২০১৯ লোকসভা ভোট

#২০১৯লোকসভাভোট



ডিউটি দেবে, না দেবে না, এসব আর আজকাল ভাবি না। আমায় আসলে নির্বাচন কমিশন খুব ভালোবাসেন আর ভাবেন যে এই একটা পেয়েছি যে জীবনেও কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা করে না বা এই নেই, ওই নেই এসব বলে রাস্তায় নামে না। (এর সাথে কিন্তু এবারের সেন্ট্রাল ফোর্স পাবার দাবীটা গুলিয়ে ফেলবেন না, ওটা আমাদের অধিকারের লড়াই, তাতে আমি বাকি সহ-যোদ্ধাদের সাথেই ছিলাম বা আছি আজও) যাই হোক, আমাদের স্কুলে ডি.সি আর.সি হয় তো, তাই আমরা আগেই জানতে পারি সে আসছে-আসছে, কবে আসছে! কি? চিঠি? নির্বাচন কমিশনের আমায় দেওয়া প্রেমপত্র, আর কি! তিনি ঠিক সময়েই এলেন আর আমিও ফাঁকি মেরে, গুলিয়ে দিয়ে আর যা হোক করেই প্রথমে দুটো ট্রেনিং পার করে দিলাম। এরপর আসবে সেই বিখ্যাত চিঠি যাতে থাকবে আমার আর আমার দু দিনের প্রায় পরিবার হয়ে যাওয়া বন্ধুদের নাম। এলো সেও সময়মতো। ক্ষি নিখুঁত সময়ে আসে এই সব ভালোবাসাগুলো! কোনো ভুল করে না মহামান্য কমিশন। তৃতীয় ট্রেনিংয়ে সবার সাথে দেখা করে গল্প করে কাটিয়ে যখন বাড়ী ফিরছি, স্টেশনে বাকি তিনজনকে একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আসবেন তো সবাই? ডুব দিলে আমায় অন্তত আগে থাকতে বলে দিন!' সবাই আসবে বললেন যখন তখন কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়ে ট্রেন ধরলাম। আসলে একবার ফার্স্ট পোলিং অফিসার আসবো বলেও আসেননি, আর ফোন ও ধরছিলেন না। সেবার আমার খুব ঝামেলা হয়েছিল। আমায় প্রায় শেষের দিকে অন্য একজনকে ট্যাগ করেছিল, সে গল্প লেখা আছে আগে। যাই হোক, সবাই বললো দুপুর বারোটার মধ্যেই চলে আসবো। আমিও তাই খুশী মনেই ফিরলাম। এবার আমার তিনজন সহকর্মী পোলিং অফিসাররা বেশ খোলা মনের, আমার মতোই আড্ডাবাজ। একদিনের ওইটুকু সময় দেখে যা মনে হয়েছিল। বেশ ভালো একটা ভাবনা নিয়েই বাড়ী ফিরলাম।
#পি-মাইনাস-ওয়ান ডে:
যেহেতু সবাইকে বলেছিলাম বারোটায় আসতে তাই আমার দশটার ট্রেন ধরলেই হয়ে যাবে এরম ভেবে রেখেছিলাম। সেইমতো বাড়ীতেও বলেছিলাম। কিন্তু ওইদিন সকালে উঠে মনে হলো, ধুর! এতো দেরী করে কি হবে, একটু আগেই যাই। আসলে ভিতরে ভিতরে একটা টেনশন তো তৈরী হয়েই থাকে। তাই আগে গিয়ে আমি যদি একটু কাজকর্ম এগিয়ে রাখি, বা ওই কর্মযজ্ঞে উপস্থিত হয়ে যাই তাহলে এসব ফালতু টেনশন কেটে যাবে। তাই সাড়ে আটটার ট্রেন ধরলাম। ভাবলাম, ওনারা যেমন আসছেন তেমনই আসুন। আমি না হয় আগে গিয়ে ওই মোবাইল রেজিস্ট্রেশন, কাউন্টার দেখা, ডি-কোডিং লিস্ট দেখা, ভেহিকল- লিস্ট দেখা করে একটু বসবো আর ওনারা কেউ একজন এলেই মাল-পত্র কাউন্টার থেকে তুলে নেব। বেরুলাম সেই ভাবনায়। সকালে রোদ ও কম, ট্রেন ও ছাড়লো সময় মতো, ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে বেশ এগুছিলাম। আধ ঘন্টা মতো যাবার পর একটা স্টেশনে ট্রেন থামলো। আর ছাড়ছে না। প্রায় এক ঘন্টা কেটে গেল। পরের ট্রেনের সবাই চলে এলো। আরো আধ ঘন্টা কেটে গেল। শোনা গেল সামনে কোনো একটা গেট ভেঙে গেছে লরির ধাক্কায়। প্রায় পৌনে দু ঘন্টা বাদে ট্রেনটা যখন ছাড়লো তখনই আমি বুঝে গেছি আজ যে কপালে কি আছে! যাই হোক, নিজেকে একটুও উত্তেজিত না করে ধীরে সুস্থে স্টেশনে নামলাম। তখনই ঘেমে জামা ভিজে গেছে। তারই মাঝে লোকজন ছোটা-ছুটি করে টোটো ধরছে ডি.সি তে যাবেন বলে। আমি এখন খুব শান্ত মনে ধীরে ধীরে একটা টোটো তে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি হলো, সাথে আমার এক বন্ধুও ছিল। টোটোওয়ালার প্রথম কথা, 'কুড়ি টাকা করে লাগবে কিন্তু!' বাকিরা রে-রে করে চেঁচিয়ে উঠলেও আমি চুপ করেই থাকলাম কারণ জানি, যতই চেঁচাও, ও আজ যা ভাড়া বলবে তাতেই যেতে হবে কারণ আজ ওরা সবাই মিলেই এটা ঠিক করে রেখেছে। আর ওরা এটাও জানে, আমরা যারা আজ ভোট করতে যাচ্ছি তাদের কমিশন ভালোবেসে আজকাল অনেক টাকা দেয়! তাই ওদের বোঝাতে গিয়ে লাভ নেই। টোটো ছুটছে ডি.সি র দিকে। একটু বেশী জোরেই যাচ্ছে মনে হচ্ছে। হবে হয়তো! ফিরে এসে আবার এক ট্রিপের চেষ্টা করবে হয়তো। ঠিক আছে। পাশের রাস্তায় লোক দেখতে দেখতে যাচ্ছি। টোটো টা বেশ সাঁ-সাঁ ছুটছে। হটাৎ কিছু বোঝার আগেই টোটোটা ধুপ করে রাস্তায় নেমে গেল আর প্রচন্ড জোর একটা আওয়াজ। একদিকের পিছনের চাকা খুলে গেছে, আর তাতেও টোটো ছুটছে পাকা রাস্তায় চাকার লোহার পাতি গরম পীচ খুঁড়তে খুঁড়তে। ড্রাইভার হ্যান্ডেল সোজা রাখতে পারছে না আবার স্পীডও কমাতে পারছে না। আর এরম সময়ই হলো আর এক দেখার মতো ঘটনা। উল্টো দিক থেকে আরো জোরে আসা এক টোটো এসে আমাদের টোটোটায় এমন জোরে ধাক্কা মারলো যে এই টোটো টার সামনের কাঁচ ঝন ঝন করে ভেঙে গেল যেমন ঠিক তেমনই দেখলাম টোটোভাই গাড়ী থেকে ছিটকে রাস্তার পাশে ড্রেনের ধারে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আমাদের টোটো তে তখনও গতি আছে। থামলো রাস্তার অন্য প্রান্তে। পাঁচজন পোলিং অফিসারই সুস্থ। যেটুকু লেগেছে টোটোভাইয়েরই। কিছুক্ষন থেমে ওর সেবা যত্ন করে অন্য আর একটা টোটো করে এসে পৌছালাম ডি.সি তে। এমনিতে তখনই বুঝে গেছি, আজ দিন ঠিক যাচ্ছে না। কি হয় এর পর সেটাই দেখার।
দীর্ঘদিনের ভোটের কাজ করতে করতে যা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি তাতে এর পর থেকে হতে থাকা একটার পর একটা ঘটনা বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে এবার আমার এই দুদিন খুব সুখের হবে না।
প্রথম ডি.কোডিং লিস্টে দেখে জানলাম শহরের এক প্রাইমারী স্কুল আমার বুথ এবং রুম নম্বর ওয়ান। মানে স্কুল তো খারাপ হবেই আর সব থেকে বেশী ভোটার ও আমাদের বুথে।
দ্বিতীয় ভেহিকল লিস্টে দেখলাম আমাদের ভাগ্যে মিনি বাস এবং তিনটে পার্টি। মানে এখানেও সেই আটকে যাওয়ার সমস্যা।
যাই হোক, মনটা একটুও খারাপ না করে মোবাইল রেজিস্ট্রেশন করলাম। সবই হচ্ছে, কিন্তু সেই পোল মনিটর আবার আমার ফোনে ডাউনলোড হচ্ছে না। আমায় পাঠালো কন্ট্রোল রুমে। যিনি ছিলেন তিনিও প্রায় এক ঘন্টা চেষ্টা করেও পারলেন না। দুটো মোবাইল নম্বর রেজিস্ট্রেশন করে দুটো একাউন্ট দিয়েও পারলেন না। এদিকে ওটা না হলে নাকি মাল দেবেন না। কাউন্টার বলছে আর একটু অপেক্ষা করুন, হয়ে যাবে। হয় আর না। বাকিরা সবাই এসে গেছেন, তাও কোনো কাজ এগুতে পারছি না। এক বন্ধুকে পেয়ে তাকে বললাম তোর এপস টা আমায় শেয়ার কর। কাউন্টার বলছে ও ভাবে হবে না, আপনাকেই নিজের ফোনেই ডাউনলোড করতে হবে। আমি কোনো কথা ওদের আর না শুনে ওর এপস টাই নিলাম, এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমার মোবাইল দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলাম। কাউন্টারের কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকা অফিসারকে বললাম, সবাইকে এভাবে ঝামেলায় না ফেলে জানিয়ে দিন, যারা পারছেন না তাদেরও হয়ে যাবে। কিন্তু বুঝলাম, উনি সেটা চান না! উনি কাউন্টারের সামনে ভীড় পছন্দ করছেন।
যাই হোক, মাল নিতে নির্দিষ্ট কাউন্টারে গেলাম। প্রথমেই মাল দেবার আগে বলে কিনা, মাল পরে নেবেন আগে এই লিস্টটা ছবি তুলুন। মানে! মানে আর কিছু নয়, ওনারা কোন মাল কি ভাবে নেবেন তার একটা সুন্দর লিস্ট করে রেখেছেন। আমি মনে মনে খুব খুশী হলাম। যাক এতো ভালো ব্যবস্থা ভাবা যায় না! আজ তো যাই, কাল এসে তাড়াতাড়ি হবে মনে হয়!
বুথে এসে পৌছালাম। ঝাঁ চকচকে রাস্তার পাশে খেলার মাঠ নিয়ে সুন্দর মনোরম পরিবেশে শহরের প্রাইমারী স্কুল। বাস পাশেই দাঁড়িয়ে থাকবে। ঢুকলাম। বুথের ছাদ ভাঙা। ছাদে পলিথিন লাগানো যাতে মাথায় কিছু না পড়ে। মেঝে নেই। বাথরুমে যাওয়া যাবে না। জল আর একঘন্টা থাকবে। তিনটে বুথ। আমাদের সবথেকে বেশী ভোটার, এগারোশো। তার জন্য সব থেকে ছোট আর সব থেকে বাজে জায়গা। ঘর বললাম না, কারণ প্রাইমারী স্কুলও ওই জায়গাটা ব্যবহার করে না, ছেলেদের কথা ভেবে। জানি মন থেকে এবার আমার দিন নয়, তাই
একটুও না দমে চুপ থাকলাম। বাকিরা মোটামুটি সব জায়গায় ফোন করে ফেলেছে। জানি, এই সময় কেউ আসবে না আর বুথ কোনো ভাবেই বদলাবে না। তাই বাকি দিক দেখতে লাগলাম। রাস্তার উল্টোদিকে একটা বড়ো ক্লাব, যার বিল্ডিং দুটো প্রাইমারী স্কুলের সমান। গেলাম তার সামনে। কয়েকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। বুঝেছে আমাদের সমস্যা কি। ওনারা ক্লাবের বাথরুম খুলে দিলেন। একটা সমস্যা মিটলো। রান্নার দিদিরা খাবার অর্ডার নিয়ে গেলেন। এসব নিয়ে আমি অতো ভাবি না। বসলাম কাগজ নিয়ে ভাঙা মেঝেতে আমার শতরঞ্জি পেতে। নটার সময় সেক্টর এলে বাকি পোলিং অফিসাররা ঝাঁপিয়ে পড়লে আমি চুপ করেই বসে ছিলাম, জানি যে উনি বলবেন, 'কি করবো বলুন! আমি তো রিপোর্ট দিয়েছিলাম!'

#পি-ডে
পাঁচ জন এজেন্ট। বসার জায়গা নেই বললেই চলে। এলেন সবাই একই সময়ে। মক পোল করে ভোট শুরু হলে নির্দিষ্ট সময়েই। নির্বিবাদে ভোট হচ্ছে, কারোর সাথে কারোর সমস্যা নেই। আবার বুথে লাইনও নেই। আমার শুধু চিন্তা হচ্ছে এতো ভোট হবে কখন!
প্রথম দু ঘন্টায় দুশো ভোট হয়ে গেছে। এজেন্টরা সবাই সবার বন্ধু, এর নাম বাদ গেলে ও ধরিয়ে দিচ্ছে আর ওর বাড়ীর কাকিমা টিফিন আনলে সবাই মিলে খাচ্ছে। বেশ ধাঁধায় আছি আমি। ভালোও লাগছে আবার সন্দেহও লাগছে। ছবি পরিষ্কার হলো কিছু সই করাতে গিয়ে। দুজন সোজা সুজি বলে দিলেন প্রার্থীর নাম জানি না, আপনি লিখে দিন। আর এক জন বললেন ওই যে মুর্মু আছে না, উনি। তবে একটা কথা বললেন, দেখুন এখানে কেউ কোন ডিসটার্ব করেন না, ভোটে কোনো ঝামেলা হয় না, সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল আর এক জন নির্দলীয় এজেন্ট নিয়েই তিনটে বুথেই বসে আছে। সবাই বন্ধু আর সবাই এক সাথেই থাকে। সত্যিই দেখে ভালো লাগলো। আমার চিন্তা ওই অতো ভোট কখন হবে, লাইন তো নেই! সবাই এক বাক্যে বললো, লাইন হবে না আর আশি শতাংশ ভোটও হবে। ভাবলাম এ আবার কি ছক! আসলে মনটা তো আমার বিষিয়ে আছে বাকি অনেক ঘটনা দেখে বা শুনে। পরের দু ঘন্টায় আবার প্রায় দুশো ভোট হলো। এবার বুঝলাম এদের কেন লাইন পড়ছে না। এই মাঠের চারদিকের বাড়ীগুলোই আমার ভোটার। আসছে, যাচ্ছে সময় মতো, ফাঁকা দেখেই। কারোর বাড়ী এক কিমি দূরেও নয়, তাই দেখে শুনেই আসছে।
লুচি, আলুর তরকারি খেতে দিলেন দিদিরা টিফিনে। খেলাম। ভালোই, বাজে তেলের গন্ধ নেই। বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন।
দুপুরে ভাত, ডাল, আলু পোস্ত, ডিমের ঝাল। বেশ তৃপ্তি করেই খেলাম। লাল চা যতবার বলেছি ততবারই এসেছে।
দুপুরে খাবার পর চেয়ার এ বসে সব কাগজ, ফর্ম হাফ-শেষ করে খামে খামে ঢুকিয়ে রাখলাম। মাথাটা একটু হেলিয়েই দিলাম। ফ্যানের তলাতেই বসেছিলাম। একটু বাদে পাশের বুথের প্রিসাইডিং এসেছেন কিছু জিজ্ঞাসা করতে। আমায় উঠিয়ে বললেন, 'আপনি তো মশাই দারুন আছেন!'
- না! মানে! ওহ,ওহ! ও আসলে আরকি, এই খেয়ে এলাম তো!
সত্যিই তো তাই। ভালোই আছি। কোন ঝামেলা ছাড়াই ভোট হচ্ছে। বুথে একটাও জোরে কথা পর্যন্ত হয় নি। প্রত্যেকে এপিক নিয়ে ভোট দিচ্ছে, যে আনেনি তাকে ফিরিয়ে দিলেও কোনো এজেন্ট কোনো কথা বলছে না, যে বুড়ি ঠাকুমাকে নিয়ে ভোট দিতে আসছে তাকে ফর্মে সই করিয়ে ভোট দিতে বললে সে তাই করছে। সত্যিই কোনো সমস্যা নেই। এক একবার পাঁচ থেকে দশ জন করে আসছে আর ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছে। বোঝায় যাচ্ছে সবাই একই বাড়ীর। সত্যিই কি এতো ভালো যাবে। দেখা যাক শেষ অবধি। বিকাল পাঁচটায় এজেন্টরাই বললো, 'স্যার আর হবে না।' এবং সত্যিই আর ভোট দিতে কেউই আসে নি। ছটায় শেষ করে সাতটায় কাগজ শেষ করে বাস ছাড়লো সাতটা দশে। কাউন্টারে জমা নিয়ে আর চিন্তা নেই কারণ ওদের লেখা মতোই সাজিয়ে এনেছি। পৌছালাম, পৌনে আটটায়। ধারণা আছে খুব বেশী হলে দশ মিনিট লাগবে। প্রথম আমরাই। চারজন আছেন কাউন্টারে। কে কি নেবেন আগের দিন লিস্ট দিয়েছিলেন। সে মতো জমা দিতে গিয়ে দেখি ওনারা কালকের কথা কিছুই জানেন না। যে লিস্টটার ছবি তুলিয়েছিলেন সেটাও নেই ওনাদের কাছে। আজে বাজে ভাবে যা মন চাইছেন, যা মন দেখছেন। বুঝে গেছি তখনই যে লোক পাল্টে গেছে। মাথা ঠান্ডা রেখে ওনারা যা চাইছেন সেটা দিয়ে যাচ্ছি। একজন আমায় বললেন, 'ডাইরি দিন', দিলাম। কি দেখলেন কে জানে! ঠিক দু মিনিটের মাথায় আবার বললেন 'পি.আর.ও ডাইরিটা বইয়ের সাথে মেলাতে হবে, দিন।' চুপ থাকলাম। পাশ থেকে একজন দেখি মক-পোল সার্টিফিকেটটায় এজেন্টদের নাম আর সই মেলাচ্ছেন। কার সাথে? কে জানে? কিন্তু খুব গম্ভীর ভাবে সব পাতাগুলোয় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। অন্য আর একজন বললেন, 'এবার আসল কাগজ গুলো দিন, যেগুলো মেশিনের সাথে যাবে।' আমি চুপ করেই থাকলাম। জানি এখন ওনার সাথে চেঁচিয়ে কোনো লাভ নেই, কারণ একটু আগেই উনি ওই সিল করা খামগুলো ই.ভি.এমের সাথে আছে কিনা দেখে সিল খুলে দেখেছেন। 'ওই কাগজগুলো দিন', বলে যতই উনি তোলপাড় করছেন, আমি চুপ থেকে শেষে বললাম, 'ওগুলো মেশিনের সাথেই আছে। আপনি একটু আগেই দেখলেন।' এবার সেই পাশের ডাইরি চাওয়া অফিসার আমায় বললেন 'বাকি সব দিন।' আমি আবার কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম, 'কি কি চান বলুন।' আমার এখন হাতে অফুরন্ত সময়। হেলে দুলে গেলেও সাড়ে আটটার ট্রেন পাবো। তাই চলুক র-গ-ড়! শেষ-মেশ ক্লান্ত হয়ে ওনারা কি নিলেন তা ওনারাই জানেন। আর আমি ভাবছি এই সন্ধ্যায় শুরুর সময় ফাঁকা কাউন্টারে যদি এনাদের এই হাল হয়, আর একটু বাদে সব টীম গুলো যখন এসে ভীড় করবে, তখন এনারা কি করবেন!
যাই হোক, রিলিজ দেবার পর বললাম, 'আগের বার ফ্রুটি দিয়েছিলেন, এবার কিছু দেবেন না!'
- আছে তো, পাশের কাউন্টারে ওই যে ওখানে যান।
গেলাম।
-- ও দাদা, আমাদের চারটে ফ্রুটি দিন তো, আমাদের মাল জমা হয়ে গেছে।
-ফ্রুটি নয় এবার, এবার দই শরবত দেওয়া হবে।
-- ও, তাই দিন।
- এখন তো হবে না। সে তো নটার পর।
-- মানে! শরবত খেতে নটা অবধি থাকবো!
- তাহলে আপনি কন্ট্রোল রুমে যান।
আবার! আবার সেই কন্ট্রোল রুম! শা** একটা মোবাইল এপস ঠিক করতে পারে না তারা দেবে শরবত!
অগত্যা কলেজ গেট। আবার সেই টোটো। আবার সেই টোটো দাদা বলে, 'কুড়ি না হলে যাবো না!'
হাসলাম।
রাত্রি নটার ট্রেন ধরলাম স্টেশন থেকে।

* আমার এই দু দিনের ভোট পরিচালনা করার সময় থেকে জায়গা বা কারোর নাম আমি উল্লেখ করি নি। এটা ইচ্ছাকৃত। থাক না, কি হবে জেনে! কোন জায়গা, আর কারা সঙ্গে ছিল সেসবের কি দরকার!
** আগের বার ও আমি এই কলেজ থেকেই মাল নিয়েছিলাম আর জমা দিয়েছিলাম। আমার ভালো লেগেছিল এদের ব্যবস্থাপনায়। এবার দেখলাম সবই কেমন অগোছালো।
*** বুথে সব এজেন্ট বন্ধু, ভাই, এর কাকা ওর দাদা। ভালো লাগলো। কিন্তু এক দলের এজেন্টের ফর্মে তার ক্যান্ডিডেট বা পোলিং এজেন্টের সই না মিললেও বাকিরা কোনো প্রতিবাদ নেই, উল্টে বলছে সবই ঠিক আছে। সবাই বলছে। সবাই সবাইকে বসতে জায়গা করে দিচ্ছে। সবার টিফিন, চা একসাথে। কার পোলিং এজেন্ট নাকি অন্য কারোর ব্লক প্রেসিডেন্ট তো কার এজেন্ট নাকি কার কমিশনারের ভাই। ভালো লাগে কিনা বলুন! আমার বুথে কংগ্রেস, তৃণমূল, সি পি এম,বি জে পি, আর নির্দল এই নিয়ে পাঁচ জনা প্রথম থেকে শেষ অবধি ছিলেন। সত্যিই ভালো লাগে!
*** আর একটা কথা না বললে তো চলেই না। আমাদের বুথে ওয়েব কাস্টিং ছিলো। সকাল থেকেই তাই সবাইকে ঠিক ভাবে ভোট চালনার কথা বলেছিলাম। হচ্ছিলো ও তাই। যদিও সবাই খুব অবাক। এসব তো এখানে নেই। দুপুর বারোটার পর সেক্টর এসে বললেন,'ক্যামেরাটা খুলতে হবে।' আমি জিজ্ঞাসা করায় বললেন, 'এটা ভুল করে লাগিয়েছে, এটা এখানকার নয়।' আমি ছাড়বো কেন তখন। ক্যামেরার জুজু দেখিয়ে বুথ নিশ্চুপ করিয়ে ঝামেলা-বিহীন ভোট চালাচ্ছি। এখন খুললে আর সেটা থাকবে! উনি চলে গেলেন। ফিরে এলেন আরো দু ঘন্টা বাদ। এবার সেই ক্যামেরা লাগানো ছেলেটাকে নিয়ে। আমায় চুপি চুপি বললেন, 'এই ক্যামেরাটা চলছেও না, কিছুই দেখা যাচ্ছে না।' আমি আর ওসব এখন মানবো না। শেষ পর্যন্ত বেলা তিনটায় ক্যামেরা খুলতে দিলাম। ভাবা যায়! কারা সব কাজ করছে!
*** পি মাইনাস ওয়ান আমার দিন না থাকলেও পি ডে আমারই ছিলো, না হলে রাত্রি সাড়ে দশটায় বাড়ী ফিরে চান করে এগারোটায় ভাত, ডাল, পোস্ত, মাছের টক নিয়ে খেতে বসতে পারি!
** দুটো সেলফি তো দেওয়াই যায়! কি!
আপাতত কিছু দিন আবার নিশ্চিন্ত। আবার পরের বার
অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে, অন্য কারোর সাথে।


(9/5/2019)

Comments

Popular Posts