আহিরকথা (২)

"সাগরসঙ্গমে যাবি? আয়।" #আহিরকথা (২)

বছর শেষ হতে চললো। ২০১৮ শেষ হবে, ২০১৯ শুরু হবে, বদলে যাবে হয়তো জীবনের অনেককিছু। ছোটছোট মুহূর্তের কথা বিস্মৃত হব আমরা। তবুও বদলাবে না তোমার-আমার চার-চল্লিশ এর পদাবলী। (তুমি চার নও আর আমিও চল্লিশ নই- বরঞ্চ তিন-তেতাল্লিশ বললে ভালো হয়)
এবছরের কথা এবছরেই হোক, বাকি বেড়ে ওঠার কথা না হয় পরে কোথাও হবে।

- তুমি চলে এসো।
- যাবো?
- হুঁ, চলে এসো।
- যাবো? আচ্ছা, যাচ্ছি।
- যেতে বলছে। চলো। ( এগুলো আমাদের নয় ওদেরকে বলছে)
এই বলেই সোজা খাটের উপর উঠে দাঁড়িয়ে গেল। দিয়েই ঘুরে সবাইকে বলে দিল, 'চলো। চলো, যেতে বলেছে।'
খেলাটা এই ভাবেই চলছিল। সকাল, বিকাল বা রাত দশটা, যাই হোক, যে সময়ই হোক ভিডিও কল করে কথা বলা চলতে চলতে আমি যদি একবার বলে দি, তুমি চলে এসো, তাহলে তার উত্তর হয় ওই আগের কথা গুলো।
তাহলে কথা শুরু হয় কি করে সেটা ভাবছো! ধরো আমরা কল করলাম, ওকে ফোনে দেখে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম:
- কি করছো?
- জেঠু কই? ( ওর প্রথম প্রশ্ন 'দিদি' কে, 'দিদি' হলো আমার ছেলের মা, আর আমি হলাম 'জেঠু' আর আমার ছেলে হলো সনু দাদা)
এবার আমি মোবাইলের সামনে এলাম যাতে উনি আমায় দেখতে পান। আমাকে দেখার পরেই প্রশ্ন:
- সনুদাদা কই? সনুদাদা কি করছে?
আসলে এই প্রশ্নগুলো ই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসবে। যে স্ক্রিনের সামনে আগে আসবে তাকে বাদ দিয়ে অন্যদের কথা ও ঠিক জিজ্ঞাসা করবে। তাই ওর সাথে কথা বলতে গেলে আমাদের তিনজনকেই কাছে- পিঠে থেকেই কথা শুরু করতে হবে।
কি কথা বলা যাবে! তার কোনো চিন্তা নেই। তুমি যা খুশী কথা বলতেই পারো, কারণ তারপরেই ও সেই কথাগুলোই তোমাকে বলবে সে গোটা কথা হোক আর কয়েকটা শব্দই হোক না কেন!
তা যাই হোক, যেটা বলছিলাম সেটা হলো এই খেলা আর এরপর চলবে না। 'চলে এসো' বললেই ওর উঠে পরে 'চলো, যেতে বলেছে' বলা মনে হয় শেষ হলো। কারণ কাল রাতে কল করার সময় যখন ওকে এগুলো বলছিলাম তখন ওর বাবা-মা ওর এই রাত-বিরেতে 'চলো' থেকে বাঁচতে ওকে শিখিয়েছে, 'তুমি এসো, আমায় নিয়ে যাও'।
ও দেখি আবার তার সাথে যোগ করেছে:
- তুমি এসো, গাড়ী তে করে নিয়ে যাও। দিদিকে, সনুদাদাকে আর ডগিকেও নিয়ে এসো। ( আমার বুলেটটা ও এখন বেশ চেনে, ওদের বাড়ী গেলে ওটা দেখেই বলে জেঠু এসেছে। কিন্তু এটা জানে না, ওইটুকু বাইকে আমাদের এতজনের জায়গা হয় না।)
ডগিটা এখন নতুন যোগ হয়েছে তাই ওকেও নিয়ে এসো। তার কারণ হচ্ছে ও একদিন ডগির সাথে একটু খেলেই বুঝে নিয়েছে:
- ডগি টার মা নেই!
কি বিস্ময়, কতো প্রশ্ন যে আছে এই এতটুকু কথায় যে তুমি না শুনলে বুঝতেই পারবে না যে ও ডগি টাকে বলে:
- ডগি নোং-লা খাচ্ছে, যা, যা!
- এইটা খা, এইটা খা।
- আমি বল খেলছি, ভালো বল।
ডগি যখন খুব একটা কিছু শুনলো না, তখন আবার ডেকে তাকে হামু দেওয়া দেখলে তো তুমিই থাকতে পারবে না।
আসার পর থেকেই ওর নির্দিষ্ট কিছু খেলা আমাদের বাড়িতে আছে এবং ও জানে সেগুলো কোথায় থাকে। সনুদাদার বইয়ের তাকের নীচ থেকে প্রথম বেরোয় হলুদ বাস, পরে খাটের তলা থেকে ছোট বল, আর এদিক ওদিক ঘুরে বড় বল, যেটা ও ভালো বল বলে। তাই ও চলে যাবার পরই আবার ওগুলো ওই জায়গাতেই গুছিয়ে রাখা হয় যাতে ও পরের দিন এসে আবার কাওকে না বলেও খুঁজে নিতে পারে।কিন্তু ওর একটাই আফসোস যে সনু দাদার ব্যাট নেই।
- সনু দাদার ব্যাট নেই!!
আসলে সনু দাদার আর কোনো ছোট ব্যাট নেই ওর খেলার মতো তাই ও মনের দুঃখে বড় বল নিয়েই জলের বোতলগুলোকেই মারে, আর মারা হয়ে গেলেই সেগুলোকে বালতিতে রেখে বলে:
- ফেলে দিয়েছি।
যাবার সময় ওই একমাত্র যদি আমরা ওকে বলি
- আসবে আবার। আবার আসবে।
ও কিন্তু ছোট উত্তরে সেরে দেয় না।
- আসবো আবার? আসবো আবার! আসবো।

ওর মা বলে, ছেলেকে খাওয়াতে কি জ্বালা!
আমি দেখি, শুধু চিকেনে যে ছেলে ভাত খায়।।
ওর বাবা বলে, ছেলেটা বড়ো হয়ে গেল!
আমি দেখি, কই না তো! বেশ তো পুতুল-পুতুল।।
ও বলে, ছেলেটা 'বলো' হয়ে গেল।
জিজ্ঞাসা করলে কোন ছেলেটা, আঙ্গুল তুলে নিজের পেটের দিকে দেখায়।
আমি বলি, এ ছেলে এখন বড়ো হবে কি করে? ওর তো এখনো বাকি ছেলেবেলা। এতদিনে একবারও আমাদের সামনে ঘুমোতে না দেখা ছেলে এবার ঘুমিয়ে পড়লো, সারাদিনের ক্লান্তি আর নাক দিয়ে জল পড়া আর পেটে লাগা নিয়ে:
"এই, ডাঙা কোথায় থাকে?
জলের মাঝখানে।
জলের নিচে কে ঘুমোয়?
আমি।"
তাই? ঘুমিয়ে পড়লো নাকি? ঘুমালো তো! চুপ।
বাবা বললো, পাশে বাঁশি বাজলেও আর উঠবে না!
মা বললো, একটু কাছে কাছে থাক!
ও উঠে বললো, 'ছবি তুলবো, ছবি তুলতে দিচ্ছে না।।'
বাবার মোবাইলে তখনো অবধি শতাধিক ছবি বাবুর তোলা হয়ে গেছে। আর বাবা যখন সনুদাদা কে ছবি তোলা আর তার ক্যারিয়ার নিয়ে কঠিন আলোচনায় ব্যস্ত ও তখনই এই রোগে আক্রান্ত। আমরা হাসবো না কাঁদবো। নাও সামলাও।
যাই হোক, শেষ করি এ বছরের মতো,
- চলে এসো।
- যাবো?
"শৃঙ্খলায় থাকো বুঝি? নীতিকথা বুনছে মোজায়?
সারাটা বিকেলবেলা তোমাকেই কিন্তু ডেকে গেল
সুদূরের সুবচনী হাঁস।
সাগরসঙ্গমে যাবি?
আয়।"

পুনসংযোজন: দরকার নেই, তাও যোগ করলাম। কারণ আমি জানি এই অবস্থাটা আরো কিছুদিন চলবে।
কাল রাত্রে ফোন শোবার আগে। প্রথম দিদির সাথে কথা বলবো বলে মা কে বিরক্ত করল। এর পর ঠিক যে কথাগুলো হল, তা ঠিক চেনা ছকে অচেনা ভালোবাসায়।
ও: দিদির সাথে কথা বলবো।
ওর মা: নাও, দিচ্ছি! দিদি কথা বলছে।
ও: দিদি!
দিদি: বলো বাবা, বলো!
ও: দিদি, জেঠু কই? জেঠু কথা বলবে।
(দিদির সাথে কথা বলতে চেয়ে জেঠু কই! জেঠুর আনন্দ পাবার কিছু নেই, কারণ জেঠু যেই বলতে যাবে 'তুমি চলে এস!' তারআগেই,
ও: জেঠু! ডগি কে নিয়ে তুমি চলে এসো!
(দিদি বাদ। সনুদাদা বাদ। জেঠু আর ডগি! ৩০শে ডিসেম্বর এর রাত, ১০টা!)
যাইহোক, আসলকথা হোল যেটা সত্যিই কেউ বোঝে না, তোর গাওয়া সেই গানটার মতোই:

"ওরা মনের গোপন চেনে না।
ওরা হৃদয়ের রং জানে না।"

এর পরও যখন ওর বাবা ওকে জিজ্ঞাসা করে, 'তুমি মনের গোপন চেনো?'
- মনের গোপন চেনে।
- কে চেনে? 'কুটাই' চেনে?
- চেনে।
সত্যিই, 'মনের গোপন' 'গোল-গোল'ই চেনে। আমরা কি আদেও চিনি?

* এক খাতা 'আহিরকথা' লেখা যেতেই পারে, কিন্তু দরকার কি!
** চারিদিকে রাজার বাবা আর রাজার মা'য়েই সব ফুটেজ খেয়ে যাচ্ছে, তাই ভেবে আমি না হয় রাজার জেঠু হয়ে একটু ফুটেজ খাই।
*** আমায় আজ পর্যন্ত কেউ এতবার জেঠু জেঠু ( যদিও উচ্চারণ টা জেতু-জেতু, তাতে কি এসে গেল!) করে ডাকে নি!


31.12.2018

 

Comments

Popular Posts