আমার 'দুর্গা' এখন স্কুলের দিদিমনি!!

আমার 'দুর্গা' এখন স্কুলের দিদিমনি!! 

#বছরেরপ্রথমদিন।(২)


"বন্ধু চল
রামধনু, ঝালমুড়ি, হাফ টিকেট, আব্বুলিশ
বিটনুন আর চুরমুরের গল্প বল
বন্ধু চল"
না। দুর্গা আমার ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু নয়। তাতে কি আছে! স্কুলজীবন পার করার পর পরই যখন সব বন্ধুরা ছুটে চলেছি কিসের যেন টানে ঠিক তখন আমি 'দুর্গা''র দেখা পাই। ৯৩ সালে আমি রাজ কলেজে পড়তে শুরু করলেও আমি আমার প্রিয় স্যার, সমীরণদার কাছে পড়তে যাই ৯৫ সালের প্রথম দিকে। পার্ট ওয়ানের প্রথম দু বছর আমি কোথাও টিউশন পড়ি নি। তখন আমি পড়া বাদে অন্য অনেক কিছুতে ব্যস্ত ছিলাম। সে গল্প পরে হবে। স্যার এর ব্যাচ ছিল আমাদের খুব ভালো লাগার জায়গা। আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবী সবাই স্যারের কাছেই পড়তো। এখানেই আমি 'দুর্গা'কে প্রথম দেখি। প্রথম দিন দেখার পরই মনে হয়েছিল, 'এএমা! দুর্গা ঠাকুর প্যান্ডেল থেকে নেমে পড়তে এলো কি করে!' একবছর মাত্র আমরা একসঙ্গে ওই স্যার এর ব্যাচে পড়েছিলাম। তারপর আর যোগাযোগ দেখা-সাক্ষাৎ প্রায় ছিলই না। একই শহরে বাস করলেও কোনোদিন দেখা হতো না বললেই চলে। আজ বছরের প্রথম দিন রাজীব-স্বাতী র বাড়ী গিয়েছিলাম আড্ডা দিতে। রাজীব বেরিয়েছিল, আর স্বাতী ওর অনেক বান্ধবীদের সাথে গল্প করছিল। আমি তাই অভ্যাসমতো রাজীবের বারান্দার দিকে যাচ্ছি তখনই সেই ভিড় থেকে 'দুর্গা' উঠে এসে বলে, 'কি রে! চিনতে পারছিস না!' আমি সত্যিই চিনতে পারি নি। ৯৬ সালে সমীরণদার ব্যাচ আর ১৯ সাল এর আজকে, অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। (চিনতে কি পারতাম না? পারতাম ঠিকই। আসলে স্বাতীর বন্ধুদের দিকে না তাকিয়েই চলে যাচ্ছিলাম আর কি!)
- সেই ধপ-ধপে পরিষ্কার ফরসা মুখ যার মাথায় ছিল কোঁকড়ানো কালো চুল, যাকে দেখলেই আমার সেদিন দুর্গা ঠাকুর ছাড়া আর কিছু মনে হতো না, তাকে ভুলবো কি করে!
সমীরণদার ব্যাচ এর একটা নিয়ম ছিল যে স্যার পড়ানোর পর একটা নোটস দিতেন লেখার জন্য আর একটা দিতেন জেরক্স (ফটোকপি লিখলাম না ইচ্ছা করেই! কারণ এই এপিসোডের একটা নাম আছে) করে আনার জন্য। সেই সময় পার্কাস রোডের ধারে-কাছে কোনো জেরক্স এর দোকান ছিল না, আমাদের জেরক্স করে আনতে হতো ইউনিভার্সিটি র কাছ থেকে বা নার্সিং কোয়ার্টার এর কাছে দু-একটা দোকান থেকে। এই কাজ করতাম বা বলা যায় বেশী আগ্রহসহ করতাম আমি আর অজয়। সবার কাছ থেকে টাকা তুলে সবার জন্য এক কপি করে নিয়ে এসে ব্যাচে বেলাতাম। টাকা তোলা ছিল দেখার মতো। তিন পাতা পঁচাত্তর পয়সা করে হলে ক টাকা, তাকে আবার পঞ্চাশ জন দিয়ে গুন করে বেশ জটিল। আরো জটিল করতাম আমরা ইচ্ছা করেই।
- 'পাঁচ টাকা তো দিলি, তার আবার কি ফেরত নিবি খুচরো!' নিশ্চই বোঝা গেল যে কিসের এতো টান ছিল আমার আর অজয় এর এই জেরক্স করাতে। তার মানে এরম ভাবার কোনো কারণ নেই যে সবাই পাঁচ টাকা দিত। ছেলেরা তো পারলে না দিয়ে ঝেড়ে দেয়, দু একটা মেয়ে যখন পারলে দুটাকা পঁচিশ পয়সাই দেয়, তখন দেখেছিলাম 'দূর্গা' কে বলতে,
- 'দে না ওদেরকে। ওই দু টাকায় তোর কি হবে? ওরা যাচ্ছে, করে এনে দিচ্ছে!!'
সাক্ষাৎ 'দুর্গা' ! নিজে তো দিতোই আরো দু একজনকে
দেয়াতো আমাদের দু-পাঁচ টাকা বেশী। এর পর শুরু হতো আমার আর অজয়ের বর্ধমানের সব জেরক্সের দোকান চষে ফেলা। কে পঁচাত্তর পয়সার কমে জেরক্স করে দেবে। এতগুলো পাতা বলে কথা। যাই হোক এতে আমরা মোটামুটি রাধাবল্লভ এর কচুরী আর মিষ্টি খেতে পারতাম দুজনে। আর শেষ অজয় গুটকা আর আমি সিগারেট টেনে ব্যাচ এ ঢুকতাম। নুপুর আমাদের এই স্কিম টা জেনে ছিল, তাই ও নাম দিয়েছিল 'জেরক্স কেলেঙ্কারি' আর আমার আর অজয়ের এমন বন্ধুত্বের নাম দিয়েছিল 'অশুভ শক্তির আতাঁত'। যাক সে সব কথা, সেই মা 'দুর্গা'র মাতৃসম রূপ দেখেছিলাম।
সমীরণ দা আমাদের যা পড়াতেন তাই আমাদের প্রায় সবারই ভালো লাগতো। ওনার প্রতিটা শব্দ চয়ন থেকে উপস্থাপনা ছিল ছবির মতো, ওনার প্রতিটা হাত নাড়া থেকে কথা শেষ করে মিষ্টি করে মাপা হাসি আমাদের এক নতুন ভাবনার জগতে নিয়ে যেত। একটু ভেবে দেখ, যে স্যার এর কথা বলছি সেই স্যারের পড়ানো থেকে সব কিছুর প্রেমে পড়ে আমি বসে আছি, সেখানে বাকি ব্যাচের মেয়েদের কথা। স্যার যদি শেষ লাইন টা বলার পর একটু ছোট পজ, ঘাড়টা তার দিকে একটু হেলিয়ে হালকা হেসে শেষ করেন, তাহলে অনেকেরই সেদিন তার জীবনের স্মরণীয় দিন হয়ে যেত। আর স্যার কি করতেন?
' ম্যাকবেথ ইজ নট ম্যাকবেথ, উইদাউট লেডি ম্যাকবেথ!' বলা শেষ করে মাঝখান থেকে বাঁ দিকে হালকা ঘাড়টা হেলিয়ে, মুচকি হাসিতে প্রথম সারির মাঝখানের চেয়ারে বসা 'দুর্গা'র দিকে তাকিয়ে বলতো-
" কি বলো? তানিয়া!'
আমার 'দুর্গা' র নাম তানিয়া।
ও এখন স্কুলের দিদিমণি। ওকে টোটোওয়ালারা যেখানে খুশী নামিয়ে দেয়। ওকে ওর হেড-এক্সামিনার যা খুশী বলে অপমান করে দেয়। ওর কোন একজন কলিগ নির্দ্বিধায় বাজে কথা বলে চলে। ওর কাছের বন্ধু ওকে ভুল বোঝে। ও কাউকেই কিছু বলে না। এর সব উত্তরই ও একমিনিটে দিতে পারে। যোগ্য জবাব দেবার ক্ষমতা ও গুন সব নিয়েও ও আজও সেই ক্ষমাশীল 'দুর্গা''। ( এখন ও আর দুর্গা র মতো দেখতে নয়, ও চুল সোজা করেছে, মুখটাও কিছুটা পাল্টে গেছে।) সময় অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে, শুধু বদলাতে পারে নি ওর 'দুর্গা' মনটা।
আমি ধন্য তোর মতো বন্ধু পেয়ে।
তুই এরকমই থাক সারাজীবন।
ভালো থাকিস।
তোর জন্য একটা আমার প্রিয় গান, যেটা সেই কলেজে জীবনে শুনে লেনন এর প্রেমে পড়েছিলাম তার কয়েকটা লাইন:
"What would you think if I sang out of tune
Would you stand up and walk out on me?
Lend me your ears and I'll sing you a song
And I'll try not to sing out of key
Oh I get by with a little help from my friends
Mm I get high with a little help from my friends
Mm gonna try with a little help from my friends"
--("With A Little Help From My Friends"- The Beatles)

** ধন্যবাদ রাজীব-স্বাতী কে এরকম এক সন্ধ্যার জন্য। তোদের বন্ধুত্বে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি।
** আজ সন্ধ্যায় আমি আরো দুজনের সাথে পরিচিত হয়েছি আর আরো একজন সেই কলেজের বন্ধুর দেখা পেয়েছি। সে কথা পরে, অন্য কোথাও হবে। আজ শুধু 'দুর্গা' র কথা।
01/01/2019


Comments

Popular Posts