নন-সেন্স কথামালা (৬) **** 'এন্ডগেম': কিন্তু আমরা তো এই সবে খেলতে নামলাম!

নন-সেন্স কথামালা (৬)



#এন্ডগেম': কিন্তু আমরা তো এই সবে খেলতে নামলাম!

অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে এই সমস্তকিছু। কবে ঠিক মনে নেই তবে আগের বছর যখন 'অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার' দেখতে যাই তবে থেকে শুরু করে আজ অবধি চলছে এই এক অদ্ভুত খেলা।
অ্যাভেঞ্জার্স, মার্ভেল, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, থর, হাল্ক, স্পাইডার ম্যান, গার্ডিয়ান অফ দা গ্যালাক্সি, ব্ল্যাক উইডো, হক আই, আয়রন ম্যান, টোনি স্টার্ক, লোকী, স্টিভ রজার্স, পীপার, ওকাণ্ডা, ডক্টর স্ট্রেঞ্জ, অ্যান্টম্যান, ক্যারোল ডেনভার্স, থ্যানোস, স্কারলেট উইচ, ওডিন, এজগার্ড, হেলা, গামোরা, পাওয়ার জেন্ডার, ওয়ার মেশিন
নেবুলা, চিত্ররী, সাতার, রাগনারক, নিক ফিউরি, ব্ল্যাক আর্মি, রকেট, ভরমীর, ভিশন এরকম আরো, আরো গুচ্ছের নাম আমার মাথাময় গিজ-গিজ করছে। সত্যি বলতে কি এই নামগুলোর মধ্যে কয়েকটা লোকের নাম, কয়েকটা জায়গার নাম বা কয়েকটা কি সব জিনিষের নাম, সবই আমার গুলিয়ে যেতো বা ভালো করে বললে আজও যায়। তবুও আমায় এই ব্যাপারে শিক্ষিত করবেই আমার ছেলে তাই শেষ একবছর মানে ওই 'ইনফিনিটি ওয়ার' দেখার পর থেকেই চেষ্টা করে চলেছে। এনিয়ে আমার খুব একটা অভিযোগ যেমন নেই তেমনই খুব ভালো লাগাও কিছু ছিল না। তাও, ওর চেষ্টার খামতি ছিল না। শুধু বলে রাখি এই জগৎ সম্পর্কে আমার যে বিশাল(!) জ্ঞান ছিল তা হলো ছোটবেলায় দেখা কয়েকটা স্পাইডার ম্যান আর আয়রন ম্যান এর কয়েকটা ফিল্ম। ওই দেখে আমি টোনি স্টার্ক কে চিনেছিলাম আর ভাবতাম কত কিছু জানি। ছেলেটা বড় হতে থাকলো যতো, ততোই আমি এই জগৎ থেকে দূরে সরে গেলাম। আগের বছর ওই 'ইনফিনিটি ওয়ার' সিনেমাটা আমায় ও জোর করেই দেখতে নিয়ে গেল। দেখতে নিয়ে গিয়ে ও বুঝলো যে বাবা যতই সব জানে বলুক বা এতো আধুনিক ভাবনায় থাকে বা জানে, তার মধ্যে বেশ কিছু 'ঝোল' আছে। তাই এই এক বছরে প্রায় হাতে ধরিয়ে শিখিয়েছে অ্যাভেঞ্জার্স কি, কোথায় থাকে তারা, কি করে আর কারা এই অ্যাভেঞ্জার্স! যাই হোক, ও কি শিখিয়েছে বা আমি কি বুঝেছি সেসব পরে বলছি। ও প্রায় সব সিনেমাগুলো আমায় দেখিয়েছে, মানে অ্যাভেঞ্জার্স এর চরিত্ররা কে কিভাবে জন্মালো, মার্ভেল কি ভাবে ধীরে-ধীরে তাদেরকে আলাদা-আলাদা জগৎ থেকে নিয়ে এক 'কমন-মিশন' এ নিয়ে এলো, কি ভাবে মার্ভেলস অ্যাভেঞ্জার্স পরে মার্ভেলস সিনেমাটিক প্রোডাকশনের অন্তর্গত হলো, প্রায় সবই শিখিয়েছে। কিন্তু, ওই যে বলে না! মাস্টার যতো ভালোই হোক না কেন, ছাত্র কেমন সেটা তো দেখতে হবে! তাই বাড়ীতে সিনেমা দেখতে বসে আমার আর ওর মাঝে মাঝেই লেগে যেত। শুনে নাও কিছুক্ষন আমাদের কথোপকথন:
- এই যে তুই আমায় এতক্ষণ থর এর কথা বলছিস এ তো হিন্দু গড ইন্দ্র!
-- (ও চুপ)
- ওই যে হক আই, যে তীর ছুঁড়ে মারছে ও তো অর্জুন!
-- (ও চুপ)
- হাল্ক তো পুরো ভীম রে!
-- (ও চুপ)
- ধুর! কি হলো কিছুই তো বলছিস না!
-- না, আমি ভাবছি, তুমি এটাকে শেষ পর্যন্ত মহাভারতের থেকে টোকা বা এই ধরণের কিছু বলবে। তাই তো!
- (বুঝলাম, আর বেশী ডায়লগ মেরে লাভ নেই, তার থেকে যা বোঝায় তাই বুঝি) আচ্ছা, ওই মেয়েটা কে?
-- ব্ল্যাক উইডো।
- কার উইডো? কে ওর স্বামী? কি করে মারা গেল? দেখলাম না তো!
-- ও কারোর বউ নয়। (ঠান্ডা গলায়)
- তাহলে উইডো হলো কি করে!
-- যেমন করে কুন্তীর বিয়ে না হয়ে কর্ণ হলো।
- ( এরপর ঠিক করে নিলাম, দরকার নেই বাবা, বেশী জ্ঞান ফলানোর, যা শেখাবে, যেমন ভাবে শেখাবে তাই শিখে নেব)
যাই হোক, এরপর প্রায়শই ছুটির সময় বা খেতে বসে আমরা দুজনে অ্যাভেঞ্জার্স নিয়ে মেতে থাকলাম। আর মাঝে মাঝে চলতে লাগলো ওর আমাকে পরীক্ষা নেওয়ার পালা। অবধারিত ভাবে প্রতিবার আমি ফেল করলেও ও আবার নতুন উদ্যমে লেগে যেত। আমি যত বার পারতাম না বা ভুলে যেতাম বা গুলিয়ে ফেলতাম তত বার ই ও আবার বলে দিত বা মনে করিয়ে দিত। আমি বুঝতাম না, কেন ওর আমাকে শেখানোর এতো উদ্যোগ। যাই হোক, এ বছরের প্রথম দিকেই কোনো এক সময় যখন 'এন্ডগেম' এর ট্রেলর বা টিজার দেখিয়ে বললো,
-- আসছে! এপ্রিলে! আমি আর তুমি যাবো! এবার আর তোমায় কিছু বলতে হবে না হলে, দেখবে সব বুঝতে পারবে।
বুঝলাম। ও হরি! তাই এতো দিন ধরে আমায় শেখানো। কার আর ভালো লাগে হলে দেখতে দেখতে তার বাবা যদি জিজ্ঞাসা করে, এটা কে, ও কি করে আবার এলো! আমি হলে তো আমার বাবাকে এতো শেখাতামই না। ও তো অনেক ধৈর্য ধরে আমায় শিখিয়েছে শুধু তাই না, আমার আগ্রহও জাগিয়েছে 'এন্ডগেম' দেখার জন্য। আমি যেন ফিরে গেলাম সেই অমিতাভের সিনেমার ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখার দিনে। ওকে বললাম,
-চ, শুক্রবার দেখে আসি! ফার্স্ট শো দেখবো!
-- ফার্স্ট শো তোমার দেখার আগে আমেরিকা আর ইউরোপে আগের দিন দেখবে। তাই অতো ভেবো না।
ও বাবা! এসব তো আমাদের সময় হতো না। সারাদেশে একসাথে শুক্রবার সকাল এগারোটায় গুরু পর্দায় আসতো আর হল জুড়ে খুচরো পয়সা পড়তো। যাক, সেসব যখন হবে না তখন ওর সময় মতোই যাই। তাই রবিবার রাত্রি আটটার শোতেই যাবো। ওর নিজস্ব কিছু ভাবনা আছে সেগুলো ও আমায় বলেছে, তা হলো
-- এই দু দিন ফেসবুক, হোয়াটস আপ গ্রূপ বা কোথাও 'এন্ডগেম' নিয়ে কিছু লেখা থাকলে দেখবে না। লোকজন 'স্পয়লার' দেয়।
- মানে! সেটা আবার কি?
-- মানে আর কিছুই নয়, গল্পটা বলে দেয় বা শেষে কি হবে বলে দেবে।
- উরি-তারা! কি সব জিনিষ!
যাই হোক, এতো দিনের আমার ছেলের সাধনায় আমি কি শিখলাম বা আমি কি বুঝলাম তা একবার নিজেই ঝালিয়ে নিই। জানি, সব গুলিয়ে আছে। তবুও অপরিচিত তো খুব একটা কেউ নয়:
- ওডিন এর দুই ছেলে: লোকী আর থর। (ধুর, আমার ছেলে বলেছে নর্স মিথলজিতে শুধু থর আছে, লোকী নেই।)
- ওডিন হল এজগার্ড এর রাজা। এই জায়গাটা কোথায়? সেটা বুঝতে ওই যে বলে না, রিয়ালিটি র পরের স্টেজ বুঝতে হবে। একটা বেশ মজার ব্যাপার হল এরা সবাই ওই স্টেজে যেমন যেতে পারে ঠিক তেমনি নির্বাসনে প্রয়োজন মতো আমেরিকা বা নরওয়েতে আসতে যেতে পারে।
- ওডিন এর এক ভয়ঙ্কর শক্তিশালী মেয়ে আছে/ছিল। সে হল হেলা। থর কে মেরে পাট পিটে করে দিয়েছিল। পরে থর সব দল বল নিয়ে ফিরে এসে এজগার্ড এর অর্ধেক লোককে বাঁচিয়েছি, কিন্তু এজগার্ড ধ্বংস হয়ে গেছে।
- ভিলেন হল থ্যানোস। বিরাট তার ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা আরো বাড়াতে তার কয়েকটা পাথর দরকার যেগুলো সে তার হাতের সোনার দস্তানা তে পড়বে। 'স্পেস স্টোন' পেয়েছে লোকী কে পিটিয়ে ওর ট্রেজার এক্ট থেকে,'রিয়ালিটি স্টোন' পেয়েছে কালেক্টরের কাছ থেকে, 'সোল স্টোন' পেয়েছে ভরমির কাছ থেকে, 'টাইম স্টোন' কেড়ে নিয়েছে ডক্টর স্ট্রেঞ্জ এর কাছ থেকে আর, 'মাইন্ড স্টোন' ভিশন এর মাথা থেকে।
গুরুদেব লোক মাইরি! যার যা পাচ্ছে, মেরে-ধরে কেড়ে-কুড়ে নিয়ে নিচ্ছে। এই এত শক্তি নিয়ে ও করবে কি? গুরুর হিসাব খুব সোজা-সাপটা। পৃথিবীতে যা লোক আছে আর যা সম্পদ আছে তার ভারসাম্য নেই, তাই অর্ধেক লোককে মেরে দাও। সবাই ভালো থাকবে। ইল্লি আরকি! কাকে কাকে মারবে? ওসব কিছু নয়। যাকে ওর মন তাকেই। এই ব্যাপারে আমার মিজোরামে এক বাঙালি কলিগ সব সময় বলতো: ' এই বুশ টা মাইরি পুরো ছাগল, কোথায় বোম মারছে দেখ! ইরাক, ইরান! ধুর ধুর! ওই ফাঁকা মরুভূমিতে মেরে কি হবে? দু-চারটে ভুল করে কলকাতা, বাংলাদেশ আর চীনে ফেল। কিছু লোক কমে যাক!'
- থ্যানোসের পালিত মেয়ে গামোরা। ও কিন্তু থাকে অ্যাভেঞ্জার্সদের সাথে। স্টোন জোগাড়ের চক্করে ওকেও আগের বার মানে ওই 'ইনফিনিটি ওয়ার' এ থ্যানোস মেরে ধুলো করে দিয়েছে। জানি না আবার এবার ফিরে আসবে কিনা!
- অ্যাভেঞ্জার্সদের এক জায়গায় করে টোনি স্টার্ক এখন স্টার্ক
টাওয়ারে রাখে। আমার চেনা আইরন ম্যান মানে বিরাট লোহার সুট পরে জঙ্গি দমন ও আর করে না। ওর সুট এখন আরো উন্নত। তাতে সব কিছু কাস্টমাইজড। হার্ট রিয়াক্টার আর ওর লাগে না। জার্ভিস এখন আরো অনেক কিছু করতে পারে। ওরকমই সুট একটা ও স্পাইডার ম্যানের জন্য বানিয়ে দিয়েছে। সেই চেনা জাল ছোড়া স্পাইডার ম্যান আর নেই। ও এখন টোনি স্টার্কের শিষ্য। যদিও আগের বার থ্যানোস মেরে ঝুল ঝেড়ে দিয়েছে। এবারে আদেও বাঁচবে কিনা কে জানে!
- থরকে ওর বোন হেলা মেরে এক চোখ কানা করে দিয়েছে। এখন থর ওর বাবার মতো কানা চোখ ঢাকা দিয়ে জলদস্যুর মতো সেজে থাকে।
- ক্যাপ্টেন আমেরিকা এই টীমটায় একটু দাদাগিরি করে যদিও টেকনিক্যালি আইরন ম্যান একটু বেশী শক্তি ধরে, কিন্তু আমার ছেলে বলে থর সবথেকে ক্ষমতাশালী।
- নিক ফিউরি কিন্তু ক্যাপ্টেন আমেরিকার শিল্ডটা তৈরী করে দিয়েছে।
- উকান্ডা জায়গাটা কিন্তু আমার খুব ভালো লেগেছে। আফ্রিকায়। কি সুন্দর। আর মানুষজন সব কি উন্নত। দেশ, শহর, রাজা সবাই সেই সময় থেকেই আধুনিকতর। (নর্স মিথলজিতেও নাকি এর কথা আছে। কে জানে বাবা, পড়িনি তো!)
- ইউ.এন (আরে আমরা যেটা ইউনাইটেড নেশন বলে জানি সেটাই) যখন অ্যাভেঞ্জার্সদের কন্ট্রোল করতে চাইছে তখন ক্যাপ্টেন আমেরিকা সই করে দিলেও টোনি স্টার্ক কিন্তু করেনি। অস্ত্র বিক্রেতা টোনি স্টার্ক এখন গ্যালাক্সি, হিউম্যানিটি এসব নিয়ে ভাবে। মনে পড়ে যায় 'মেজর বারবারা' র আন্ডারশাফট এর কথা। এগুলো 'ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার' এ যখন স্ট্যান লি সবাইকে একসাথে আনার কথা ভাবছে, তখনকার কথা।
- গ্রূট, আই এম গ্রূট! তো এই গ্রূট আর রকেট দুজনেই বেশ মজায় রাখে অ্যাভেঞ্জার্সদের সমস্ত অভিযান।
আর, এদের সবার সৃষ্টিকর্তাকে তো আমরা মার্ভেলের কমিক বই থেকেই চিনি। স্ট্যান লি। বুড়ো কিন্তু সব সিনেমায় একটু করেই থাকে। এই যে আলাদা আলাদা সব অ্যাভেঞ্জার্সগুলোকে কিনে নিয়ে মার্ভেলস অ্যাভেঞ্জার্স করেছে ওই বুড়োই। বুড়ো নাকি আজ থেকে এগারো বছর আগেই এন্ডগেম তৈরী করবে সেটা ঠিক করে রেখেছিল।
তবে একটা কথা বলে রাখি, যদিও ছেলেই শিখিয়েছে আমায়। এই বুড়োর কোন সিনেমা শেষ হলেই যখন পর্যায় নাম দেখাতে শুরু করে তখনই উঠে চলে এসো না। নাম দেখানো শেষ হলে 'পোস্ট-ক্রেডিট সিন' নামে একটা এক-দু মিনিটের কিছু দেখায়। দেখলে বুঝবে যে এর পর গল্প কোন দিকে যাবে। 'ইনফিনিটি ওয়ার' দেখে ওঠার সময় ছেলেই আমায় চেপে ধরে বসিয়েছে। কেউ ওঠেনি তো হলে। চেপে গেলাম। তোমাদের চুপি চুপি বলে দিলাম যাতে আমার মত লজ্জায় না পড়তে হয়।
দেখো, আর বেশী বলবো না। আমি যত বলবো, তত ভুল-ভাল বলবো। ছেলে আমায় যদিও সব দেখিয়ে বুঝিয়ে এবার হলে নিয়ে যাচ্ছে। তাই আমার আর চিন্তা নেই। কিন্তু আমি ভাবছি আর এক কথা। বেশ কিছুদিন হল ওর মাকেও এসব গল্প বলছে আর দেখাচ্ছে। ভাবছি ওর হলো কি! এবারেও তো হলে গিয়ে ওকে আবার উত্তর দিতে হবে। ওই জন্যই ও মনে হয় বললো যে রাত্রি আটটার টিকিট কাটতে। কে জানে!
আজ রবিবার, আটাশে এপ্রিল, দু-হাজার উনিশ, আমি আর স্বাতী, অ্যাভেঞ্জার্স হাফ-জানা আর না-জানা দুইজন রাত্রি আটটার শো তে বর্ধমান আইনক্স এ 'অ্যাভেঞ্জার্স:এন্ডগেম' দেখতে যাচ্ছি আমাদের ছেলে স্বপ্ননীল কে সঙ্গে নিয়ে বা ও আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে!
দেখা যাক, কি হয়! ফিরে এসে না হয় লিখব 'এন্ডগেম'। এখন তো সবে শুরু হলো আমাদের।

(২৮.০৪.২০১৯)

Comments

Popular Posts