'নন-সেন্স' কথামালা।।(৪) **** তুমি না থাকলে সাহসী জীবন কাটানোই হতো না!

'নন-সেন্স' কথামালা।।(৪)

 

 

তুমি না থাকলে সাহসী জীবন কাটানোই হতো না!

 

 

অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেল। ৮৭ সাল থেকে আজ ১৯ সাল। উইলবাড়ী রোড এর দু-কামরার ভাড়াবাড়ীর জীবনে তুমি প্রথম যেদিন এসেছিলে, সেদিনই মনে হয়ে লেখা হয়ে গিয়েছিল তোমার আমার দীর্ঘ পথ চলার কথা। হয়তো সব দিন, সব সময় এক ভাবে ছিল না তোমার-আমার জীবন চলা, তাও যেন তুমি তখন এনেছিলে এক মুঠো আকাশ। কিছু ঘটনা, কিছু কাজ, কিছু কথা যা সারাজীবন চলতে সাহায্য করেছে, যার উল্টো দিকও আমি দেখেছি। তা সত্বেও আমি জানি, আমার জীবনে তোমার প্রভাব। না, আমি জীবনে কখনো তোমায় আমার ঈশ্বর ভাবি নি কারণ বয়েসের সাথে সাথে আমি ঈশ্বরের অপমৃত্যু দেখেছি, আমি দেখেছি স্বপ্নে দেখা মানুষ, যার মতো হতে চাইতাম আমি, তার দু-পয়সার সম্মান আর ব্যাক্তিস্বার্থে মেরুদন্ড মোচনশীল করে নেওয়া। তাই ওই ঈশ্বর আর না-ঈশ্বরের মাঝে কোথায় একটা যেন সাধারণ হয়েই থেকে গেলে। এটাই আমার পছন্দ। সেদিনের সব কথা আজ আমার সব মনে আছে, এরকম বলবো না। তবে সত্যিই কিছু ঘটনা যা আজকের আমাকে আমি হতে দিয়েছে, সে তো তোমার জন্য। সাহসী হবার সাহস হয়তো তুমিই আমায় দিয়েছিলে। খুব সচেতন ভাবে আমায় দিয়েছিলে তা নয়, আবার এমন নয় যে শুধু আমায় তুমি দিয়েছিলে। সাহস দেওয়া তোমার রক্তে, সেটাই হয়তো আমাকে কখনো চালনা করেছে কখনোবা হতোদ্যম করেছে, তা সত্বেও, তোমার আমার যোগাযোগ থেকেই গেছে।
৮৭ সাল।। কোন এক দিন সকালে কাকুর কাছে এসেছিলে আমাদের বাড়িতে। পরিচিত হলাম বা হয়তো হলাম না, ঠিক ভাবে ভাবলে। কিন্তু সবথেকে বেশী আকর্ষিত হলাম তোমার কালো রাজদূত মোটর সাইকেলটায়। তখন বাবার ছিল বাজাজ প্রিয়া স্কুটার। তোমায় প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম, শেখাবে আমায়? তুমি বেশী কিছু উত্তর না দিয়ে চলে গেলে। অনেক কথা বলছিলে বাড়ীর সবার সাথেই, কিন্তু আমায় আর অতো পাত্তা দাও নি। যাই হোক, কয়েকদিন দিন বাদ একদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরে খেলতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় তুমি এলে। এসেই বললে, 'চাপ'। চাপলাম তোমার বাইকের পিছনে। সোজা বিরহাটা ব্রিজ পার করে পাত্রর নার্সিং হোমের সামনে। বাইক থামিয়ে আমায় বললে এবার তুই চালা। আমি ভাবছি, কি করে চালাবো তাই তো জানিনা। স্টার্ট করা বাইকে বসিয়ে প্রথমে বলে দিল কি ভাবে গিয়ার বদলাবো আর এক্সিলেটার বাড়াবো বা কমাবো আর সাথে ব্রেক দুটো চিনিয়ে দিল। শুরু করতে যাবো, সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট বন্ধ। স্টার্ট দিয়ে এবার শুরু করতে গেলাম, হালকা ঝাঁকুনি, কিন্তু চললো বাইকটা। বেশ লাগছিল। খানিকটা এগিয়েই তুমি বললে বাইপাস ধরতে। ধরলাম। নিজেকে বেশ বড় হয়ে গেছি মনে হচ্ছে। ক্লাস সেভেন এর ছেলে আমি বাইপাসে বাইক চালাচ্ছি। পিছনে বসে শুধু দুবার দুটো কথা বলেছিলে। প্রথমটা হলো, 'ওই গাড়ী টার ঠিক পিছনে দাঁড়া।' চেষ্টা করে কোনো রকমে দাঁড়ালাম। আর দ্বিতীয়টা হলো, 'এবার আবার চল'। আবার হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে স্টার্ট করলাম। দুটো ঘটনা ঘটে যাবার পর বোঝালে যে কি ভাবে কোনো নির্দিষ্ট পয়েন্টে বাইক থামাতে হয় আর স্টার্ট করা আর স্পিড বাড়ালে যেন কোন ভাবেই পিছনে যে বসে আছে তার ঝাঁকুনি না লাগে। আর কোন দিন তুমি বাইক চালানো নিয়ে কিছুই বলো নি। সেদিন সারা বিকাল পেরিয়ে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইপাসে শুধু এদিক ওদিক করেছিলাম, তোমায় পিছনে বসিয়ে। হাতেখড়ি থেকে পাকা হাত হয়ে যেতে মনে হয় আমার আর আলাদা কোনো দিন লাগে নি। কারণ বাড়ীতে নামিয়ে দেবার পর বললে, 'কাল সকালে আমার অফিসে চলে আসিস।' সকাল হওয়ার অপেক্ষায় রাত যেন পেরোয় না আমার। সকালে সাইকেল নিয়ে তোমার অফিসে পৌঁছালাম। বর্ধমানের এই একটাই অফিস যা সকাল ছ-টায় খোলে। গাড়ীর চাবিটা হাতে দিয়ে বললে, 'যা ঘুরে-বেড়া গোটা বর্ধমান।' ঘুরলাম। সারা সকাল, গোটা বর্ধমানের এ পাড়া ও পাড়া, যেখানে পারলাম, সবাইকে দেখিয়ে ঘুরলাম। তারপর বেশ কয়েকদিন এরকম করেছিলাম। সকালে উঠে তোমার কাছ থেকে রাজদূত নিয়ে এসে আমি গোটা বি সি রোড, এমাথা ও মাথা ঘুরে বেড়াতাম। আমার নিজের করা অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা আমায় ভালো বাইক চালাতে তখন থেকেই সাহায্য করেছে। যখন আমায় বাবা তার স্কুটার পাড়ার বাইরে নিয়ে যেতে দিতো না তখন তুমি নির্দ্বিধায় আমায় রাজদূত ছেড়ে দিতে, আর আমি আমার মনের পাখনায় হাওয়া লাগিয়ে যেন উড়ে যেতাম। না। উড়ে যাবার মন হয় নি আমার, কিন্তু বুঝেছিলাম কোথাও যেন কোনো এক স্বপ্ন সফল হচ্ছে। সে দিনের সেই একটা কথা, আজ এতো বছর পেরিয়েও যখন তুমি আমার বাইকের পিছনে বস, আমার আজও মনে হয় যেন পিছনের লোকটা বুঝতে পারে না গিয়ার বদলানো হচ্ছে বা গতি বাড়ছে। সবই হবে, কিন্তু কোথাও কোনো আওয়াজ না হয়ে, ঝাঁকুনি না হয়ে। ওই যে বলে না, 'পুরো মাখনের মতো'। তাই চেষ্টা করে চলি আজও।
৯২ সাল।। কাটানো প্যান্ট জামা পড়েই মানুষ হচ্ছি এতদিন। তুমি এলে পুজোর কয়েকদিন আগে। বললে, 'চ, ঘুরে আসি'। সোজা কার্জেন গেট পেরিয়ে 'ডেবনেয়ার' দোকানে। বর্ধমানের একমাত্র রেডিমেড পোশাকের দোকান। কিনে দিলে প্রথম জিন্স আর রেডিমেড জামা, তোমার নিজেরও কিনলে। আমার পছন্দেই কিনলে। বোম্বেতে দু-বছরেরও বেশী কাটিয়ে আসা তুমি ফ্যাশনের ব্যাপারে আমার মত নিলে, এটা ছিল আমার কল্পনার অতীত। সেই প্রথম আমার মতমত কেউ এতো গুরুত্ব দিল। (কারোর বাড়ীর ছোট ছেলেকে তার পছন্দের কোনো জিনিষ কিনে দেওয়া, যা তাদের আয়ত্বের বাইরে: এই নিয়ে তোমার অনেক গল্পই আছে, তোমার কাওকে দামী ব্যাট কিনে দেওয়া বা কাওকে দামী জুতো কিনে দেওয়া, সবের কারণ আমি জেনেছি তোমার কাছ থেকেই। আমি ভাগ্যবান মনে করি এই ভেবে যে, সেই গল্প আমার সাথে হয়নি, বা সেই রকম কোনো কারণে আমায় জিন্স কিনে দাওনি।) আমি আরো সাহসী হলাম তোমার স্পর্শে কিন্তু তখনও ছিল শুধু এই মাঝে মাঝের যোগাযোগ।
৯৬ সাল।। কলেজ শেষ করে সংস্কৃতি তে চর্চা কেন্দ্রের সিনেমা চালানোর দায়িত্বে রয়েছি সকাল থেকেই বিকাল পর্যন্ত, যেখানে তোমাদের সাথেই মিশে গেলাম ওই বাবু দার চায়ের দোকান, সংস্কৃতি র টিকিট কাউন্টার হয়ে কার্জেন গেটের আড্ডায়। অবাক, মন্ত্র মুগ্ধের শুনতাম তোমার প্রতিটা কথা, প্রতিটা শব্দ। মেনে চলতাম কিনা জানি না তবে মানলে বেশ হয় এরকম মনে হতো। ততদিনে তুমি কাকুর বন্ধু কাকু থেকে আমার কাছে দাদা হয়ে উঠেছ। এখন তুমি আমায় ছেলে-মেয়েরা বাড়িতে টিভি দেখলে আমায় জিজ্ঞাসা কর কিভাবে বন্ধ করবে। আমি যখন বলেছিলাম যে কখনোই বন্ধ করবে না, দেখো কিছুদিন বাদে আর দেখবে না। তুমি এই সম্মান আমায় দিয়েছিলে আর সেটা পরে অনেকের কাছে বলেছিলে। আমায় যে সম্মান আর গুরুত্ব দিয়েছিলে সেদিনের আমার বেড়ে ওঠার সময়ে তা আমায় আমার অনেক কাছের লোকজনও দেয়নি। আমি এই সময়ে তোমায় দেখি তোমার পূর্ণ ক্ষমতার সময়ে, মানে আমি বলতে চাই তুমি ঠিক এইসময়ে পার করছিলে তোমার পূর্ণ যৌবন-মধ্যবয়স্ক জীবন লালিত-পালিত এক জীবন যে তখনও তার কলেজ জীবনের স্বপ্ন আর আদর্শ আকঁড়ে ধরে মনের কোনে কোথাও বিপ্লবের কথা ভাবলেও পারিবারিক-সামাজিক জীবন তাকে ক্ষত বিক্ষত করে চলে প্রতিনিয়ত। আমি দেখেছি তোমার পার করা প্রতিটা সময় যা আমায় পরবর্তী জীবনে চলতে সাহায্য করে। আমি দেখেছি তোমার অপছন্দের প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ঝাঁটা আর ঝুল ঝাড়ু দিয়ে ঘরের বাইরে বের করে দেওয়া, দেখেছি সেদিন দুপুরে সংস্কৃতি মঞ্চের সামনে সেই ব্যক্তির স্কুটার এ টাকা না দেওয়ার জন্য পা তুলে দেওয়া, কার্জেন গেট এর ঠেকে অজস্র মানুষের সাথে বাজে ব্যবহার করতে, মুখের ভাষা খারাপ করতে: এ সবই ছিল তোমার সেদিনের বন্ধুত্বের যৌথ বা সমষ্টির কথা ভেবে, যা পরে সবই তোমায় মেটাতে হয়েছে তোমার ব্যক্তি জীবনে।
একটু রোগা লম্বাটে চেহারার তুমি সকালে কালো রাজদূত চালিয়ে অফিস আসতে, আটটার সময় তোমার পুলিশ-মার্কা সবুজ জিপ অফিস থেকে বের হতো তোমায় সামনে বসিয়ে ইন্সপেকশন এ, সামনে বাঁ-পা জিপের বাইরে বের করে রাখতে, আবার সেই তুমিই সাড়ে দশটার পর কার্জেন গেটের ঠেকে বাবুদা র দোকানে বাড়ী থেকে আনা মুড়ি-আলু ভাজা আর সন্দেশ দিয়ে আমাদের সাথে একসাথেই টিফিন করতে: এই সব মিলিয়ে তুমি ছিলে একরকম, যার পা ছিল সবসময়ই মাটিতে। খুবই মজার একটা কথা শুনলে হয়তো তুমি অবাক হয়ে যাবে। আমি সাধারণত স্কুলে মুড়ি-সবজি আর মিষ্টি টিফিন খাই। কিন্তু যেদিন বাড়ী থেকে মুড়ির সাথে আলু-ভাজা দেয় সেদিন আমার সেই এতো বছর আগেকার বাবু দার দোকানে তোমার স্টিলের টিফিন বক্স থেকে মুড়ি আর ছোট কৌটো থেকে আলু ভাজা বের করে জলে ভিজিয়ে খাওয়া মনে পড়ে যায়। হাসি মনে মনেই। সেই দিনের সেই খাওয়ার স্বাদ পাই যেন।
না, এরপর আর সাল তারিখ দিন মাস হিসাব করে তোমার সাথে মেশা নয়। এরপর ছিল কাকু থেকে দাদা হয়ে ওঠার গল্প। জীবনের সব সিদ্ধান্ত তোমায় বলে নিই নি হয়তো কিন্তু যখন সেই নিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে চেয়েছি ঠিক তখনই তুমি পিছন থেকে ঢালের মতো দাঁড়িয়েছে সে আমার অজান্তেও। অনেকদিন আগের একটা ঘটনা, আজ মনে পড়ে বেশ হাসি পাচ্ছে। ৯৮ সালের শেষ দিক। কানুপর থেকে বাড়ী এসেছি। কার্জেন গেট এর আড্ডায় সকাল সন্ধ্যা কাটাচ্ছি দুলকি চালে। পরের বছর প্রথম দিকেই মাস্টার্স এর ফাইনাল পরীক্ষা। কথার ফাঁকে কাওকে হয়তো বলেছিলাম যে, ভাবছি এবার আর ফাইনাল দেবো না, পরের বছর দেবো। তারপর! তার আর পর নেই। আমার চেনা আড্ডাটা বিকালের পর থেকেই কেমন করে যেন পাল্টে গেল। একজনও আর আমার সাথে কথা বলে না। বাবুদা চা দিতেও চায় না যেন! যা বাবা! কি হলো! কিছুই বুঝতে পারলাম না। যাই হোক, আর বর্ধমানে থাকতে মন হচ্ছিল না। কানপুর চলে গেলাম। একেবারে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ফিরলাম। ফিরেই সোজা সেই ঠেক এ। পুরো ভোজবাজির মতো বদলে গেছে আমার পরিচিত ঠেক। ঠিক আগে যেমন ছিল। সবাই আবার আমার সাথে কথা বলছে, ফিস্ট হচ্ছে। অনেক পরে বুঝেছিলাম, এ সবই ছিল তোমার ভাবনা অনুযায়ী। হয়তো তুমি না থাকলে আমার সে বছর ফাইনাল দেওয়া হতোই না! ঠিক এরকম আবার এক ঘটনা ঘটালে তুমি আমার সাথে একটুও না বুঝতে দিয়ে। কিছু বছর আগে আমি আমাদের বাবুরবাগের বাড়ী থাকা সত্বেও আরো একটা বাড়ী বা ফ্ল্যাট এর জন্য খুব দৌড়াদৌড়ি করছিলাম। এবারও তুমি পাশে এসে দাঁড়ালে। সবখানেই ছুটে গেলে আমার সাথে, আমার গাড়িতে বা কখনো তোমার গাড়ীতে। শেষ অবধি, তোমার আমার দুজনারই কত পছন্দ হল, কিন্তু বাড়ীর বাইরে আর একটা বাড়ী আমার হলো না। অথচ আমাদের বাড়ীর দু তলা, তিন তলা হল একবছরের ও কম সময়ে তোমাদের অনেকের তত্বাবধানে, যেখানে তুমি ছিলে আড়ালেই। পরিবার আর তার সমস্ত সদস্য নিয়েই তোমার জগৎ, তাই তার অন্যথা আমাকেও করতে দাওনি।
যাক, বাদ দি এসব কথা। আমার বেশ কিছু কিছু দিন খুব মনে পড়ে। জীবনে প্রথম বার ট্রেক করতে যাবো ভাবছি। ভাবনার কারণও তুমিই। প্রায় জোর করে ঠেলেই পাঠালে আমাদের। কোন কাগজ ছাড়াই অমরনাথ চলে গেলাম আমরা শুধু তোমার দেওয়া সাহস নিয়েই। এরপর দেখেছিলাম তোমায় অন্যরূপে। তোমার প্রিয় মানুষের শুধু মাত্র নিজের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে আমার সাথে আবার পরের ট্রেক এ পাঠিয়েছিলে। আজ আমি যখনই কোনো ট্রেক এ যাই, সারাদিন হাঁটতে হাঁটতে যখন সেদিনের মতো তাঁবুতে পৌঁছাই , শুধু মনে পরে তুমিই এই সাহস দিয়েছিলে তা না হলে এখানে আমার আসা হতো না। তাই আমার প্রতিটা ট্রেকিং এর প্রতিটা হাঁটা, প্রতিটা পাহাড় দেখা, প্রতিটা নৈসর্গিক ছবি উপভোগ করা তোমাতেই উৎসর্গীকৃত।
জীবনে প্রথম ট্রেক এ যাওয়ার সময় যেমন তোমার ট্র্যাক-স্যুট টা দিয়েছিলে ঠিক তেমন ই প্রথম বিদেশযাত্রায় ওয়ান- পিস স্যুট টাও তো তোমার দেওয়া। কার্জেন গেটের ঠেকে বসে হয়তো অনেক সময় রাজ-উজীর মেরেছি বা মারার প্ল্যান করেছি, ঠিক এরকম ই একদিন সকালে তুমি অফিস থেকে ফিরে আমাদের বসে আড্ডা দিতে দেখে বলে উঠলে, "আমার জন্য দিনে পাঁচশো টাকার জোগাড় করতে না পারলে সূর্য উঠবে না।" তখনকার মতো হাসি-মজায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম কথাটা কিন্তু পরবর্তী জীবনে যতদিন 'সূর্যকে দিয়ে আমার দিনের টাকা' জোগাড় করাতে না পেরেছি, ততদিনই ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি নিজের কাছে নিজেই। একটা মজার ছলে ছুড়ে দেওয়া তোমার কথা কতদূর একজন মানুষের চালিকা শক্তি হতে পারে, তা তো তুমি ভাবতেই পারবে না। এরকম তোমার ছোট -বড় অনেক কথা, অনেক কাজ আমাদের জীবনে বেড়ে উঠতে প্রতিপদে ভাবিয়েছে।
তোমার কাজের মুল্যায়ন করতে আমি বসিনি। তুমি কোথায় কি করেছ, কার সাথে কি করেছ তার কৈফিয়ত দিতেও আমি বসিনি। আমি শুধু আমার ভাবনায় তুমি কি ভাবে আচ্ছন্ন করে রাখ, সে ছোটবেলা হোক আর আজ আমার মধ্য যৌবনও শুধু তার কথা ভাবি। আমি সব কাজ তোমায় জিজ্ঞাসা করে না করলেও শুধু একবার হলেও ভাবি, এরকম সময়ে তুমি থাকলে কি করতে বা কি বলতে। ভাবনার পরেও সেটা যে মেনে চলি তা নয়, তবুও। ওই যে বলে না, অভ্যাস। তুমি আমার জীবনের অভ্যাস, সে আমার সাথে তোমার রোজ দেখা হোক আর না হোক।
আমার জীবনে তুমি কি করেছ বা কি করনি, তার হিসাব করতেও আমি এই লেখা লিখতে বসি নি। আজ ৩১শে জানুয়ারী ২০১৯ তুমি চাকরী জীবন থেকে অবসর নেবে। বাকি অনেকের মতো তোমার 'কাজ নেই, তাই খই ভাজ' অবস্থা কোনোদিনই হবে না, এগুলো আমরা যারা তোমায় চিনি তারা জানি। আসলে কয়েকদিন থেকেই মনে হচ্ছে আমি তোমায় বেশ অনেকদিন অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে দেখেছি। তোমার জীবনের বহু অধ্যায়ের সাথে আমি বেশ জড়িত এবং তার অনেক সুফল আমি ভোগ করেছি (এমন নয় যে কুফল আমি পাই নি! কিন্তু তার মাপ হয় না। ) আর দিনের শেষে তো আমি আমার বাবারই ছেলে, যে আমায় বলে গিয়েছিল, 'ওর টা নিয়ে ভাবিস না, ওকে শেষে দিস। আর ওকে কিছু বলিসও না'। কি দেব, কেন দেব জিজ্ঞাসা করার দরকার হয় নি সেদিন কারণ তখন আমি সংসার শুরু করতে চলেছি আর 'ঐটা' আমি নিজে হাতে অন্য জায়গায় অনেক বেশিই ঠিক সময়ের মধ্যেই দিয়ে এসেছি। আর কোনো লেখা নিয়ে আমায় এতদিন ভাবতে হয়নি। শেষ পাঁচ দিন প্রায় সব ফাঁকা মুহূর্তেই যখন মনে হয়েছে তখনই সেই পুরোনো দিনে ফিরে গেছি আর প্রতিবার লিখতে বসে আবেগের অতি বহিঃপ্রকাশ লেখাকে লেখা হয়ে উঠতে দিচ্ছিল না। কত কথা, কত ঘটনা, কত কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোন কিছুই বাদ দেবার মতো নয়। তাও, প্রায় সবটাই বাদ দিয়ে এটুকুই লিখলাম। মনে পড়ে গেল, যে আমার জীবন গড়ে দিল শুধু গালাগাল দিয়ে তাকে কি একপাতায় লিখে ফেলা যায়! বৃথা চেষ্টা তাই।
আজ ৩০.১.২০১৯ এর রাত্রে লেখাটা যা হোক করেই শেষ করলাম, শুধু কাল সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে তোমায় পাঠাবো বলেই। ৩১.১.২০১৯ আসবে এ যেমন তুমিও জানতে তেমনি আমিও জানতাম। তোমার জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় দেখে যেমন বড় হয়ে উঠলাম এবারও যেন সেই তোমার দিকেই তাকিয়ে আছি আবার কোন নতুন অধ্যায় দেখবো বলে। আর যেন ফিরে ফিরে নিজেকে বলবো তোমার সেই কথা, "আমি ভগবান নই যেমন তেমনই আমি ভূতও নই, আমি যা, আমি তাইই। তাই নিতে হলে আমার ভালোও যেমন দেখবে, আমার খারাপও দেখবে। আমি মানুষ। দোষ-গুন নিয়েই আমি একজন সাধারণ মানুষ।"
প্রনাম। শ্রদ্ধা। ভালোবাসা।
ভালো থাকবে, সুস্থ থাকবে। নিজের আনন্দে থাকবে।
** ছবি দুটোর কোন দরকার না থাকলেও দিলাম। একটা তোমার সারাজীবন সুস্থ থাকা পারিবারিক জীবনের সাফল্যের কথা ভেবে, আর আমার ছেলের সাথে ছবিটা আমার সারাজীবন আফসোস এর কথা ভেবে: ইসস, আমার ছেলেটা কেন তোমার মতো কাকু -দাদা পেল না!

31/1/2019


Comments

Popular Posts