নন-সেন্স কথামালা (৮) **** ভিয়েতনামের মাছ, কিউবার ঝাল, চীনের টক আর রাশিয়ার ভাজা: লক্ষণদা ও পার্টি কংগ্রেস।

নন-সেন্স কথামালা (৮)

ভিয়েতনামের মাছ, কিউবার ঝাল, চীনের টক আর রাশিয়ার ভাজা: লক্ষণদা ও পার্টি কংগ্রেস।

#স্থান, কাল, পাত্র
৯৬ বা ৯৭ সাল। গ্রাজুয়েশন ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে কিন্তু তখনও মাস্টার্স পড়তে শুরু করি নি। সারাদিন একটাই কাজ ছিল সেই সময় আমাদের, আড্ডা আর আড্ডা। মোটামুটি ভাবে খাওয়া আর ঘুম বাদে বাকি সময় কার্জেন গেটের পাশে বাবু দার চায়ের দোকান ছিল আমাদের আড্ডা। (আড্ডা আজও আছে, চায়ের দোকান হাত বদল হয়ে আজ রকি থেকে ষষ্টিদার কাছে) সকালে ঘুম থেকে উঠে মুড়ি জল খেয়ে পৌঁছে যেতাম দশটার মধ্যেই। আর রাত্রের আড্ডা মেরে দশটায় বাড়ী ফিরতাম। ভাবছো যে দুপুরে কি করতাম! দুপুরে আমরা দশ জন মিলে 'সংস্কৃতি' লোকমঞ্চের সিনেমার টিকিট বিক্রি থেকে লাইট দেখিয়ে লোক বসানো সবই করতাম। কাজও হতো কিছু সময় কাটানোর মতো, আর মাস্টার-রোলে জিলা পরিষদ আর চলচিত্র চর্চা কেন্দ্র কিছু টাকা দিত, তাতে আড্ডার খরচ উঠে যেত। দুপুরে ঘুমটা সংস্কৃতির এসি তে ভালোই হতো। বিকালে পরের দিনের শো এর অ্যাডভান্স টিকিট কিছু বিক্রি করে আবার ছটায় আড্ডায় এসে বসতাম। দিন গুলো বেশ সোনার খাঁচায় মোড়ানো না হলেও চলে যাচ্ছিলো। সামনে কি হবে এতো মনে হয় তখন ভাবতাম না।
কার্জেনগেট ঠেক এক অন্য জায়গা আমাদের সবার কাছেই। সেই কলেজ জীবন থেকে আজ অবধি দেখে আসা অগুনতি বিভিন্ন বয়েসের মানুষের আড্ডার জায়গা। বাবা-কাকার বন্ধুরা অনায়াসেই এখানে দাদা হয়ে যায় আর সবার সাথেই সবার আড্ডা হয় সকাল থেকে রাত অবধি, বিরামহীন। সেই সময়ে এমন এক মানুষ আমাদের সাথে আড্ডা দিতাম যাকে সবাই অনেক নামেই চিনতো। 'নাককাটা', 'গুরুভাই', 'খিস্তির জন্মদাতা', 'পাক্কা হা**', 'ল্যাংড়া কার্তিক' এরকম অনেক ভালোবাসার নামে আমাদের লক্ষণদা ঠেক জমিয়ে রাখতো। সকালে দশটার সময় পুরোনো ঝন-ঝণে রেসিং সাইকেল থেকে নেমে সাইকেলটা দেওয়ালের গায়ে প্রায় ফেলে দেওয়ার ভঙ্গিতে বাঁ পাটা একটু টানতে টানতে বাবুদার চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসেই শুরু হতো দিন যে ভাবে: (বাবুদার খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল তো, তাই!)
- দে, মা*! তোর একটু গরম ঘোড়ার মু* দে!
-- আসুন, বা*! আপনার জন্যই তো সাজিয়ে রেখেছি!
দুই বন্ধুর ভাব-ভালোবাসার কথোপকথনে বেশ কিছু রত্ন ছড়িয়ে পড়ার পর গুরুভাই নজর দিতো আমাদের উপর। এই সময় হয়তো আমরা বাবুদার নেওয়া 'আজকাল' বা উদয়দার দেওয়া 'স্টেটসম্যান' নিয়ে কপচাচ্ছি কিছু,
- বাঁ* দের কোনো কাজকর্ম নেই, সকাল থেকেই এসে চায়ের দোকানে বসে পড়েছে! (এবার আমাদের সাথে শুরু হলো)
কথোপকথনে যাবার আগে শুধু কয়েকটা লাইনে লক্ষণদা নিয়ে না বলে দিলে খারাপ লাগবে, আবার সমস্যা এমন যে এই লোককে নিয়ে কয়েক লাইনে বলা যায় না। বিখ্যাত দাদার ভাই যদিও রাস্তার ধারে বা লোকের দোকানে কাঠের ব্যবসা করে, প্রায় বস্তির মতো এক বাড়ীতে থাকে যদিও শোবার ঘরে ওর খাটটার কাঠের দাম কয়েক লক্ষ টাকা (ওটা নাকি অরিজিনাল মেহগিনি, আর ওতে যা কাঠ আছে তাতে আরো দুটো খাট হয়ে যাবে), সেই সময়ে বর্ধমানে এমন কোনো নেতা বা মানী লোক জন ছিলো না যারা ওকে চিনতো না বা ও যাদের কে সামনেই গালাগাল করে নি, কিন্তু একটা পিয়নের চাকরী ওর হয় নি, গোটা শরীর জুড়ে যার ধারালো অস্ত্রের কোপানোর দাগ, এমনকি গোটা মুখেও সে তো কোন এক রাজনৈতিক মতালম্বী হবার জন্যই, সেই দল রাজ্য শাসন করলেও তখন তাকে দূরে সরিয়ে রাখে, সেই লক্ষণদার কথা বললেই আমাদের মতো ছেলে-ছোকরার দল বুঝি, গুরুভাই আমাদের সব বিষয়ে মত দেওয়া এবং সেই বিষয়ে নতুন খিস্তির জন্ম দেওয়া এক অন্য গ্রহের মানুষ। 'স্টীলে* বা*র বাঁ*', এটা যে কোনো খিস্তি হতে পারে আর এটা যে কোনো মানুষ নির্দ্ধিধায় বলে যেতে পারে তা গুরুভাইকে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এরকম আরো, আরো অনেক আছে, লিখলে পাতা ভর্তি হয়ে যাবে।
#কোনো এক দিনের কথা:
'আজকাল' নিয়ে গুলতানি চলছে আমাদের। বাবুদার চা একবার করে হয়ে গেছে। গুরুভাই এসে ঢুকলো। বাবুদার সাথে কিছু রগড়ের পর একটা বিড়ি ধরিয়ে,
- কি মা* সকাল থেকে বিড়ির পোঁ* মা*ছো বসে বসে! কাজকর্ম তো কিছুই করো না!
বুঝলাম আজ আমাদের দিকে তীর। আমরা আজ সকাল থেকেই যেন প্রস্তুত হয়েই ছিলাম গুরুভাইকে জ্বলিয়ে দেবো আর ওর মুখ নিঃসৃত কিছু রাম-বাণী শুনবো। একটুও না রেগে আলাদা-আলাদা ভাবে প্ল্যান করেই যেন শুরু করলাম কথোপকথন। আমরা সবাই একদিকে আর অন্য দিকে গুরুভাই একা।
-- বিড়ি নেবে নাকি, না দেবে?
- দাও মা*! তোমাদের তো বা* বাপের পয়সার মাল! খেয়েই নি!
একটা কথা না বললে খুব অন্যায় হবে তা হোল, লক্ষণদা আমাদের কাছে একটা-আধটা বিড়ি নিলেও, বিড়ি দিতে কখনো কার্পণ্য করতো না। আমাদের মধ্যে যারা বিড়ি না খেয়ে সিগারেট খেতাম তাদের খুব গাল দিতো বাবার পয়সায় সিগারেট খাবার জন্য। যাই হোক, শুরু হলো আক্রমণ:
-- পেপার পড়েছো?
- কি করে পড়বো মা*! সকাল থেকে তো পোঁ*- মুখে নিয়ে বসে আছো, আমি পেলাম কোথায়!
-- এই, পেপারটা দে না লক্ষণদাকে!
- রাখো মা*, তোমরাই পড়ো। বাড়িতে পড়ে, এখানে পড়ে, ল্যা**, কি দেশ উদ্ধার করছো কে জানে?
-- ওসব বাদ দাও, গুরুভাই! তোমার কাছে একটা কথা জিজ্ঞাসার আছে!
- তা তো মা* থাকবেই, স্কুলে-কলেজে পড়ে এসে যতো জানার আছে সবই তো কার্জেন গেটে!
-- ধুর বা*! বলবে কিনা বলো?
- বলতে তো হবেই! বলে না, ছোট ছেলের সাথে পোঁ* মারাতেও নেই, আর ছোট ছেলের পোঁ* মা*** নেই!
-- বলছি এই যে আজ কাগজে দিয়েছে কেরালায় পার্টি কংগ্রেস হচ্ছে, এই ব্যাপারটা কি বলোতো?
- হ্যাঁ, হচ্ছে তো। তাতে তোমাদের কি এসে গেল?
-- না, মানে ওই যে বলে না! তোমাদের পার্টি আর কংগ্রেস, ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না!
- তোমাদের মা* বেশী বোঝার দরকার নেই!
-- ধুর! তুমি জানো না তার মানে!
- বাড়িতে তো কাকা- দাদা অনেক আছে, সব পদ আলো করে বসে আছে। তাদের কাছে জেনে নাওগে!
-- সে সব পরে হবে, আজ তুমিই বলো।
- মাছের ঝাল খেয়েছো?
--হুঁ।
-- মাছের টক তো বাড়িতে মাঝে মাঝেই খাও, তাই তো?
-- সে তো খাই। এই, তুমি মা* বেশী ভাট বকছো তখন থেকে। যা বলার বলো তো ভালো করে।
- মাছ ভাজা খাও?
-- খাই তো! আরে ধুর! কি সব বকছো!
- একটা মাছের পেটির পিস, যার একদিকটা সরষে দিয়ে ঝাল-ঝাল রসা করে বানানো, অন্যদিকে তেঁতুল দিয়ে টক-টক, আর মাঝখানটা শুধু তেলে ভাজা, এরকম খেয়েছো?
-- ধুর, বা*! কি সব বলছো বলো তো!
- বলছি যে, ভিয়েতনামের মাছ এসেছে যেটার একদিক কিউবার ঝাল বানানো হয়েছে অন্যদিকে চীনের টক আর মাঝখানে রাশিয়ার ভাজা-ভাজা, এই হলো আমার পার্টি কংগ্রেস। তোমরা মা*, চাইলেও এই মাছ খেতেও পাবে না আর দেখতেও পাবে না। তাই শুধুই শুনেই যাবে।
কিরকম ভ্যাবলা মার্কা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। আড্ডা আর জমলো না সেদিনের মতো। তবে ওই মাছ কি তা হাড়ে-হাড়ে বুঝেছি যত সময় গেছে। সেই ৯৭ থেকে আজকের ১৯, লক্ষণদার বলে দেওয়া মাছের ট্রাডিশন আজও চলছে।
লক্ষণদা আজকাল আর আড্ডা মারতে আসে না। আসলে ওদের যে গ্রুপটা ছিলো, তারা কেউই প্রায় আসে না। তবে রাস্তা-ঘাটে যেখানেই দেখা হোক, আমি দেখি বা না দেখি, গুরুভাই দেখলেই ডাকে। একটু দাঁড়ানো, একটু কথা, একটা বিড়ি একসাথে দাঁড়িয়ে খাওয়া, এই নিয়েই চলে যাচ্ছে, বেঁচেও আছি আমরা সবাই একই শহরে।
** বলে রাখা ভালো এই লেখার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, এরকম কথা যেমন বলছি না ঠিক তেমনি এই লেখা থেকে যে আমার রাজনৈতিক অভিমত জানতে চাইবে সেটাও তার নিজস্ব ধারণা। আর কারোর ধারণার উপর আমার যেমন জোর খাটানোর কোনো ইচ্ছা নেই তেমনি তার ধারণা বদলানোরও আমার কোনো ইচ্ছা নেই।
*** রাম ঘুরে বাম, শুন্য হলেও বাম, মুড়ি ঘুগনির থালায় রোজনামচা, এরকম ঝুড়ি-ঝুড়ি গাল-গল্প গত কয়েকমাস ধরেই শুনে আসছিলাম তাই এই লেখাটা পোস্ট করতেই মন চায়নি। আসলে আমাদের চেনাগুলো মনে হয় অন্যরকমই ছিল বরাবরই এই সমস্ত মানুষগুলোর জন্য। তাই কাল রাত্রের আড্ডায় কয়েকজনকে বলতেই বুঝলাম কি ভীষণ ভাবেই আজও 'নাক কাটা' আমাদের সঙ্গে রয়ে গেছে। তাই আজই হোক।
২২.০৫.২০১৯ ( না, না ! স্পেশাল কোনো দিন নয় আজ!! আবার, হয়তো!)

Comments

Popular Posts