নন-সেন্স কথামালা (৯) **** Ka nga che, Mizoram!

নন-সেন্স কথামালা (৯)

Ka nga che, Mizoram!

অনেক দিন হয়ে গেল সেই দিনগুলো ফেলে এসেছি। চাকরী জীবনের একেবারে প্রথম দিকের কথা। কয়েকদিন আগেই কোন এক ঘটনার কথা উঠতে সেদিনের এক মজার কথা মনে পড়ে গেল। বন্ধু -বান্ধবের অনেকেই জানে হয়তো এই ঘটনাটা, তাও সবাইকে জানবার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই বসে গেলাম লিখতে।
মাস্টার্স পাশ করার পরই আমি মিজোরামের এক ছোট্ট গ্রামের ছোট কলেজে আমার চাকরী জীবন শুরু করি। মিজোরামের গল্প আজ ১৯-২০ বছর পর লিখতে বসে দেখলাম সেই দুবছরের এতো গল্প জমে আছে যে এক পৃথিবী লেখা হয়ে যাবে। তাই সেসব একসাথে না ভেবে আপাতত যেটা মনে আসায় নিজেই একলা হেসে চলেছি, সেটাই শোনাই।
যে জায়গায় থাকতাম সেটা একটা উপজাতি ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের অধীনে এবং তাদের হেড-কোয়ার্টারও। আধা-গ্রাম, আধা-মফস্বল এই পাহাড়ী জনবসতি ছিল ছবির মতো। চাকমা আর মিজো, এই দুই উপজাতির মানুষ নিয়ে শান্ত জীবন ছিল এখানকার। চাকমা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন তখন রসিক মোহন চাকমা, ক্ষমতায়, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে, অর্থে এবং শিক্ষা-দীক্ষায় এখানকার প্রথম সারির মানুষ ছিলেন। আমি যখন ওখানে যাই তখন তিনি ছিলেন শিক্ষা বিভাগের প্রধান পরে জেলার প্রধান হয়ে যান। প্রথম থেকেই উনি ছিলেন কলেজের গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্ট। বাঙালীদের উনি একটু বেশীই পছন্দ করতেন, বিশেষ করে আমরা যারা কলকাতার ধারে-পাশের থেকে যেতাম। মাঝে-মাঝেই বাড়ীতে ডাকতেন, নিমন্ত্রণ করতেন খেতে, গল্প -গুজব করতেন আর ভালো-মন্দের খোঁজ খবর নিতেন। এরকমই কোন এক দিনের আলাপ-আলোচনার সময় ওনার বাড়ীতে ওনার এক বন্ধু আমাদের সাথে গল্প করছিলেন। সেই ভদ্রলোকও ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের কোন এক বিভাগের মন্ত্রী। তিনি গল্পের মাঝেই আমাদেরকে উনার বাড়ীতে সামনের সপ্তাহে দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ করলেন। আমরা বেশ খুশীই হলাম এই হটাৎ নিমন্ত্রনে। আমরা তিন জন বাঙালী (দুজন শিলচরের বাসিন্দা), তিনজন চাকমা, একজন মিজো আর একজন মণিপুরী : এই নিয়ে আমাদের কলেজের সমস্ত শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীবৃন্দ পরের শনিবার দুপুরে নিমন্ত্রণ রক্ষায় পৌছালাম সেই মন্ত্রীর বাড়ীতে। আগেই ছিলেন রসিক বাবু এবং ওনার স্ত্রী। বাজারের শেষ প্রান্তে সুন্দর গোছানো পাহাড়ের ঢালে ছবির মতো ওনার বাড়ী, তেমনই সুন্দর বাগান। ঘর-দোর সুন্দর করে গোছানো। ভদ্রলোক এবং ওনার স্ত্রী আমাদের অসাধারণ আপ্যায়ন করে সমস্ত বাড়ী ঘুরিয়ে দেখিয়ে গল্প করতে বসলেন। ভদ্রলোক আমাদের সাথে বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে, চাকমাদের সাথে চাকমায় এবং মিজোর সাথে মিজো ভাষায় বেশ গল্প করছিলেন যদিও ওনার স্ত্রী আমাদের সাথে খুব একটা কথা বলতে পারছিলেন না। বুঝলাম, ওনার বাংলা বা হিন্দি ভাষা খুব একটা আসে না। তাও চেষ্টা করে দু একটা হিন্দি বলে আমাদের সাথেও কথা বলছিলেন। সব বাধাই কেটে যাচ্ছিল যখন উনি আধা-হিন্দি অল্প ভুল আর অল্প হাসি দিয়ে কথা মাঝখানেই শেষ করছিলেন। আমরাও বুঝছিলাম যে ওনার হিন্দি শব্দ ভান্ডার শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা ওনার বাড়ীতে যাওয়ার জন্য যে খুশী হয়েছেন তা মাঝে মাঝেই বলছিলেন আর আমাদের নিয়ে কি করবেন, কোথায় বসাবেন যেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। খুবই সরল মনের মানুষজন, সেটা বুঝতে আমাদের সময় লাগেনি। যাই হোক, বেশ কিছুক্ষন আলাপ আর খেজুরে গল্প হবার পর আমরা সবাই খেতে বসলাম। বড় টেবিলে সমস্ত খাবার দেওয়া থাকে আর সবাই যে যার মতো খাবার নিয়ে নেয়, এটাই সমস্ত মিজোরামের খাবার রীতি। ওনারাও আমাদের সাথে প্লেট নিয়ে খাওয়া শুরু করলেন একই সময়ে। দুজন চাকমা কাজের মেয়ে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। খাবার টেবিলে এলাহী আয়োজন। ভাত, ডাল, বাঁশের আচার,বাঁধাকপি সেদ্ধ, স্কোয়াশ আর আলু দিয়ে তরকারি, ডিম সেদ্ধ, ডিমের সাথে সবজি দিয়ে তরকারি, মাছ ভাজা, মুরগির মাংস, শুয়োরের মাংস, গরুর মাংস, চাটনী, পাঁপড়, পায়েস, মিষ্টি সব মিলিয়ে প্রায় গোটা কুড়ি পদ। আমরা তিনজন আমাদের মতো ভাত ডাল আর মুরগীর মাংসে যখন মনোযোগ দিয়েছি তখন ম্যাডাম ঘরের অন্যদিকে গেস্টদের সাথে কথা বলছিলেন। হঠাৎই ওনার মনে হলো আমাদের ঠিক দেখা-শোনা হচ্ছে না বা আমাদের ঠিক খাতির-যত্ন করা হচ্ছে না। তাই নিজেই উঠে চলে এসে আমাদের প্লেট প্রায় খালি বা দু এক পিস মাংস দেখে খুব অবাক হয়ে বলে উঠলেন,
- খাও, খাও! ঠিক সে খাও! শুয়োর কা বাচ্ছা, ঠিক সে খাও!
মানে! কি বলছেন! খেতে খেতেই দু-চারজন যারা হিন্দি একটু বোঝে তারাই মুখ তুলে তাকিয়েছে আর কিরকম যেন ভ্যাবলা হয়ে গেছে। কোনরকমে পরিস্থিতি সামাল দিলেন রসিক বাবু ও ওনার স্বামী। পরে বাকিদের যখন বুঝিয়ে বলা হলো কি হয়েছে সবাই হাসি আর চেপে রাখতে পারেন না। আর সেই ম্যাডাম! লজ্জায় আর আসতেই চাইছিলেন না আমাদের সামনে। পরে অনেক বলে রাজী করিয়ে আনানো হলে এতো বার দুঃখ প্রকাশ করছিলেন যে বলার নয়। আসলে উনি কি বলতে চাইছিলেন!
-- উনি আমাদের আপ্যায়ন যাতে ভালো করে হয় তাই আমাদের বোঝাতে চাইছিলেন যে আজ বাচ্ছা শুয়োর কাটা হয়েছে, যার মাংস বেশ সুস্বাদু এবং আমরা যাতে ভালো করে খাই।
হায় রে! 'বাচ্ছা শুয়োর' আর 'শুয়োর কা বাচ্ছা' সবই এক হয়ে গেছে!
আমার মিজোরামের দু-বছর অনেক কষ্টের মাঝেও গল্পে-হাসিতে এতো মন ভরে আছে যে আমি আজও তার ভাবনায় মাঝে-মাঝে হারিয়ে যাই। প্রতিবার যাওয়া, আসা, থাকা, কলেজ, বাজার, লোকজন, পাহাড়, রাস্তা, নদী, টাটা-সুমো, নদীতে চান করা, বিপিন বাবু, হারান বাবু, ভিক্টরিয়া, মুয়ানা, বৌদ্ধ মন্সট্রি, চার্চ, অপু সিংহ এরকম আরো কতকিছু নিয়ে আমার যে কতো হাজার গল্প আছে তা আমি নিজেও জানি না। দেখা যাক, যদি কোনো দিন লিখে ফেলা যায়!
* উপরের মিজো ভাষা যা ইংরাজী বর্ণমালা দিয়েই লেখা হয় সেটাই আমার এই লেখার নাম। তার উচ্চারণ আর মানে না জানলে তো চলে না, তাই:
কা আজ্ঞাই ছে, মিজোরাম!
I miss you, Mizoram!

Comments

Popular Posts