নন-সেন্স কথামালা (১০) **** আশা ছিল শুধুই আর কিছু ছিল না!

নন-সেন্স কথামালা (১০)

#আশা ছিল শুধুই আর কিছু ছিল না!

খুব চেনা এক গল্প আমার বন্ধু, 'মাস্টার' বলেছিল অনেকদিন আগে। কি পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিল সে আজ আর মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে আমাকে একটু শিক্ষা দিতেই বলেছিল। ও যখন গল্পটা বলে তখন ও সদ্য স্কুলে যোগ দিয়েছে আর আমি তার পরের বার যোগ দিই। গল্পটা আমায় শোনানোর জন্য আমি খুব অপমানিত হয়েছিলাম এরকম নয় তবে বেশ গায়ে লেগেছিল। আজও আমি ইলেভেনে ভর্তি হওয়া নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রথম দু-এক দিনের মধ্যে গল্পটা বলি। আমার উদ্দেশ্য থাকে আমাদের স্কুলের ছেলেগুলো যারা সদ্য ইলেভেনে উঠেছে আর উঠেই 'কি ছিনু, কি হনু' ভাব হয়ে গেছে তারা যেন একটু চুপ-চাপ থাকে আর কি! এই উদ্দেশ্যের মূল কারণ হলো পাশের গার্লস স্কুল থেকে আসা এক ঝাঁক ছাত্রী। না, ছাত্রীরা কেউ খারাপ বা বদমায়েসী করে তা নয়। আসলে আমাদের 'মূর্তিমান' গুলোকে একটু চোখে চোখে না রাখলে এই দু-বছরে ভেসে যাবে, আরকি! একজনও যদি গল্প শুনে আমার মতো গায়ে লাগায় বা অপমানিত বোধ করে তাহলে আগামী দু-বছর তার আর সমস্যা হবে না। পরে ঠিকই বুঝবে, স্যার, ভালোই বলেছিল। যাই হোক, গল্পটার আমার শোনার সময়ের সাথে বা আজকে আমার ক্লাসে বলায় বা আজকের দিনে ভোট পরবর্তী বাংলায় আদেও নতুন ভাবে কোনো অর্থ বহন করে কিনা তা যে যার নিজের মতো খুঁজে নিলেই ভালো।
যাই হোক, গল্পটা শোনা যাক। যার-যার আগে শোনা হয়ে গেছে, সে কেটে পড়তে পারো।
শহরের সার্কাস ময়দানে বিখ্যাত রাশিয়ান সার্কাস তাঁবু ফেলেছে। অসাধারণ সব খেলা দেখাচ্ছে। বাঘ, সিংহ থেকে হাতি, ঘোড়া যেমন আছে তেমনই আছে ট্রাপিজের খেলার সুন্দরী থেকে জিমনস্টিক্সের এক ঝাঁক উঠতি ছেলে মেয়ের দল। বিকালে আর সন্ধ্যায় দুটো শো হয় সারাদিনে। আর সকালের দিকে ছেলে-মেয়ে থেকে জন্তুদের সবারই প্র্যাক্টিস হয়। আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি যে এই জন্তুদের দলে একটা গাধাও থাকে। তারও একটা খেলা আছে। আহামরি কিছু নয়, শুধু শেষকালে যখন সব জন্তু-জানোয়ার রিংয়ের পাশ দিয়ে মিছিল করে ঘুরে আসে, গাধাও ওদের সাথে তাই করে। সেটাও গাধা ভুল করে, সোজা করে চলতে পারে না, পায়ে-পা জড়িয়ে ফেলে অন্যজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে। তাই রোজ সকালে গাধারও ট্রেনিং হয়। সবার ট্রেনিং, প্রাকটিস সব মাস্টাররা করে সকাল থেকে দুপুর অবধি। গাধার ঐটুকু ট্রেনিংও গাধা ঠিক করে করতে পারে না, তাই মাস্টারের কাছে রোজ মার খায়। একদিন হাতি পাশে ট্রেনিং করছিল। গাধার এই মার খাওয়া দেখে,
- কি ব্যাপার বলতো! এইটুকু কাজও তুই ঠিক করে করতে পারিস না। রোজ মার খাস, তোর লজ্জা নেই!
-- তোকে বেশী বকতে হবে না, তুই নিজের চরকায় তেল দে।
হাতি আর কি বলে, এই অপমানের পর আর কিই বা বলা যায়!
কিছুদিন বাদ হাতি দেখে আবার গাধাকে ওর মাস্টার খুব ঠাঙাচ্ছে। হাতি এবার আর থাকতে পারলো না,
- কি হলো? তুই তো রোজই মার খাচ্ছিস। কি করতে আছিস এখানে? পালিয়ে যা এখান থেকে। ধোপার বাড়ী কাজ কর। আরামে থাকবি।
--(গাধা চুপ)
- কি রে! পালাবি? তুই এখানে থেকে আর কি করবি? এই রোজ, রোজ মার খাওয়া!
-- হাতি দা, দেখো, তুমি সব কিছু বোঝ না। তাই সব ব্যাপারে আগ-বাড়িয়ে শুঁড় গলাতে আসো কেন?
- মানে?( হাতি কেমন বমকে গেছে গাধার কথা শুনে)
-- মানে তুমি বুঝবে না। আসলে আমি এখানে আছি কারণ আমার এখানে আশা আছে। তোমার ওসব নেই, তুমি ছাড়ো আমার ভাবনা।
হাতি মনের দুঃখে ফিরে আসে নিজের জায়গায় আর ভাবে গাধার কি আশা আছে এই সার্কাসে। আমি এতদিন আছি, আমার কোনও আশা নেই, আর ও রোজ মার খাচ্ছে, তাও বলে ওর নাকি আশা আছে। এরপর আবার একদিন হাতি দেখে গাধা খুব মার খাচ্ছে। হাতি ঠিক করলো আজ ফয়সালা করবোই। কি ওর আশা যার জন্য ও এতো মার খেয়েও সার্কাসে রয়ে গেছে। গাধার কাছে গিয়ে চুপ করে বসলো কিছুক্ষন তারপর,
- আচ্ছা দেখ, তুই এতো মার খাচ্ছিস তাও আছিস যখন নিশ্চয়ই তোর আশা আছে।
--গাধা চুপ।
- আসলে আমি ভাবছি, কি এমন আশা, যার জন্য তুই এতো মার খেয়ে, অপমান সহ্য করেও রয়ে গেছিস!
--গাধা চুপ।
- বল রে! আমার তো তোর কথা ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে!
-- বলছি তোকেই একমাত্র। কাওকে বলিস না যেন!
- না, না, কাওকে বলবো না। তুই বল!
- ওই যে দেখছিস ওখানে? (একটু দূরে যেখানে বাকিদের প্র্যাক্টিস হচ্ছে সেদিকে দেখিয়ে)
-- দেখছি তো। কি? ওই ঘোড়াগুলো?
- ধুর! না, না। ওর উপরে দেখ।
-- উপরে তো জালের খেলার মেয়েগুলো প্র্যাক্টিস করছে।
- হুঁ। পনি-টেল করা মেয়েটাকে দেখেছিস!
-- রোজই তো দেখি। ও তো ম্যানেজারের মেয়ে। আমার পিঠে চেপে রোজ ঘুরতে যায়, সেই ছোট থেকে।
- হু, হু (একটু লজ্জা পেয়ে), সেদিন ওর মাস্টার কি বলেছে জানিস?
-- কি বলেছে?
- (আরো লজ্জায় মুখ নামিয়ে) বলেছে, এবার যদি ঠিক করে খেলা দেখাতে না পারিস, ওই গাধাটার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দেব!
আমি সাধারণ ভাবেই গল্পটা এখানে শেষ করি এবং অবশ্যই চুপ করে যাই। ছেলে-মেয়েদের বোকা ভাবার কোন কারণই নেই। ওরা তোমার মুখের কথা শেষ করার আগেই বুঝে ফেলে কি বলতে চাইছো। তাই গাধার আশা নিয়ে আর বলার কিছু থাকে না। শুধু কিছুক্ষনের মধ্যে অন্য কথা বলতে বলতে হঠাৎই প্রশ্ন করি, 'কি রে, কার কার আশা আছে?' মুখ টেপা-টিপি করে হেসে একটু আধটু আওয়াজ করে মাঝখান থেকে কে একজন যেন বলে ওঠে, 'স্যার! দীপাঞ্জানের আশা আছে।'
- তা থাক, আশা থাকা ভালোই। তবে গাধার আশা না করলেই ভালো।
ভোট পরবর্তী বাংলায় চারিদিকে এতো আশা আমি আজকাল দেখতে পাই, নিজেকে কেমন গাধার মতো লাগছে আজকাল। না, গাধার মতো আশা আমি করিনা। কিন্তু যে আশার বাণী আমি চারিদিক থেকে শুনতে পাচ্ছি বা বলা ভালো আমায় শোনানো হচ্ছে তাতে আমি খুবই চিন্তিত। না, না আমি মোটেই আমাকে নিয়ে চিন্তিত নই, কারণ আমার 'মাস্টার' বন্ধু আছে আর সে আমাকে সেই কবেই শিখিয়ে দিয়েছে আশা আর গাধার আশার পার্থক্য। কিন্তু তোমরা কি করবে!
*আমার 'মাস্টার' বন্ধুকে সবাই মাস্টার বলেই ডাকে, তাই কেন মাস্টারমশাই বললাম না, সেই নিয়ে চুল** এসো না।
*গল্পটা মোটেও অরাজনৈতিক নয়, তাই নিজের ভাবনা জোর করে আমার উপর চাপাতে এসো না।
* নাম না করেই 'মাস্টার'কেই উৎসর্গ করলাম। ঠিক দেখে নেবে।
(30.5.2019)

Comments

Popular Posts