাদের আবির্ভাব। একা নয়, দল বেঁধেই এসেছিল। আসে মাঝে মাঝেই। আসলে আমাদের বাড়িতে বেশ প্রশ্রয় পায় কিনা! সকালে যখন আসে, তখন বড় আয়নার দখল নেয়। সামনে বসে কত ভঙ্গিমা! এদিন দুপুরে যখন এলো, তখন জানলা বন্ধ ছিল। এপাশে আমি পড়ছিলাম। সারা জানলাময় কিছুক্ষন ঘোরা-ঘুরি করে তারপর উড়ে গেল। ওদের দেখেই আমার লকাইয়ের কথা মনে পড়ল। তাই ভাবলাম কবি না থাক, কবির কাব্যগ্রন্থের সাথে ওদের ছবি থাক। কবি তো প্রতি ছত্রে ওদের কথা লিখে চলেছে। তাই কবির সৃষ্টি আর কবির মানসচারনের ভালোবাসারা একটা ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা করলাম!
**একটু নিজের কথা: প্রায়শই একাদশ শ্রেণীর ক্লাসে রোমান্টিসিজম/রোমান্টিক কবিতা বোঝাতে গিয়ে প্রথমেই আমায় যেটা করতে হয় তা হল দশম শ্রেণী পর্যন্ত মাথায় ঢুকিয়ে আনা ছেলে-মেয়ের প্রেম/ভালোবাসার জোরাল ধারণাটা একটু লঘু করে দিয়ে তার সাথে একটু বড়ো করে প্রকৃতির ধারণাটা দিয়ে দিতে। আসলে আজন্ম লালিত ধারণা বদলে নিয়ে শুধু গাছ, পাখি বা মাটির পাত্র নিয়ে লেখা কোন কবিতা কি করে তথাকথিত ওদের চেনা-শোনা শব্দ রোমান্টিক হতে পারে, সেটা বুঝতে একটু সময় লাগে বৈকি! এই কাব্যগ্রন্থ যদি আমি ওদের পড়াতে পারতাম বা একটু বুঝিয়ে দিতে পারতাম তাহলে আমার বাকি কাজ খুব সহজ হয়ে যেত। কবিতা অনুভবের আনন্দ থেকে ওরা বঞ্চিত হত না কখনোই। শুধু এই কাব্যগ্রন্থ থেকে আমি বাংলার প্রকৃতি জীবনের এক পৃথিবী গল্প লিখতে পারি, কবি।
**এই লেখায় আমি কবি নিত্যানন্দ দত্ত কে 'কবি' নামেই সম্বোধন করেছি। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ, 'আলোর জখম' প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতা আশ্রম' থেকে জানুয়ারি ২০২০ (মাঘ ১৪২৬) তে। কাব্যগ্রন্থে সংকলিত কবিতার সংখ্যা, কবিতা, প্রচ্ছদ, কাব্যগ্রন্থের নাম, বাঁধাই, প্রকাশনা, ব্ল্যার্ব - সমস্তকিছু নিয়েই আমার অনেক প্রশ্ন আছে। তাতে কি বা এসে গেল! থাক, সব কথা কি শাব্দিক!

Comments

Popular Posts